Views Bangladesh Logo

যে কারণে ভূ-রাজনীতির নয়া কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ইরানের চাবাহার বন্দর

Reza  Ghatok

রেজা ঘটক

রাশিয়াকে জব্দ করতে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভারত যাতে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে, সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া। কারণ ভারত রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কিনে সেই তেল পরিশোধন করে রপ্তানি করে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ভারতের কাছে তেল বিক্রি করেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। এবার ইরানকে কোণঠাসা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন কৌশল নিয়ে আগাচ্ছে। ইরানের চাবাহার বন্দর যারাই ব্যবহার করবে তাদের ওপর জরিমানা বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্যিক ও কৌশলগত কারণে ভারতের কাছে ইরানের চাবাহার সমুদ্রবন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ১০ বছরের চুক্তিতে ইরানের সঙ্গে যৌথভাবে চাবাহার বন্দর পরিচালনা করছে ভারত।

ইরানকে ‘কোণঠাসা’ করতে চাবাহার বন্দরে অন্য দেশগুলোকে দেয়া কিছু ছাড় প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চাবাহার বন্দর ব্যবহার করলে যুক্তরাষ্ট্রকে জরিমানা (পেনাল্টি) দিতে হবে ভারতসহ অন্য দেশগুলোকে। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি কার্যকর হবে। সেক্ষেত্রে ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহার করলে যুক্তরাষ্ট্রকে জরিমানা দিতে হবে ভারতসহ অন্য দেশগুলোকে। মার্কিন বিদেশ দপ্তর জানায়, ইরানের অবৈধ অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে ভাঙার জন্যই তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। গত জুন মাসে ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিকে গুড়িয়ে দিতে সে দেশের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা করে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে ইরান। আগামী দিনে তারা পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর তালিকায় নাম লেখাতে চায়। আর ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করলে মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে ভয়ে থাকবে মার্কিন ছদ্মবেশী রাষ্ট্র ইসরায়েল। যে কারণে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে আপত্তি রয়েছে পেন্টাগনের। এই ঘটনার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক বর্তমানে তলানিতে নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের চাবাহার সমুদ্রবন্দরের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করলে সবচেয়ে ক্ষতির মুখোমুখি হবে ভারত। হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণা ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা। কারণ ইরানের চাবাহার সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ভারত। ভারতের 'কানেক্টিভিটি ডিপ্লোম্যসির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেও ইরানের চাবাহার বন্দরে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে দিল্লি।

ওমান উপসাগরের এই বন্দরটির একটি টার্মিনাল গড়ে তোলার জন্য ভারত ইরানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। ইরানের চাবাহার বন্দর পরিচালনার জন্য ২০২৪ সালের ১৩ মে দশ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি সই করে ভারত ও ইরান। ভারত ওই বন্দরের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কৌশলগত কারণেই ওই চুক্তি করে। আর বিদেশের কোনো বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব ভারত প্রথম নিয়েছিল ইরানের এই চাবাহার বন্দর ব্যবহার দিয়ে। মাত্র গত বছর বন্দর পরিচালনার চুক্তি সই হলেও মূলত ২০০৩ সালেই চাবাহার বন্দর গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয় ভারতের অটল বিহারি বাজপেয়ী সরকার। দিল্লি চেয়েছিল যে, পাকিস্তানকে এড়িয়ে ভারতীয় পণ্য যাতে সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্র্যান্সপোর্ট করিডোর অর্থাৎ আইএনসিটিসির মাধ্যমে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতে পৌঁছানো যায়।

আইএনসিটিসি প্রায় ৭২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বহুমুখী পরিবহন প্রকল্প। এই পরিবহন পথ দিয়ে ভারতের ইরান, আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে পণ্য চলাচল অনেক সুবিধাজনক হয়েছে; কিন্তু ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে চাবাহার বন্দরের উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে যায়। ইরানের চাবাহার বন্দর পরিচালনা নিয়ে ভারত আর ইরানের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি সই হয় ২০১৮ সালে। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে দু'দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের জন্য ইরানের চাবাহার বন্দর তাই কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তানকে এড়িয়ে ভারতকে ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্র্যান্সপোর্ট করিডোর অর্থাৎ আইএনসিটিসি ব্যবহার করার জন্য ইরানের চাবাহার বন্দর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই পথ দিয়ে ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে ভারতীয় পণ্য। আবার ইরান আর রাশিয়ার জন্যও আইএনসিটিসি যথেষ্ট লাভজনক।

তাই ঘুরপথে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে শাস্তি দিতে জরিমানা চাপালে চাবাহার বন্দর নিয়ে ভারতের পরিকল্পনা বিশাল ধাক্কা খাবে। পাশাপাশি এই প্রকল্পে অংশ নেওয়া অন্যান্য সংস্থাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইরানের চাবাহার বন্দরে যেসব সংস্থা কাজ করে, তাদের ওপর সেপ্টেম্বরের শেষ দিক থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই বন্দরে ভারতের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। চাবাহার বন্দরের একটি টার্মিনাল সম্পূর্ণভাবে ভারত পরিচালনা করে। আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য এই বন্দর ভারতের কাছে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের দক্ষিণ উপকূলে সিস্তান-বালুচিস্তান অঞ্চলে অবস্থিত চাবাহার বন্দর ভারত আর ইরান যৌথভাবে গড়ে তুলছে।

কৌশলগত বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, চাবাহার বন্দর পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কার্যত ভারতকে সাজা দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে যে, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সহকারী মুখপাত্র থমাস পিগাট এই সংক্রান্ত ঘোষণা করেছেন। এই সিদ্ধান্ত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে চালু হবে। এরপর থেকে যারাই চাবাহার বন্দরে পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকবে বা আইএফসিএ অনুযায়ী অন্যান্য কাজকর্মে শামিল হবে, তারাই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগের জন্য ভারত-ইরান সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। চাবাহারে ১১ বিলিয়ন ডলারের ‘হজগক লোহা ও ইস্পাত খনির প্রকল্প’ জন্য সাতটি ভারতীয় সংস্থাকে কেন্দ্রীয় আফগানিস্তানে জমি প্রদান করেছে আফগানিস্তান সরকার। ভারত ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চাবাহার-হাজীগাজ রেলপথের সহকারী অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য আফগানিস্তানের কাছে অঙ্গীকার করেছে।

ইউরোপ ও তুরস্কের সঙ্গে সংযুক্ত ৭২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বহুমুখী আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডোর (আইএনএসটিসি) দিয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে আরো বাণিজ্যের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়াজুড়ে আর-২৯৭ আমুর মহাসড়ক, ট্রান্স-সাইবেরিয়ান মহাসড়ক এবং তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানতে প্রবেশের উদ্দেশ্যে ‘মাজার-ই-শরিফ-হেরাত রেলপথ’ পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইরানের চাবাহার বন্দরের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা চালু হলে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাবে ভারত। কিন্তু সেই সুযোগে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর ব্যবহার করে ওমান উপসাগরে আধিপত্য বিস্তার করবে চীন। ওদিকে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে বর্তমানে ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো।

মার্কিন চাপ থাকলেও ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করবে না। আবার যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান ঘাঁটি পুনরায় দখল করা কৌশলগত কারণে অনেক ব্যয়বহুল। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্মিত ওই বাগরাম বিমান ঘাঁটি এখন পুরোপুরি তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। হয়তো গোপনে সেখানে রাশিয়া তালেবানদের সমর্থন দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে ইরানের চাবাহার বন্দর অচল করে ইরান ও ভারতে শিক্ষা দিতে চায়। অন্যদিকে পাকিস্তানের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে পুনরায় আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি দখল করতে চায়। পাশাপাশি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে ইরানের ওপর হামলা করার খায়েশ যুক্তরাষ্ট্রের।

কিন্তু জিও-পলিটিক্স এমন এক জটিল প্রক্রিয়া যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই খায়েশ পূরণ হওয়ার নয়। কারণ ওমান উপসাগর ও আরব সাগরে মার্কিন আধিপত্য ইরানের পাশাপাশি ভারত ও চীন মেনে নেবে না। আবার রাশিয়াও একদম চুপ করে বসে থাকবে না। কৌশলগত কারণে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর ব্যবহার করে সুযোগ নেবে চীন; কিন্তু মার্কিন আধিপত্য একদম সহ্য করবে না চীন।
ওমান উপসাগর ও আরব সাগরে মার্কিন আধিপত্য যখনই বাড়তে চাইবে, তখনই ইরান-ভারত-রাশিয়া ও চীন তা প্রতিহত করবে। আবার পাকিস্তান পুরোপুরি মার্কিন সাহায্য নিতে গেলেই চীন তাদের উন্নয়ন সহযোগিতা কমিয়ে দেবে। পাকিস্তান সৌদি-আরবের সঙ্গে যে সামরিক চুক্তি করেছে, সেদিকে কড়া নজর রাখছে চীন ও ভারতের পাশাপাশি ইরান ও রাশিয়া।

যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে দিয়ে ইরানের সঙ্গে যে বিরোধ আরও তীব্র করার চেষ্টা করছে, বিপরীত দিকে ইরান তাদের ছোট ছোট সহযোগী বাহিনী যেমন হামাস ও হিযবুল্লাহ কিংবা হুতিদের দিয়ে তা প্রতিহতের কৌশল নিয়েছে। ফলে ইরানের চাবাহার বন্দরের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কড়াকড়ি শেষপর্যন্ত তাদের জন্য বুমেরাং হতে পারে। কারণ চাবাহার বন্দরে কৌশলগত কারণে ভারত একচুলও ছাড় দেবে না। ভারতের ছাড় না দেবার অর্থ হলো ইরানের পক্ষ আরও শক্তিশালী হবে। যদি ইরানের চাবাহার বন্দরে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে ভারত, রাশিয়া, চীন বা উত্তর কোরিয়া চুপ করে থাকবে না। সেই সুযোগে ইরান পাকিস্তানের করাচি বন্দরের ওপর পাল্টা হামলা চালাতে পারে বলে সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

রেজা ঘটক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ