Views Bangladesh Logo

ভোট, ব্যালট, ব্যঙ্গ: একটি গণতান্ত্রিক অনিশ্চয়তার প্রতিকৃতি

Habib Imon

হাবীব ইমন

বাংলাদেশের নির্বাচনি রাজনীতি এখন এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে সংবাদ পড়া আর কৌতুক শোনা প্রায় একই অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন কবে হবে? বলা যায় এ নিয়ে 'ট্যাগ অব ওয়ার' চলছে রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিএনপি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে। কেউ বলছেন, এগুলো রাজনৈতিক নাটক। কেউ বলছেন, এটি গণতন্ত্রের শেষ স্তবক। কিন্তু যেটাই বলা হোক না কেন, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একজন সাধারণ নাগরিকের মনে যা গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তা হলো: ভোটে কি আদৌ কিছু বদলায়?

পবিত্র ঈদুল আজহার আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১০ মাসে তার নেতৃত্বাধীন সরকারের নানাবিধ কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে সংস্কারের ফিরিস্তি তুলে ধরার পাশাপাশি এই সময়ের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও প্রত্যাশিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি মোটামুটি চূড়ান্ত সময়সীমার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, 'আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে।'

বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'এপ্রিল তত্ত্ব' এখন আর শুধু একটি তারিখ নয়- এটি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক কল্পনা, প্রতিশ্রুতি, শঙ্কা ও ব্যঙ্গের মিশ্র প্রতীক। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ‘৩০ এপ্রিলের মধ্যে সরকার পতন ঘটবে।’ কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। বরং সেই সময়টিকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জনমানসে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলস্বরূপ, সেই ‘ডেডলাইন রাজনীতি’ ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই অনেকেই ৩০ এপ্রিলকে তাচ্ছিল্যের সুরে ‘এপ্রিল ফুল’ বলে উল্লেখ করতে শুরু করেন।

তথ্যগত দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটিও এপ্রিল মাসে হয়নি। নির্বাচনের মাসগুলো ছিল মূলত- জানুয়ারিতে ২টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩টি, মার্চে ২টি, মে, জুন, অক্টোবরে ১টি করে এবং ডিসেম্বরে ২টি। অর্থাৎ, এপ্রিল এখনো একটি ‘অজানা’ নির্বাচনি মাস হিসেবে রয়ে গেছে।

তাই যদি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সত্যিই ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সেটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম “এপ্রিল নির্বাচন।” এটিকে শুধু একটি ক্যালেন্ডার রেকর্ড হিসেবে না দেখে রাজনৈতিক দিক থেকেও একটি প্রতীকী ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে- বিশেষত এমন এক সময়ে যখন ‘তারিখ’ বা ‘সময়সীমা’ ঘিরে রাজনৈতিক বিশ্বাস ও সংশয়ের মাঝে দোলাচল চলছে।

প্রতিটি নির্বাচন-পূর্ব সময় যেন এক আশার আঙিনা- নতুন নেতৃত্ব আসবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ হবে, পুরোনো ক্ষমতা চক্র ভেঙে নতুন চেহারা আসবে; কিন্তু বাস্তবতা বারবার প্রমাণ করছে- নির্বাচন কেবল পুরোনো নাটককে নতুন সাজে মঞ্চস্থ করারই একটি পর্ব মাত্র। কেবল নামের বদল, পোশাকের বদল- কিন্তু চরিত্র বদলায় না।

নতুন প্রতিশ্রুতি, পুরোনো অভিশাপ
বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুই প্রধান শক্তির হাতে বন্দি- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুপক্ষই গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু কার্যত একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করতেই যেন তৎপর। আওয়ামী লীগ একদিকে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতে চায়, বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনমনে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের আভাস দিতে চায়; অপরদিকে বিরোধী দল দমন করে, কণ্ঠরোধ করে এবং রাতের আঁধারে নির্বাচন সম্পন্ন করে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী বাস্তবতা গড়ে তোলে।

অন্যদিকে বিএনপি নিজেদের 'আপসহীন' বললেও, দলটির নেতৃত্ব কাঠামো ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বিশেষত, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করে রাজনীতি পরিচালনা করছেন- যা এক ধরনের 'ছায়া নেতৃত্ব'-এর বাস্তবতা তৈরি করেছে। এর ফলে গণতন্ত্রের বদলে ‘দলতন্ত্র’ দৃশ্যমান হয়- যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বদলে এককেন্দ্রিক সিদ্ধান্তই মুখ্য হয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক 'লন্ডন সংলাপ', ইউনূস-তারেক ঘনিষ্ঠতা নিয়ে গুঞ্জন, বিভ্রান্তিকর বিবৃতি এবং জুলাই সনদ নিয়ে যেসব গুজব ছড়িয়েছে- সেগুলোকে আর পাঁচটা নির্বাচনপূর্ব কৌশলগত বিশৃঙ্খলা হিসেবে দেখা যাচ্ছে না। বরং অনেক বিশ্লেষকের কাছে এটি এক নতুন বাস্তবতা- যেখানে উদ্দেশ্য নির্বাচন নয়, বরং রাজনীতির কাঠামো বা ডিজাইন বদলে ফেলা। এবং এই রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রয়াসের পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক বিদেশি স্বার্থ- ভূরাজনীতি, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক হেজমনি, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যও এতে অন্তর্ভুক্ত।

সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি বড় পারসেপশন এখন কাজ করছে যে, "নির্বাচন হলেই বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে।" কিন্তু আদতে কি সত্যিই তা-ই হবে? বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে বারবার বলে আসছেন, "আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে", তার পেছনে কি কোনো অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা বা কৌশলগত হিসাব আছে?

এই প্রশ্নগুলো আজ রাজনৈতিক বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দুতে।
▪︎ বিএনপি কি এককভাবে সরকার গঠন করবে, নাকি কোয়ালিশন সরকারের দিকে যাবে?
▪︎ যদি তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তবু কি ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’ গঠনের চেষ্টা হবে?
▪︎ সেই সরকারে জামায়াতে ইসলামি, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং অন্যান্য ইসলামপন্থি বা নতুন উদীয়মান দলগুলো যুক্ত হবে কি?
▪︎ যদি এমন হয়, তাহলে বিরোধী দলে কারা থাকবে? আওয়ামী লীগ নাকি একটি নতুন “তৃতীয় শক্তি”?
বাংলাদেশের রাজনীতি এই মুহূর্তে ঠিক নির্বাচনি প্রক্রিয়ার মধ্যে নেই- বরং এটি প্রবেশ করেছে এক কাঠামোগত উত্তরণ পর্বে, যেখানে চেনা নেতৃত্বের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে অদৃশ্য ঐক্য, বিদেশি হিসাব এবং অভ্যন্তরীণ ছায়া-কৌশল।

গণতন্ত্র যদি সত্যিই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়, তবে এই ছায়ানীতির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসাই এখন সবচেয়ে জরুরি চ্যালেঞ্জ।

নবীন মুখ, পুরোনো নীরবতা
যখন প্রধান দুই শক্তির ওপর জনআস্থা কমতে থাকে, তখন রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করতে উদ্যত হয় নতুন দল ও নবীন রাজনীতিকেরা। এনসিপি সেই ধরনের এক আশাজাগানিয়া নাম হয়ে এসেছিল। বলা হয়েছিল, এই দল তারুণ্যের প্রতিনিধি হবে, নারীর নিরাপদ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে, এবং পুরোনো রাজনীতির সংস্কার ঘটাবে। কিন্তু সামান্য সময়ের মধ্যেই দেখা গেল- এই ‘নতুন’ দলের গায়ে পুরোনো ভাঁজ। অভিজ্ঞতার অভাব, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, দলীয় আচরণবিধির লঙ্ঘন, এমনকি নারী সহকর্মীর প্রতি অসম্মান- সব মিলিয়ে তারা মানুষের বিশ্বাস ভেঙেছে।

দলের একজন নেতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে এমন মন্তব্য করলেন, যা মানুষের মনে তৈরি করল নিদারুণ হতাশা: “আমরা আসলে খুব বেশি আলাদা কিছু নই।”

ইতোমধ্যে এনসিপির কয়েকজন নেতার ব্যয়বহুল জীবনযাপনের অভিযোগ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কিছু ক্ষেত্রে তারা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। সেই ব্যাখ্যা কতটা গ্রহণযোগ্য, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। অন্যদিকে প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার বাইরে গিয়ে তারা ঠিক কী করেছেন, তার কোনো নিদর্শন এখন পর্যন্ত মেলেনি।

রাজনীতি যখন 'ব্যতিক্রম' হওয়ার কথা বলে 'সাধারণ' হওয়ার প্রমাণ দেয়, তখন মানুষ কেবল বিশ্বাস হারায় না- প্রতারণাবোধে ক্ষুব্ধ হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম: ব্যালটের প্রতিপক্ষ এক সময় দেয়াললিখনে প্রকাশ পেত জনগণের আশা, অভিযোগ ও প্রতিবাদ। এখন তার জায়গা নিয়েছে ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার)। নির্বাচনের মাঠ এখন যতটা না রাস্তায়, তার চেয়েও বেশি ভার্চুয়াল মিডিয়ায়। এখানে মানুষ নিজের মতামত বলছে, ট্রল করছে, ব্যঙ্গ করছে- এবং আশ্চর্যজনকভাবে সেখানেই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে জনমত। তরুণরা ‘ভোট’ শব্দটির সঙ্গে রসিকতা করছে, কেউ বলছে: “ভোট মানেই সেই মোজাটা পরা, যেটা ফুটো কিন্তু অন্যটার চেয়ে একটু কম দুর্গন্ধযুক্ত।

এই ব্যঙ্গ কিন্তু নিছক কৌতুক নয়- এটা নাগরিক রাগ, হতাশা ও রাজনৈতিক বঞ্চনার এক গভীর প্রতিবাদ। রাষ্ট্র যদি ভোটারকে শ্রদ্ধা না করে, তবে ভোটারও রাষ্ট্রকে ভয় পায় না- এটাই নতুন বাস্তবতা। কৌতুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভয় আমরা যদি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো রসিকতার মধ্য দিয়ে নিজের রাজনৈতিক ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করি, তাহলে বাংলাদেশেও এখন সেই ধারা শুরু হয়ে গেছে। দুই জোড়া মোজার মধ্যে একটাতে ফুটো, অন্যটায় রঙের অসংগতি- এই দুটি অপশন থেকে ভোটারকে নির্বাচন করতে বলা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি- “দুর্নীতি শেষ করব, পেনশন বাড়াব”- নির্বাচনের পর পরিণত হয়: “আমি শেষ করে দেব।” গণতন্ত্র তখনই ব্যর্থ হয়, যখন মানুষ আর ভোটে হাসে না- হাসে ভোট নিয়ে। রাজনীতি তখনই পচে যায়, যখন মানুষ ভোটে অংশ নেয় শুধু সামাজিক অনুষঙ্গ হিসেবে- বাস্তবতা বদলানোর জন্য নয়, বরং হতাশা প্রকাশ করার একটা আচার পালন করার জন্য।

যখন সংস্কার শব্দটি ম্লান হয়ে যায়
আমরা বলি, সংস্কার দরকার। কিন্তু সংস্কারের নামে যখন নতুনরা পুরনোদের নকল করে, তখন সেই সংস্কার এক খণ্ড নাটক হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে নিজেদের অনেকখানি নিঃশেষ করে ফেলেছে। কিন্তু তার জায়গায় যাদের মানুষ দেখতে চায়, তাদের আচরণ দেখলে ভয় হয়- “এরা এলেই যদি পুরোনো স্বৈরতন্ত্রের নতুন চেহারা ফেরে?”
জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে আশঙ্কা পুরোনো, কিন্তু নতুন করে সে আশঙ্কা আবার তৈরি হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি ধরনের একটি সম্ভাব্য ত্রিমুখী জোট ঘিরে। এই সব জোটের পেছনে কোনো আদর্শ নেই- শুধু ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারা।

পথ কী তবে কেবলই অনিশ্চয়তা?
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেই যায়- আমরা ভোট দিতে যাব কেন? ব্যালট বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে যদি মনে হয়- এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কিছুই বদলাবে না, তাহলে সেই ভোট কি এক রকম অপমান নয়? ভোট যদি কেবল এক ‘আনুষ্ঠানিকতা’ হয়- তাহলে সেটা গণতন্ত্র নয়, সেটি গণবিচ্ছেদ জনগণ চায় নেতৃত্ব, গঠনমূলক বিতর্ক, ভবিষ্যতের দিশা। তারা বেছে নিতে চায় না মোজার দুটি খারাপ জোড়া। তারা জানতে চায়- এই দেশের প্রকৃত মালিক কে? তারা চায়- রাজনীতি হোক এমন এক চর্চা, যেখানে তারা নিজেকে বোঝে, পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, আত্মমর্যাদা খুঁজে পায়।
পচে যাওয়া গণতন্ত্র, অথবা জেগে ওঠা মানুষ?

তারচেয়েও বড় প্রশ্ন, গত ১০ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের যে পারফরম্যান্স, দেশের সর্বত্র যে বিশৃঙ্খলা, এখনও বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন গোষ্ঠী যেভাবে মব সৃষ্টি করতে পারছে; সেনাবাহিনী বিচারিক ক্ষমতাসহ মাঠে থাকার পরেও জনমনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা যেহেতু এখনও একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে- ফলে এই সরকার কি শেষ পর্যন্ত একটি অবাধ-সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ-প্রভাবমুক্ত-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে? এরকম অজস্র প্রশ্ন মানুষের মনে আছে- এ কথায় যার কোনো উত্তর নেই।

তা ছাড়া অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কোনো আগাম মন্তব্য করা কঠিন। কেননা, শেখ হাসিনার মতো একজন প্রবল ক্ষমতাধর শাসকের যে অভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটবে, সেটি গত বছরের ৫ আগস্ট ভোরেও হয়তো দেশের অধিকাংশ মানুষ ধারণা করেনি। সুতরাং আগামী এপ্রিলেই নির্বাচন হবে কি না বা এপ্রিলের আগে দেশে আরও কী কী ঘটবে- তা এখনই বলা কঠিন।

এই অবস্থার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা বুঝতে গেলে কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়: একটি সরকার, যে কিনা গণ-আন্দোলনের চাপে গঠিত, তার মূল দায়িত্ব তো হওয়া উচিত ছিল- একটি বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন। অথচ বাস্তবতা ঠিক উলটো। জনজীবনে অস্থিরতা, স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচির ওপর দমন-পীড়ন, এবং গণতন্ত্রমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল উপস্থিতি- এই সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মনে এক গভীর হতাশা জন্ম নিচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ন্যূনতম সাফল্য হলো- ক্ষমতার একটি শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। কিন্তু সেই সম্ভাবনা যদি অকার্যকর প্রমাণিত হয়, কিংবা সেই হস্তান্তর যদি আবার একচেটিয়া প্রহসনে পর্যবসিত হয়- তাহলে বর্তমানের রাজনৈতিক সংকট অতীতের চেয়ে ভয়াবহ রূপ নেবে।

সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্ত অবস্থানে থাকলেও জনমনে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজমান। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী মাঠে থাকা সত্ত্বেও, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি নিয়ে যেমন সন্দেহ রয়েছে, তেমনি সরকারের ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা’ নিয়ে আছে প্রশ্ন। বিচারিক ক্ষমতা থাকার পরও যেভাবে জনমনে স্বস্তির অভাব দেখা দিয়েছে, তা এক গভীর আস্থার সংকেত।

এমনকি সরকারের কিছু আচরণ জনমনে নতুন করে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। যেমন- কোনো কোনো ‘অন্তঃস্থ নীতিগত দ্বন্দ্ব’, বিদেশি কূটনৈতিক তৎপরতা, কিংবা ভেতরে ভেতরে সক্রিয় থাকা সামরিক সংযম- এসব বিষয় জনগণের সামনে অর্ধেক প্রকাশিত, অর্ধেক গুজব। ফলে রাজনৈতিক আলোচনায় যুক্তি নয়, কল্পনা প্রবল হয়ে উঠছে। এসব প্রেক্ষাপটে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কেবল প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতারও একটি কঠিন পরীক্ষা।

অন্যদিকে, যারা বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের মধ্যেও লক্ষণীয় ঐক্যহীনতা, কৌশলগত দুর্বলতা ও এক ধরনের ‘নেতৃত্বহীন সাহস’। ফলে সাধারণ জনগণের একাংশ হতাশ হয়ে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, আরেক অংশ অপেক্ষা করছে- আরো বড় কিছু ঘটার।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি এক ভয়ের গল্প- যেখানে চরিত্রগুলো দুর্বল, সংলাপগুলো ভাঙা, আর দর্শক ক্লান্ত। কিন্তু এই কাহিনির শেষ কী? একটি জাতি কি কেবল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে ডুবে যাবে? নাকি একদিন- হঠাৎ- জেগে উঠবে কোনো বিকল্প শক্তি, নতুন চেতনা, এবং বলবে- আমরা আর হাসতে আসিনি, এবার আমরা বলবো- ‘না’? এই ‘না’ যদি সত্য হয়- তাহলে গণতন্ত্র আবার পথ পাবে।

হাবীব ইমন: রাজনৈতিক বিশ্লেষক; প্রেসিডিয়াম মেম্বার, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ