Views Bangladesh Logo

বিচার যখন রাস্তায় নামে, রাষ্ট্র তখন আর কার পক্ষে থাকে?

Habib Imon

হাবীব ইমন

রাজধানীর পল্টনে একজন সাবেক ছাত্রনেতাকে জনসমক্ষে অপদস্থ করা হলো। তাকে মারধর করা হলো ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যায়িত করে। অপরাধের স্বরূপ অস্পষ্ট; কিন্তু শাস্তি তাৎক্ষণিক- রাস্তায়, জনতার চোখের সামনে। এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এর আগে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, যিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও, তিনিও একদল জনতার হাতে নাজেহাল হন। ডিম ছোড়া থেকে শুরু করে গায়ে জুতার মালা, মারধর; তারপর পুলিশের সামনেই তাকে ঘেরাও করা হয়।

ঘটনার নিন্দা আসে, বিবৃতি আসে; কিন্তু প্রতিক্রিয়া থাকে প্রতীকী। বাস্তবতা হলো, আমরা একটি ‘গণআদালত সংস্কৃতি’র দিকে ধাবিত হচ্ছি- যেখানে রাষ্ট্রপক্ষ অনেক সময় দর্শক এবং জনতা হয়ে ওঠে বিচারক, কার্যনির্বাহী ও শাস্তিদাতা।

নির্বাচনে কারচুপির “রোল মডেল” যদি খুঁজতে হয়, তাহলে শুরুতেই দাঁড়াবে ১৯৯৪ সালের মাগুরা উপনির্বাচন। সে সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি আব্দুর রউফ। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান। সরকারি দল হিসেবে প্রশাসন এবং পুলিশকে ব্যবহার করে যে নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে কলঙ্কিত করেছিলেন সেটাই হয়ে উঠেছিল পরবর্তী দিনের সব নির্বাচনী কারচুপির ব্লুপ্রিন্ট।

এর ঠিক পরেই আসে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের সেই বিতর্কিত একতরফা নির্বাচন। বিএনপি সরকার তাদের পছন্দের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বিচারপতি সাদেক আলীকে বসিয়েছিলেন। তার নামকে ঘিরেই রচিত হয়েছিল এক সময়ের জনপ্রিয় রাজনৈতিক কটাক্ষ: “ছাদে-কালী”। সেই সংসদ টিকে ছিল মাত্র দেড় মাস। দেশের মানুষ রাস্তায় নেমেছিল এবং শেষ পর্যন্ত পতন ঘটেছিল সরকার ও কমিশনের।

২০০৪ সালে ঢাকার ১০ নম্বর আসনে নির্বাচন হলো। সে নির্বাচনেও কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এক ভুয়া নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বিএনপির প্রার্থী ফালুকে জেতানো হয়। সিইসি ছিলেন আবু সাঈদ। নির্বাচন কমিশন তখন জনগণের চোখে ছিল এক ‘পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত পক্ষপাতদুষ্টতা’র প্রতীক।

এরপর আসে ২০০৭ সালের সেই বিখ্যাত “জানুয়ারির নির্বাচন”- যা কোনোদিন অনুষ্ঠিতই হয়নি বরং রাষ্ট্রপতি নিজেই সেনা নিয়ন্ত্রিত জরুরি অবস্থার ডাক দেন। তার আগে তারেক রহমানকে “বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী” ঘোষণা করা হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি আজিজ। তার বিরুদ্ধেই স্লোগান উঠেছিল: “আইজ্জ্য, তুই বাইত যা!”

উৎপত্তি হয়েছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কণ্ঠে। সে স্লোগান হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্পন্দনের প্রতীক; কিন্তু প্রশ্ন হলো: এই সব ইতিহাসের কুখ্যাত নির্বাচন কমিশনারদের কি কেউ কখনো জুতার মালা পরিয়েছিল? তাদের বিরুদ্ধে কি কেউ জনগণের পক্ষ থেকে মামলা করেছিল? না। হয়নি। এবং এটিই আমাদের রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের করুণ পরিণতি। নির্বাচনী ব্যবস্থা বারবার ভেঙে পড়েছে; কিন্তু সেই ব্যবস্থাকে ভাঙার কারিগররা থেকে গেছেন অনতিক্রান্ত, অনুশোচনাহীন, অনেক সময় ‘সম্মানিত’ হয়ে।


২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছে বলে আদালতের কাছে স্বীকার করেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের সরাসরি হস্তক্ষেপে দিনের ভোট রাতে করাসহ নানা অনিয়ম হয়েছে। তখন গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল বলে তিনি পরে বুঝতে পারেন।

আজ যারা কথা বলছেন বা যারা কারও বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন- তাদের উদ্দেশ্য, তাদের ভাষা এবং তাদের উদ্দেশ্যবাহী ইতিহাসবোধ খতিয়ে দেখা জরুরি- ১৯৯৪ সাল থেকে তল্পিতল্পা নির্বাচনের সঙ্গে যেসব গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত, নির্বাচন কমিশন জড়িত তাদের ব্যাপারে কঠোর বিচারের পরিষ্কার অবস্থান থাকা উচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। তা না হলে পক্ষপাতদুষ্টে তারাও প্রশ্নবিদ্ধ হবেন একসময়।

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা বেড়েছে। এসব ঘটনা ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ পত্রপত্রিকায় ‘মব’ ও ‘মব জাস্টিস’ শব্দ দুটি আলোচনায় রয়েছে। ইংরেজি শব্দ ‘মব’-এর অর্থ ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’। আর সরল ভাষায়, এই বিশৃঙ্খল জনতা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে সহিংসতা করলে তাকে ‘মব জাস্টিস’ বা ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার’ বলা হয়।

এই প্রবণতা শুধু বাংলাদেশে নয়। ভারতের ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রে গত এক দশকে বহু মুসলমান, দলিত ও সংখ্যালঘু নাগরিককে গরু সংরক্ষণ বা ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগে ‘মব লিঞ্চিং’-এর শিকার হতে হয়েছে। পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের অপব্যবহারে বহু মানুষ উত্তেজিত জনতার হাতে নিহত হয়েছেন। আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া, কেনিয়া কিংবা ব্রাজিলে অভিযোগের ভিত্তিতে জনতা অনেককে হত্যা করেছে। আফ্রিকার দেশ উগান্ডার ‘জাস্টিস সেন্টার্স উগান্ডা’ প্রকল্প অনুযায়ী, মব জাস্টিস হলো অপরাধে জড়িত থাকার সন্দেহে কোনো ব্যক্তিকে অবমাননা, মারধর, হত্যা বা সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে সাজা দেয়া, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান না।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সর্বজনীন ঘোষণার ১০ ও ১১ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে: প্রতিটি নাগরিকের একটি নিরপেক্ষ আদালতে শুনানি পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ গণ্য করতে হবে- এটাই একটি সভ্য রাষ্ট্রের ভিত্তি।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না বা নিষ্ঠুর, অমানুষিক, অবমাননাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা তাহার সহিত এইরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।” সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ বলছে, “সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” ৩১ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা আইন অনুযায়ী সুরক্ষিত থাকবে।

এই অনুচ্ছেদগুলোর তাৎপর্য এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যদি কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি- হোক সে অপরাধী বা নির্দোষ- জনতার হাতে অপমানিত বা নিগৃহীত হয়, তাহলে তার মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। রাষ্ট্র যদি তা প্রতিরোধ না করে তবে সংবিধান কাগুজে হয়ে পড়ে।

আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে পরিস্থিতি যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও কিছু করে না। যেমন, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ঘেরাওয়ের ঘটনায় পুলিশ ছিল; কিন্তু তারা হস্তক্ষেপ করেনি। সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, পরে একজনকে আটক করে সেনাবাহিনী পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে; কিন্তু পরদিনই তিনি জামিনে মুক্ত। ঘটনা তোলপাড় হয়, তারপর চাপা পড়ে। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩২৩ (সাধারণ আঘাত), ৩৫৫ (অসম্মানজনকভাবে আঘাত করা) এবং ১৪৩, ১৪৭, ১৪৯ (অবৈধ জমায়েত ও সংঘর্ষ) ধারায় এই ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে। তবুও আমরা দেখি, বেশিরভাগ ঘটনায় আসামিরা গ্রেপ্তারই হয় না। আর হলেও তাদের বিচার হয় না।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসেব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসেই মব জাস্টিস বা গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১১৯ জন। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৭৯। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ১৫ জন নাগরিক আইনের বাইরে, রাস্তায়, জনরোষে প্রাণ হারিয়েছেন। গত ১০ বছরে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৯২ জনে। এ সংখ্যাগুলো শুধুই পরিসংখ্যান নয়- প্রত্যেকটিই একেকটি ভেঙে যাওয়া পরিবার, একটি করে বিচারের ব্যর্থতা।

বিশ্ব ইতিহাসেও মব জাস্টিসের এক নৃশংস অতীত আছে। ১৬৯২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সালেম শহরে ‘ডাইনি’ সন্দেহে ২০ জনকে জনসমক্ষে ফাঁসি দেয়া হয়। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবকালে প্যারিসে বাস্তিল দুর্গে গণ-আক্রমণ চালিয়ে জনতা বহুজনকে শিরশ্ছেদ করে। রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালের গণহত্যার পরে, অভিযুক্তদের অনেককেই আদালতের মুখোমুখি না করে জনতা নিজ হাতে শাস্তি দেয়। এই ইতিহাসগুলো বলছে: যখন রাষ্ট্র আইনের প্রয়োগে ব্যর্থ হয়, তখন প্রতিশোধই হয়ে ওঠে বিকল্প ন্যায়বিচার। আর এ ন্যায়বিচার সভ্যতাকে গ্রাস করে।

এই ধরনের জন-হিংসার গভীরে রয়েছে রাজনৈতিক উৎস। অনেক সময় রাষ্ট্রীয় মদদেই গড়ে ওঠে মব। ভারতের ২০১৮ সালের Tehseen Poonawalla v. Union of India মামলায় সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট ভাষায় বলেছিল: “মব লিঞ্চিং গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু।” আদালত কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছিল; কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এ ধরনের কোনো আইন নেই।

রংপুরে নারীদের ফুটবল বন্ধে ‘তৌহিদি জনতা’র হুমকিতে প্রশাসন যখন ১৪৪ ধারা জারি করে, তখন স্পষ্ট হয় রাষ্ট্র তার নিজস্ব ঘোষণা- নারীর অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি- তুলনায় দুর্বল। একদিকে উচ্চারণ অন্যদিকে পরাজয়। এই দ্বিচারিতা থেকেই জন্ম নেয় ভয়। ভয় থেকে জন্ম নেয় জন-আস্থার সংকট।

এখানে এক গভীর সংকেত লুকিয়ে আছে- সমাজ যখন আইনের চেয়ে প্রতিশোধে আস্থা রাখে, তখন রাষ্ট্র একটি ‘জন-রাষ্ট্র’ নয়, ‘দল-রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়। সেই রাষ্ট্রে আইন নয়, বরং ‘কারা মব গঠন করতে পারে’ তা-ই নির্ধারণ করে কে অপরাধী, কে মুক্ত। যেমন পাকিস্তানে তেহরিক-ই-লাব্বাইক-এর উগ্র আন্দোলনের সময় ব্লাসফেমির নামে বহু মানুষ নিহত হয় আর রাষ্ট্র নীরব থাকে। ভারতের উত্তরপ্রদেশে গরু সংরক্ষণের নামে বহু সংখ্যালঘুকে বিজেপি-সমর্থিত মব হত্যা করেছে। যে কোনো দেশে সাংবিধানিক বিচারবিহীন হত্যাকাণ্ডের বিস্তার সেই রাষ্ট্রের আইনের পরিকাঠামোর দুর্বলতার পরিচায়ক। বাংলাদেশেও তাই। বছরের পর বছর আমরা ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আর তার নিদর্শন- গুম, হত্যা, প্রতিহিংসামূলক বিক্ষোভ। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েই তো নতুন এক সরকার কল্পনা করেছিলাম; কিন্তু এখন কি আর কেবল ‘পুলিশ নিষ্ক্রিয়’- এই বলে দায় এড়িয়ে যাওয়া যায়?

পুলিশ বাহিনী এখন অনেক সময় রোদ-বৃষ্টি, উত্তেজনা-সংঘর্ষের সময় দায়িত্বের জায়গার পাশে নিরাপদ ছায়া খুঁজে বসে থাকে। মানুষের সামনে যেতে ভয় পায়। তবে, আমরা আগে যেমনটা বলতাম, আজও বলি: অন্তত একটি বিচার করুন। যদি একটি বিচারও হয়, তা বহু ‘যা খুশি তাই’ মানসিকতার গোড়ায় লাগাতে পারে লাগাম। এ দেশের মানুষ কত বছর ধরে ‘বিচার চাই, বিচার চাই’ বলে জিকির করছে- একটি বিচার কি এতটাই দূরবর্তী?

এই তো আমরা সম্ভাবনার মোড়ে দাঁড়িয়ে। এখানেই আত্মজিজ্ঞাসা জরুরি: আমরা কি ন্যায়বিচারের দিকে যেতে চাই? সে পথ সহজ নয়; কিন্তু এ পথেই মুক্তি। সহজ কাজ হচ্ছে, একত্রিত হয়ে কাউকে পিটিয়ে মারা; কিন্তু আইন ও মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিচার নিশ্চিত করা- এটাই কঠিন এবং এই কঠিন কাজের কারণেই তো গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল! অভিজিৎ রায় হত্যার পর তার বাবা অজয় রায় বলেছিলেন, ‘বিচার চাই না। মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’ কিন্তু বিচার হয়নি, শুভবুদ্ধির উদয়েরও দেখা মেলেনি। মানুষ যেন এক দানবীয় রূপ নিচ্ছে।

ফ্রয়েডের ভাষায়, মানুষ কেবল বেসিক ইন্সটিংক্ট দ্বারা পরিচালিত হয়ে পড়ছে, সুপার-ইগো চাপা পড়েছে। ফলে যে কোনো উত্তেজনায়, প্রতিহিংসায়, মানুষ আর মানুষ থাকছে না- পরিণত হচ্ছে এক হিংস্র ভোগবিলাসী সাইকোপ্যাথে। না, নিচ থেকে কিছু ওপরে যায় না। পরিবর্তন ঘটে উপরে।

আমরা এখনো আশা করি, উপরের সেই পরিবর্তন আসবে- যেটি ধীরে ধীরে নিচে ছড়িয়ে পড়বে। আর সে পরিবর্তনের শুরু হতে পারে- একটি বিচার দিয়ে।

পটিয়া থানার ওসি অপসারণের পর কি পুলিশ সদস্যরা এখন আইন প্রয়োগে কঠোর হতে পারবেন? যখন পুলিশ ব্যবস্থাকে নতুন করে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় তোলা হচ্ছে, তখন এমন একটি ঘটনা ভয়ংকর উদাহরণ হয়ে থাকবে। আগে পুলিশকে আওয়ামী লীগের তোয়াজে থাকতে হতো- এখন বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির ইচ্ছার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এটা নতুন কিছু নয়- পুরোনো বন্দোবস্তের নতুন সংস্করণ মাত্র। এমন রাজনৈতিক দ্বিচারিতা ও চাপ থাকলে কি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব?


এনসিপির কথা না শুনলে যদি সবাই ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ হয়ে যায়, তবে এনসিপির আচরণও সেই পুরোনো দলের মতোই হয়ে পড়ে। আজ অনেকেই বলছেন, জুলাই ২০২৪-এ যে গণতান্ত্রিক উত্তরণের সুযোগ তৈরি হয়েছিল, তা আমরা হাতছাড়া করেছি। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সামনে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ষড়যন্ত্র সবকিছু মিলিয়ে দিগন্তে শুধুই অন্ধকার। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ: দ্রুত একটি জবাবদিহিমূলক, স্থিতিশীল, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।

রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় না থাকলে মব জাস্টিস সক্রিয় হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নানা গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ‘জনরোষ’কে ব্যবহার করে। বাংলাদেশেও ঠিক তাই ঘটছে।

৫ আগস্টের পর মব জাস্টিস বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক মতাদর্শের দমন, প্রতিপক্ষকে শিক্ষা দেয়া, প্রতীক ভাঙচুর এবং পূর্বশত্রুতা। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে যে ‘বার্তা’ দেয়া হচ্ছে, তা অনেক সময় খুব দুর্বল, দ্ব্যর্থক। ফলে অনেকেই এসব ঘটনার বৈধতা দিতে শুরু করেছে- এটা ভয়ানক। তাই প্রশ্নগুলো সবার সামনে রাখতেই হয়:
* রাষ্ট্র কি সত্যিই মব জাস্টিস রোধে আন্তরিক?
* নাকি তারা বেছে বেছে কিছু গোষ্ঠীর সহিংসতা মেনে নিচ্ছে?
* প্রতিটি ঘটনায় কেন শুধু বিবৃতি আসে, বিচার নয়?
* আর মব যদি সরকারবিরোধীদের ওপর চড়ে বসে, তখনই কেবল পুলিশ তৎপর কেন?

এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব, যদি রাষ্ট্র মবের মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহস দেখায়। সেই সাহসিকতা শুরু হোক এই চারটি পদক্ষেপ দিয়ে:
* প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দ্রুত বিচার
* প্রশাসনকে দলনিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেয়া
* ‘জনরোষ’ ও ‘মব’-এর মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করা
* রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা ‘গৃহপালিত রাগ’ নির্মূল করা
আমরা বিচার চাই, প্রতিশোধ নয়। আমরা রাষ্ট্র চাই, ভিড়ের আইন নয়। রাষ্ট্র যদি এই মৌলিক সত্য ভুলে যায়, তবে একদিন ইতিহাস তাকেও ভুলে যাবে।

হাবীব ইমন: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। প্রেসিডিয়াম মেম্বার, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ