Views Bangladesh Logo

স্মার্টফোনের বাজার কি চোরাকারবারিদের কাছেই জিম্মি থাকবে

Rased Mehedi

রাশেদ মেহেদী

মোবাইল হ্যান্ডসেট বাজারের চিহ্নিত চোরাকারবারিরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান কার্যালয় অবরোধের নামে জিম্মি করে অচলাবস্থার সৃষ্টি করছে। রাস্তা অবরোধ করে, শত শত নাগরিককে চরম দুর্ভোগে ফেলে চোরাচালানের অবাধ সুযোগ বহাল রাখার দাবি জানাচ্ছে! সত্যিই বাংলাদেশ বড়ই অদ্ভুত জায়গা। সম্ভবত, এটি বিশ্ব রেকর্ড! বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশে এক দল চোরাবাকারবারিরা এভাবে রাস্তায় জড়ো হয়ে জনজীবন অচল করার তথাকথিত কর্মসূচী বাস্তবায়নের ধৃষ্টতা দেখাতে পারেনি।

ঘটনার মূল কারন টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্ট্রার(এনইআইআর) নামে একটি একটি ব্যবস্থা চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্যবস্থায় দেশের সাধারন ব্যবহারকারীরা সুলভ মূল্যে বৈধভাবে দেশে উৎপাদিত কিংবা আমদানি করা মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। একই সঙ্গে চোরাচালানকারীদের মাধ্যমে আনা নকল, রিফারবিশড হ্যান্ডসেট কেনার প্রতারণা থেকে সুরক্ষা পাবেন। সাধারন ব্যবহারীদের ডিজিটাল ডিভাইসে নিরাপদ আর্থিক লেনদেনসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। চোরকারবারিদের দৌরাত্মের কারনে স্মার্টফোন আমদানির ক্ষেত্রে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। এনইআইআর চালু হলে এ ক্ষেত্রে শুল্ক-কর ফাঁকিও বন্ধ হবে।



চোরাকারবারিরা আন্দোলন শুরু করার কারন হিসেবে নিজেদের পিআর এজেন্সির মাধ্যমেই জানিয়েছে, তাদের কাছে কয়েকশ’ কোটি টাকার হ্যান্ডসেট মজুদ রয়েছে। যদি ধরেও নেই তাদের কাছে একশ’ কোটি টাকার হ্যান্ডসেট মজুদ আছে তাহলেও আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান ৫৭ শতাংশ কর ধরলে সরকার ৫৭ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে এসব চোরকারবারিদের মাধ্যমে অবৈধ পথে হ্যান্ডসেট আসার কারনে। যদি চোরাকারবারিদের মজুদকৃত হ্যান্ডসেট আমদানির পরিমাণ হয় এক হাজার কোটি টাকা তাহলে কর বাবদ রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৭০ কোটি টাকা। এ ছাড়া স্মার্টফোন বাজারের এই চোরাকারবারিদের মাধ্যমে গত দুই দশকে দেশ থেকে শত শত কোটি টাকা পাচারেরও জোরালো অভিযোগ রয়েছে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে আমদানি পর্যায়ে ৫৭ শতাংশ করারোপ কতটা যুক্তিযুক্ত? কিন্তু এর বিপরীতে এ তথ্যটাও সত্য যখন হ্যান্ডসেট আমদানিতে করের পরিমাণ ২০ শতাংশ ছিল তখনও চোরাকারবারীদের রমরমমা বানিজ্য ছিল। এরপর যখন বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড স্যামসাং প্রথমবারের মত বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করল তখন আমদানি পর্যায়ে করের পরিমাণ বৃদ্ধির যুক্তিটাও দৃঢ় হল। কারন শুধু স্যামসাং নয় দেশীয় সিম্ফনি, ওয়াল্টনসহ বেশ কিছু ব্র্যান্ড তখন দেশেই কারখানা স্থাপন করে হ্যান্ডসেট উৎপাদন শুরু করেছে। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে গার্মেন্ট শিল্পের পর মোবাইল হ্যান্ডসেট শিল্পেই “ মেড ইন বাংলাদেশ” এর গর্বের স্টিকার লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি হল। সেই সম্ভবনাকে উজ্জ্বল করতে এবং আরও বেশী গ্লোবাল ব্র্যান্ডকে বাংলোদেশে কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত করতেই আমদানি পর্যায়ে করহার বাড়ানো হল। স্থানীয় বিকাশমান শিল্পকে উৎসাহিত করতে উচ্চহারে করহার আরোপের মধ্য দিয়ে আমদানি নিরুৎসাহিত করা উন্নত দেশগুলোরও বড় একটি নীতিগত অবস্থান।

সরকারের এই নীতিগত অবস্থানের কারনে দেশে গত এক দশকে আইফোন ছাড়া অন্যসব নামী দামী ব্র্যান্ডের কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এসব কারখানা স্থাপনের জন্য দেশীয় উদ্যেক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, সেই ঋণের কিস্তি দিয়ে যাচ্ছেন। এর সঙ্গে সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিচ্ছেন। দেশে আগামী দিনের উপযোগী করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য জনবল তৈরি করেছেন, বিপুল সংখ্যক নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। এই যে মানুষগুলো যারা অনেক বড় ঝুঁকি নিয়ে কারখানা স্থাপন করে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের জন্য অবদান রাখতে চাইলেন, তাদের পক্ষে কি রাষ্ট্র দাঁড়াবে না?

এই প্রশ্ন থেকেই এনইআর ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি সামনে আসে। এর পাশাপাশি আইন-শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর কাছ থেকেও এই ব্যবস্থা চালুর পক্ষে সমর্থন আসে। কারন ডিজিটাল ডিভাইস করে অপরাধ কর্মকান্ড দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু একটি রেগুলেটরি টুলস কিংবা একটি কার্যকর ডিভাইস ডাটাবেস না থাকার কারনে প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করা দুরূহ হয়ে উঠছিল। একটা বিষয় বুঝতে হবে মোবাইল ফোন এখন শুধু একটা ডিভাইস নয়, এটি মানুষের ব্যক্তিগত পরিচয়, আর্থিক তথ্য ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রার একটি নিরাপত্তা–কেন্দ্র। অনিবন্ধিত হ্যান্ডসেট বিশেষ করে স্মার্টফোন অপরাধীদের জন্য সুবিধাজনক অস্ত্র। এগুলো দিয়ে প্রতারণা, চাঁদাবাজি, সাইবার অপরাধ, এমনকি বড় ধরনের অপরাধের যোগাযোগও পরিচালিত হয়। এ কারনে এনইআইআর চালু ছিল সময়ের দাবি।

বিগত সময়ে ২০১৮ সালে নিয়ন্ত্রক সংস্থা উদ্যেগ নিলেও শক্তিশালী চোরকারবারি সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে এই এনইআইআর বাস্তবায়ন হয়নি। কারন এই চোরাকারবারিরা ছিল তাদের বিদেশে টাকা পাচারের বড় হাতিয়ার। বর্তমান অন্তবর্তী সরকারে সময়ে বিটিআরসি আবার যখন এনইআইআর বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহন করল, তখন এই চোরাকাবারিরা রাস্তায় নেমে গেল। যেহেতু ঢাকার রাস্তায় এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার মত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন অবাধে মূল সড়কে চলতে পারে, সে কারনে চোরকারবারিরাও বুক ফুলিয়ে রাস্তায় নামতে পারে!

একটা বিষয় বুঝতে হবে আমদানিকারক আর চোরাকারবারি এক নয়। আমদানিকরারক হচ্ছেন তারাই যারা বৈধ পথে সরকারকে ট্যাক্স-ভ্যাট দিয়ে আমদানি করেন। কিন্ত চোরকারবারিরা কখনও চুরির মাধ্যমে, কখনও ব্যবহৃত ফেলে দেওয়া হ্যান্ডসেট ডাস্পিং স্টেশন থেকে সংগ্রহ করে, কখনও কারখানা থেকে রিফারবিশড হ্যান্ডসেট খুব কম দামে কিনে নিয়ে কিংবা আন্তর্জাতিক ডিস্ট্রিবিউটদের ‘স্টক ক্লিয়ারেন্স’ এর মূল্যছাড়ের সুযোগ নিয়ে হ্যান্ডসেট দেশে নিয়ে আসে। কোন ক্ষেত্রেই এরা সরকারকে ট্যাক্স-ভ্যাট দেয় না।

১৯৯৬ সাল থেকে যারা হ্যান্ডসেট বাজারের আমদানিকারক ছিলেন তারাই সময়ের বাস্তবতায় ২০১৮ সালে এসে উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়েছেন। যে কারনে এক সময়ের বাংলোদেশে মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েসন (বিএমপিআই) এর নাম বদলে বাংলাদেশ মোবাইল ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েসন (এমওআইবি) হয়েছে। কিন্তু চোরাকারবারিদের চক্র একই রয়ে গেছে। তাদের কোন সংগঠনও এতদিন ছিল না। অন্তবর্তী সরকারের আমলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এনইআইআর চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কয়েক দিন পরই এই চেরাকারবারীদের একটা সংগঠন দাঁড়াল কি একটা বিজনেস কমিউনিটি নামে। চোরাকারবারিরাও এখন মর্যাদাসম্পন্ন বিজনেস কমিউনিটি! দারুন ব্যাপার।

যা হোক এই তথাকথিত বিজনেস কমিউনিটির ব্যানারেই এখন অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল চলছে। পিআর এজেন্সিকে ব্যবহার করে হঠাৎ করে একটি সংগঠনের ব্যানার দাঁড় করিয়ে গোলটেবিল আলোচনারও আয়োজন করা হয়েছে। সম্ভবত, এই গোলটেবিলে অংশ নেওয়া সুধীজনদের অনেকেই জানেন না, তারা যে প্লাটফরমে বক্তব্য দিচ্ছেন সেটা চোরাকারবারিদের সুরক্ষার প্লাটফরম! একই সঙ্গে চোরকারবারিদের এসব ব্যানার-প্ল্যাটফরম থেকে নানা অপপ্রচার, গুজবও চালানো হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে পরিস্কার নির্দেশনা ও ব্যাখা দিয়ে এনইআইআর ব্যবস্থার আদ্যপান্ত জানানো হলেও এই গুজব থামছেই না।

আমি খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই বিটিআরসি এই এনইআইআর ব্যবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে খুব বেশী প্রচার চালাচ্ছে না। এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশী ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে ‘ডিরেজিস্ট্রেশন’ সিস্টেম নিয়ে। অর্থাৎ কারও ব্যবহৃত হ্যান্ডসেটে অন্য কোন সিমকার্ড ব্যবহার করতে চাইলে হ্যান্ডসেটটি ডিরেজিস্ট্রেশন করে সিমকার্ড প্রতিস্থাপন করলে তার সঙ্গে ডিভাইসটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন করে রেজিস্টার্ড হয়ে যাবে। এই ব্যবস্থাটি খুব সহজ। কিন্তু সাধারন মানুষের প্রথমে বুঝতে একটু সমস্যা হতে পারে। এ কারনে টিভিতে, সড়কের পাশে বড় ডিসপ্লেতে, ওটিটি প্লাটফরমে মাল্টিমিডয়া বিজ্ঞাপন প্রচার করে দেখানো উচিত কত সহজে সাধারন মানুষ নিজেই নিজের ডিভাইস ব্যবহার করে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবেন। অনলাইন এবং সংবাদপত্রেও এ বিষয়ে বার বার বিজ্ঞাপন প্রচার করা উচিত।

আগামী ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস থেকে এই এনইআইআর চালুর সুনির্দিষ্ট ঘোষণা থাকলেও এখনও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে এ ধরনের সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে না। যে কারনে চোরাকারবারিরা অপপ্রচার ছড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে বেশী। আমার মনে হয় বিটিআরসি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের কর্মকর্তাদের কয়েকটি দলগত বিদেশ ট্যুর এ বছরের জন্য বন্ধ রাখলেই এই বিজ্ঞাপন প্রচারের টাকার সংকট হবে না।



চোরাকারবারিদের উত্থানে বড় দায় কর ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এনবিআরের। কারন এই চোরকারবারিরা বিমান বন্দর, সমুদ্র বন্দর, স্থল বন্দর দিয়ে কোটি কোটি টাকার হ্যান্ডসেট চোরাচালানের সুযোগ পেয়েছে এই শুল্ক কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা কিংবা যোগসাজশের কারনেই। এই চোরাকারবারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট প্রতারণার প্রধান হাতিয়ার এবং বড় বড় শপিং মলের শো-রুম গুলোও প্রতারণারও এক একটা সেন্টার।

চোরাকারবারিরা প্রতারণা করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারের এতগুলো প্রশাসনের নাকের ডগার সামনে দিয়ে সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে শো-রুম খুলে প্রতারণা করে যাবে দিনের পর দিন? এটা কার ব্যর্থতা? প্রতারিত গ্রাহকদের সুরক্ষা দেওয়ার এমনকি অভিযোগ জানানোর কোন কর্তৃপক্ষও তো নেই!

বিটিআরসি যখন এনআইআর চালু করার ঘোষণা দিল তখনই এনবিআরের ভাবা উচিত ছিল ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন চোরকারবারি দোকানে থাকা হ্যান্ডসেটের একটা ডাটাবেজ তৈরি করা এবং সুনির্দিষ্টভাবে এগুলোর শুল্ক হার কমিয়ে বৈধ ঘোষণা করা। এরপর বিটিআরসি এগুলোর আইএমইআই নম্বর সংগ্রহ করে এনইআইআর সার্ভারে নিবন্ধিত করে ফেলত।

একই সঙ্গে বিটিআরসি’র উচিত ছিল দুই সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে চোরকারিবারিদের তথাকথিত বিজনেস কমিউনিটির সবগুওেলা দোকানের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করার পদক্ষেপ নেওয়া। এরপর অবৈধ হ্যান্ডসেট পাওয়া গেলেই বিনা নোটিশে ট্রেড লাইসেন্স বাতিল এবং নির্দিষ্ট অংকের টাকা জরিমানার শর্ত রেখে নতুন করে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া। তাহলে আজকে গুটিকয়েক চোরকারবারির এই রাস্তা অবরোধ, উলম্ফন দেখতে হত না। কিন্তু এখনও বিটিআরসি’র সচেনতামূলক ব্যাপক প্রচারে অনীহা, এনবিআরের দায়সারা অবস্থান এবং সিটি কর্পোরেশনের নির্লিপ্ততা দেখে খু্ব আশংকা হচ্ছে এনইআইআর কার্যক্রম চালুর সফলতা নিয়ে। তবুও চাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই ভাল উদ্যেগ সফল হোক। চোরাকারবারিদের কাছে দেশ এভাবে জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না।

রাশেদ মেহেদী, সম্পাদক, ভিউজ বাংলাদেশ ও সাবেক সভাপতি, টিআরএনবি 

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ