আল-জাজিরার বিশ্লেষণ
ইসরায়েল কেন ইরানে হামলা চালালো- আসল কারণ কী?
পঞ্চম দিনের মতো চলছে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত। অনেকে একে সরাসরি যুদ্ধ না বলে এখনো পর্যন্ত সংঘাতই বলতে আগ্রহী। পরিস্থিতির ভয়াবহতা কমাতেই বোধহয় এমন ইঙ্গিত। তা ছাড়া এখনো দুপক্ষের সেনাবাহিনী মাঠে নামেনি। যুদ্ধ চলছে আকাশ পথেই। আকাশে কার কত ক্ষমতা- তাই যেন দেখানোর পায়তারা করছে দুপক্ষ। সরাসরি যুদ্ধ শুরু না হলেও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছেই। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানা যায়, ইসরায়েলি বোমার আঘাতে ইরানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ২২৪ জন আর ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, ইরানের মিসাইলের আঘাতে এ পর্যন্ত ২৪ জন ইসরায়েলি মারা গেছেন। তার মানে সংঘাত যত বাড়বে, হতাহতের সংখ্যাও বাড়বে। কোথায় গিয়ে এর শেষ হয় আমরা এখনো জানি না; কিন্তু ইসরায়েল কেন আগ বাড়িয়ে হঠাৎ ইরানে হামলা চালালো? আল-জাজিরার বিশ্লেষণে জানা গেল তার আসল কারণ।
ইরানের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলে আসছেন যে, ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা প্রয়োজন ছিল। ইসরায়েলি জনসাধারণের কাছে বেশ কিছু যুক্তি সম্প্রচার করা হয়েছে; কিন্তু ইসরায়েলি সরকার কেন একতরফা, বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার প্রকৃত কারণ কেউই ব্যাখ্যা করেনি।
ইসরায়েলি সরকার দাবি করেছে যে, এই হামলাটি ছিল ‘প্রতিরোধমূলক’ অভিযান। উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট করে দেয়া। এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই বলে মনে হচ্ছে। কারণ ইসরায়েল হঠাৎ আক্রমণ করলেও অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আক্রমণের প্রস্তুতি তাদের দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। তারা জানত পাল্টা আক্রমণ আসবে এবং পাল্টা আক্রমণের সব প্রস্তুতিও তারা নিয়ে রেখেছে। হঠাৎ আক্রমণ করলে তারা এতটা প্রস্তুত থাকত না। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিরোধমূলক বা আগাম হামলা তখনই ন্যায্যতা পায়, যদি তা বাস্তব কোনো জরুরি হুমকি প্রতিহত করার কারণে হয়। ইরানের পক্ষ থেকে এমন কোনো হুমকি সম্প্রতি ছিল না। বরং একটা কারণ দর্শিয়ে ইসরায়েল আগ বাড়িয়ে ইরানে আক্রমণ করেছে। পরিস্কারভাবেই এটি সুপরিকল্পিত ও দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি নেয়া এক সামরিক অভিযান।
ইসরায়েল দাবি করেছে, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএএফএ) একটি প্রতিবেদন এই হামলার পক্ষে প্রমাণ সরবরাহ করেছে; কিন্তু বাস্তবে সেই প্রতিবেদনটিতে এমন কিছু উল্লেখ ছিল না। প্রতিবেদনে যা ছিল তা আগেই জানা ছিল। সেই রিপোর্টে ইরানের অতীত (২০০০ সালের আগ পর্যন্ত) পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও তা নতুন বা তাৎক্ষণিক হুমকি হিসেবে ধরা যায় না। আইএএফএ নিজেও ইসরায়েলের দাবিকে সমর্থন করেনি।
ইসরায়েল জানিয়েছে, এই হামলার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ‘সমূলে ধ্বংস করা’ বা ‘ডিক্যাপিটেশন’; কিন্তু নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করার সামর্থ্য ইসরায়েলের এককভাবে নেই। বাস্তবে তারা যে লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হেনেছে তাতেও বোঝা যায়, সম্পূর্ণ ধ্বংস নয়, বরং ইরানকে আংশিক দুর্বল করে তাদের পরিকল্পনা।
ইসরায়েলি বাহিনী শুধুমাত্র পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়নি। তারা আঘাত হেনেছে সামরিক ঘাঁটি, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, তেল ও গ্যাস ডিপোগুলোতে। এমনকি ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপরও। ইরানের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা আলী শামখানি এই হামলায় নিহত হয়েছেন বলে প্রথমে জানা গিয়েছিল। পরে জানা গেছে তিনি মারা যাননি। ইরান সরকার এখনো এ বিষয়ে স্পষ্ট করেনি।
শামখানি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে তার হত্যার মাধ্যমে ইসরায়েল কেবল একটি পরমাণু হুমকি নয়, বরং কূটনৈতিক সম্ভাবনাকেও চূর্ণ করেছে বলে অনেকেই মনে করছেন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, এই অভিযানের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল ইরানে পুরোনো নেতৃত্ব সরিয়ে দিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে চায়। তাদের ধারণা, নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যা করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। শামখানির মৃত্যু সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। বিশেষ করে তিনি যেহেতু ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ছিলেন, তার হত্যাকে একটি সুপরিকল্পিত কূটনৈতিক নাশকতা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
ইরানের ইসরায়েলি হামলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, ইরানের সামগ্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রকেই কাঁপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে ইসরায়েল। শুধু পরমাণু কর্মসূচি নয়, বরং প্রশাসনিক, সামরিক, কূটনৈতিক প্রতিটি স্তরে। পরমাণু কর্মসূচির ‘ডিক্যাপিটেশন’ নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশল। ইরানের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় ইসরায়েল। তাই এটিকে ‘নিউক্লিয়ার ডিক্যাপিটেশন’ না বলে বরং ‘রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও দুর্বলীকরণ’ বলাই যথার্থ। ইসরায়েল অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ইরানে হামলা চালিয়ে গণবিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে ইসরায়েল- এই ধরনের দাবি নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে চালানো এক ধরনের বাকোয়াজি ছাড়া আর কিছু নয় বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েল এসব কারণে ইরানে হামলা চালায়নি। তাহলে এই হামলার পেছনে কী কারণ ছিল?
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রক্রিয়ায় আছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইসরায়েলের দখলদারির বৈধতা নিয়ে যে রায় দেবে সেটিও অপেক্ষমাণ। এরই মধ্যে ইসরায়েল ও তার সেনাবাহিনী বহু হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। তারপর তারা তা অস্বীকার করেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের মিথ্যা বলার প্রমাণ ধরা পড়েছে।
এ কথা বলার সুযোগ নেই যে, ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নেয়া হয়েছে বরং, নেতানিয়াহু বহু বছর ধরেই এই হামলার পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। কেবল সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেই সময় এসে গেছে শুক্রবার। এটি এক প্রকার মরিয়া চেষ্টা। সেই চেষ্টা বিশ্বের দৃষ্টি আবার ইসরায়েলের দিকে ফেরানো এবং ইসরায়েলকে সেই অবস্থা ফিরিয়ে দেয়া যেখানে তারা সবকিছু করেও দায়মুক্ত থাকতে পারত।
ইরান এখনো বহু পশ্চিমা শক্তির চোখে একটি সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। ইসরায়েল যখন একতরফা ও প্রাণঘাতী হামলা চালায় তখন ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি থেকে শুরু করে হলোকাস্ট পর্যন্ত নানা পুরোনো যুক্তি সামনে আনা হয়। এই ধরনের চেনা বক্তব্যের সাহায্যে নেতানিয়াহু চেষ্টা করছেন সেই পুরোনো ‘স্ট্যাটাস কু’ বা অপরাধ করেও শাস্তি না পাওয়ার অবস্থা আবার প্রতিষ্ঠা করতে; যাতে ইসরায়েল আবারও যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে