Views Bangladesh Logo

হয়রানিমূলক হত্যা মামলা থেকে সাংবাদিকদের মুক্তি কবে?

ত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সারা দেশে আড়াই শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এক বা একাধিক হত্যা মামলা হয়েছে। জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানী ঢাকাসহ দেশে বিভিন্ন স্থানে আহত-নিহতের ঘটনায় হওয়া এসব মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিথ্যা অভিযোগে সাংবাদিকদের আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে এ ধরনের হত্যা মামলা আইনের অপব্যবহার ও মুক্ত সাংবাদিকতার ওপর মারাত্মত আঘাত বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা। একই সঙ্গে এ ধরনের মামলা থেকে সাংবাদিকদের নাম এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও। অন্যদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলার তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান আছে বলে জানিয়েছে এ-সংক্রান্ত সরকারি কমিটি।

সারা দেশে গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে গত জুন পর্যন্ত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হওয়া হত্যা মামলার একটি তালিকা গত জুলাই মাসে প্রকাশ করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)। এ ছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রেও গত জুনে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই দুই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত জুলাই ও আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কিত বিভিন্ন হত্যা মামলায় ২৬৮ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি ৯০টি মামলা হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এ ছাড়া সিলেটে ৪১, চট্টগ্রামে ৩৮, কুমিল্লায় ১৪, সাভারে ১২, নারায়ণগঞ্জে ১০, কুষ্টিয়ায় ১০ ও বগুড়ায় ৮ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া বরিশাল, মুন্সীগঞ্জ, বাগেরহাট, যশোর, পিরোজপুর, নওগাঁ, চাঁদপুর, কক্সবাজার, খুলনা, লক্ষ্মীপুর, বরগুনা, নড়াইল, পটুয়াখালী, ঠাকুরগাঁও, নেত্রকোনা ও রাজশাহীসহ অন্যান্য জেলাগুলোতেও একাধিক সাংবাদিক জুলাই-আগস্টের সহিংসতা সম্পর্কিত হত্যা মামলায় আসামি হয়েছেন। আসামি হওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশের সরাসরি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। বাকিদের ক্ষেত্রে এমন সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলেনি। মূলত প্রতিশোধমূলক কিংবা হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বাকি ৮২ শতাংশ হত্যা মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।

এদিকে গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ-সংক্রান্ত কমিটি গঠন হয় গত বছরের গত ৭ অক্টোবর। আট সদস্যের এই কমিটির সভাপতি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রচার)। সদস্য হিসেবে আছেন তথ্য অধিদপ্তরের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, আইন ও বিচার বিভাগের একজন প্রতিনিধি (জেলা জজ পদমর্যাদার), চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) মহাপরিচালক, বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সচিব। কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে থাকবেন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রেস)।

এই কমিটির গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ করছে এবং মামলার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করছে বলে ওই কমিটির একজন সদস্য ভিউজ বাংলাদেশকে জানান। তবে এ বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ-সংক্রান্ত কমিটি এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কাজ দেখাতে পারেনি। তাদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে হয়রানিমূলক হত্যা মামলা থেকে সাংবাদিকদের অব্যাহতি দেয়ার কাজ শুরু হবে।’ তিনি বলেন, আপনারা জানেন গত বছরের ৫ আগস্টের পরে দেশে শত শত হত্যা মামলা হয়েছে।

এর মধ্যে বহু নিরপরাধ মানুষকে আসামি করা হয়েছে বলে আমাদের কাছেও রিপোর্ট এসেছে। তাই আমরা একটি অধ্যাদেশ জারি করেছি। সেখানে বলা হয়েছে সাংবাদিকসহ নিরপরাধ যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের নাম যেন প্রাথমিক তদন্তেই বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ চূড়ান্ত তদন্ত পর্যন্ত যেন নিরপরাধ কারও নাম মামলায় না থাকে। এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ-সংক্রান্ত কমিটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তবে আমি বলছি কোনো নিরপরাধ অর্থাৎ হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই, এমন কোনো সাংবাদিককে কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণ হলেও সেই সাংবাদিকের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হবে না।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এ ব্যাপারে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সাংবাদিকরা কোনো ধরনের অন্যায় বা অবিচারের শিকার যেন না হন, সে বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এবং করবে। গায়েবি ও হয়রানিমূলক হত্যা মামলা থেকে সাংবাদিকদের নাম প্রত্যাহারের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসও সহযোগিতা করছে। মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেভাবে ঢালাও হত্যা মামলা হয়েছে তা খুবই দুঃখজনক। শুধু দেশে নেয়, দেশের বাইরেও এ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। সংবাদকর্মীরা কেন নিরাপদ না- সেই প্রশ্ন উঠছে। এটি একটি দেশের জন্য কাম্য না। তাই দ্রুত হয়রানিমূলক মামলা থেকে সাংবাদিকদের অব্যাহতি দেয়া এখন সরকারের দায়িত্ব।’

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘কোনো সাংবাদিক যদি অন্যায় করেন, তাহলে তার অবশ্যই প্রচলিত আইনে বিচার হবে; কিন্তু এখন দেখছি নিরপরাধ বহু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হচ্ছে। এটা সরকারেরই বক্তব্য। এটা দেশের জন্য মোটেই ভালো না। দ্রুতই এটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে এবং গায়েবি মামলা থেকে সাংবাদিকদের অব্যাহতি দিতে হবে। নইলে পরবর্তীতে এটি আরও খারাপের দিকে যাবে।’

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক ভিউজ বাংলাদেশ বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও হত্যা মামলা হয়েছে গত এক বছরে। এটা আগে কখনো হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আসামি সাংবাদিকরা অবশ্যই আতঙ্ক ও অস্বস্তিতে আছেন। কেন এমন ঘটনা ঠেকানো গেলো না এবং এখনো কেন এই সমস্যার সমাধান হয়নি সে ব্যাপারে সরকারই ভালো বলতে পারবে। এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কারণ এখন এসব বিষয়ে মন্তব্য করাও পরিবেশ নেই।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ