Views Bangladesh Logo

চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-১০

কম্পিউটার চিপ: উপসাগরীয় যুদ্ধের আসল নায়ক

Mahmud  Hossain

মাহমুদ হোসেন

৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি। ভোরবেলা সৌদি আরবের বিমানঘাঁটি থেকে মার্কিন এফ-১১৭ বোমারু বিমানগুলো নিঃশব্দে উড়াল দিল। তাদের সবার লক্ষ্য- বাগদাদ।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র এত বড় কোনো যুদ্ধে নামেনি। এবার তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে এসেছে। কয়েক লাখ সৈন্য সৌদি আরবের সীমান্তে প্রস্তুত। হাজার হাজার ট্যাঙ্ক অপেক্ষা করছে আক্রমণের জন্য। সমুদ্রে নৌবহর, ক্ষেপণাস্ত্র আর গোলাবারুদ বাগদাদের দিকে তাক করা। এই অভিযানের নেতৃত্বে আছেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিজ্ঞ জেনারেল নরম্যান শোয়ার্জকপফ; কিন্তু এবার তিনি সৈন্যদের সরাসরি যুদ্ধে পাঠালেন না। ভরসা রাখলেন দূরপাল্লার অত্যাধুনিক অস্ত্রের ওপর।

প্রথম আঘাত হানার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল বাগদাদের একটি ১২তলা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবন। শোয়ার্জকপফের যুদ্ধ পরিকল্পনার মূলে ছিল এটি ধ্বংস করে ইরাকের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেয়া। দুটি এফ-১১৭ বিমান থেকে ছোড়া হলো দুই হাজার পাউন্ডের পেভওয়ে লেজার-নিয়ন্ত্রিত বোমা। বোমাগুলো মুহূর্তেই ভবনটি ভেদ করে গেল আর তাতে আগুন জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বাগদাদে থাকা সিএনএনের লাইভ সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেল। লক্ষ্যবস্তুতে সফল আঘাত হানা হয়েছে। একই সময়ে মার্কিন নৌবহর থেকে ছোড়া হলো ১১৬টি টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র যা বাগদাদসহ আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত হানল। এভাবেই শুরু হলো পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধ।

প্রথম আঘাতেই ধ্বংস হলো যোগাযোগ টাওয়ার, সামরিক সদর দপ্তর, বিমানবাহিনীর ঘাঁটি, বিদ্যুৎকেন্দ্র, এমনকি সাদ্দাম হোসেনের গোপন আশ্রয়ও। উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার- ইরাকের শীর্ষ নেতৃত্বকে তাদের সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে অকার্যকর করে দেয়া। অল্প সময়ের মধ্যেই ইরাকের সামরিক বাহিনী এলোমেলো হয়ে গেল। টেলিভিশনে দেখা গেল, একের পর এক ট্যাঙ্ক বোমার আঘাতে উড়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনো ভিডিও গেম চলছে।

আসলে এই প্রযুক্তি এত নতুন কিছু ছিল না। পেভওয়ে বোমার আসল শুরুটা হয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধেই। ১৯৭২ সালে প্রথম প্রজন্মের পেভওয়ে বোমা দিয়ে ভিয়েতনামের থান হোয়া সেতু ধ্বংস করা হয়েছিল। তখন এই বোমাগুলো ছিল খুবই সাধারণ- কয়েকটি ট্রানজিস্টর আর একটি লেজার সেন্সর দিয়ে বানানো একটি সাধারণ বোমা। তবুও কাজ হয়েছিল। এরপর থেকে টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টস নামের একটি কোম্পানি এই বোমার একের পর এক উন্নত সংস্করণ তৈরি করতে থাকে। প্রতিবারই কম যন্ত্রাংশ দিয়ে আরও উন্নত ইলেকট্রনিক্স যোগ করা হয়, এতে বোমার নির্ভরযোগ্যতা বাড়ে এবং খরচও কমে আসে।

১৯৯০-এর দশকে পেভওয়ে হয়ে গেল মার্কিন সেনাদের সবচেয়ে পছন্দের অস্ত্র, সেইসঙ্গে হয়ে গেল সবার কাছে পরিচিত ও সহজলভ্য। প্রশিক্ষণেও সবাই এটি ব্যবহার করত। এটি যে কোনো লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে পারত। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল, লেজার-নিয়ন্ত্রিত বিমানগুলো লেজার ছাড়া বিমানগুলোর চেয়ে ১৩ গুণ বেশি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পেরেছে।

এভাবেই মার্কিন বিমানশক্তি উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকি সেনাদের চূর্ণ করে দিল অথচ মার্কিন সৈন্যদের ক্ষতি ছিল খুবই সামান্য। টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টসের প্রকৌশলী ওয়েলডন ওয়ার্ড লেজার-নিয়ন্ত্রিত এই পেভওয়ে বোমা আবিষ্কার এবং এর খরচ কম রাখার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেলেন। পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানে একজন বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা তাকে বললেন: ‘আপনাদের কারণে অন্তত দশ হাজার মার্কিন সৈন্যের জীবন বেঁচে গেছে।’

সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিল পেরি যখন টেলিভিশনে এই যুদ্ধ দেখছিলেন, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, লেজার-নিয়ন্ত্রিত বোমা কেবল শুরু। নজরদারি, যোগাযোগ, কম্পিউটিং- সবকিছুই বদলে দিচ্ছে মাইক্রোচিপ। এটাই ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর থেকে তার প্রবর্তিত ‘অফসেট স্ট্র্যাটেজি’র প্রথম বড় পরীক্ষা। এই স্ট্র্যাটেজির মূল লক্ষ্য ছিল প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দেয়া- যেমন স্টেলথ প্রযুক্তি, স্মার্ট অস্ত্র, নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদি ব্যবস্থা এবং জিপিএস- যাতে সোভিয়েতদের সংখ্যাগত আধিক্যের ঘাটতি পূরণ করা যায়। সত্তর ও আশির দশকে অনেকেই এই ধারণাকে গুরুত্ব দেয়নি। অনেকেই সন্দেহ করেছিল, কম্পিউটার চিপ দিয়ে যুদ্ধ জেতা কি সত্যিই সম্ভব?

কিন্তু উপসাগরীয় যুদ্ধ সব প্রশ্নের উত্তর দিল। টেলিভিশনে দেখা গেল, নির্ভুল অস্ত্রে একের পর এক ধ্বংস হচ্ছে ইরাকি ট্যাঙ্ক, বিমানঘাঁটি, আর ভবন। এমনকি ভিয়েতনাম যুদ্ধের পুরোনো সাইডওয়াইন্ডার মিসাইলও যা সে সময় বেশিরভাগ সময় লক্ষ্য মিস করত, নতুন সেমিকন্ডাক্টর-নিয়ন্ত্রিত সিস্টেমে তা ছয় গুণ বেশি নির্ভুল হলো। নতুন প্রযুক্তি প্রত্যাশার চেয়েও ভালো কাজ করল।

ইরাকি সেনাদের হাতে তখন ছিল সোভিয়েত তৈরি আধুনিক সব অস্ত্র; কিন্তু আমেরিকার ইলেকট্রনিক যুদ্ধশক্তির সামনে তারা অসহায় হয়ে পড়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি শিরোনাম ছিল: ‘ইস্পাতের ওপর সিলিকনের জয়’। আরেকটি শিরোনাম লিখল: ‘যুদ্ধের নায়ক হতে পারে কম্পিউটার চিপ’।

এর প্রভাব কেবল বাগদাদেই নয়, মস্কোতেও টের পাওয়া গিয়েছিল। সোভিয়েত সামরিক বিশ্লেষকরা স্বীকার করলেন, এটি পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর একটি যুদ্ধ, এক ধরনের ‘তরঙ্গের লড়াই’। ইরাকের এই দ্রুত পরাজয় ঠিক সেটাই প্রমাণ করল যা সোভিয়েত জেনারেল ওগারকভ অনেক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন: ‘ভবিষ্যতের যুদ্ধ নির্ধারিত হবে ইলেকট্রনিকসের মাধ্যমে’।

এই যুদ্ধের প্রকৃত নায়ক শুধু জেনারেল বা সৈনিক নয় বরং প্রকৃত নায়ক ছিল কম্পিউটার চিপ।

[ক্রিস মিলারের সাড়াজাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ২৭তম অধ্যায় (ওয়ার হিরো) থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন]

লেখক পরিচিতি: মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন। 

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ