Views Bangladesh Logo

চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-১৫

ফ্যাবলেস বিপ্লব

Mahmud  Hossain

মাহমুদ হোসেন

কসময় সিলিকন ভ্যালিতে একটি প্রবাদ খুব প্রচলিত ছিল: ‘রিয়েল ম্যান হেভ ফ্যাবস’ - অর্থাৎ, সত্যিকারের সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি তারাই, যাদের নিজস্ব ফ্যাব্রিকেশন (ফ্যাব) প্ল্যান্ট বা কারখানা আছে। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে, এক নতুন প্রজন্মের হাত ধরে এই ধারণাটি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এই উদ্যোগীরা নিজেরা চিপ ডিজাইন করতেন, কিন্তু উৎপাদনের কাজটি আউট সোর্স করতেন, যার প্রধান অংশীদার ছিল টিএসএমসির মতো কোম্পানি। এই নতুন জন্ম নেয়া ব্যবসায়িক মডেলের নাম হলো ‘ফ্যাবলেস মডেল’।

১৯৮৪ সালে গর্ডন ক্যাম্পবেল ও দাদো বানাতাও মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘চিপস অ্যান্ড টেকনোলজিস’, যাকে প্রথম ফ্যাবলেস কোম্পানি হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেকেই তখন এটিকে সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি বলতে দ্বিধা করত, কারণ তাদের নিজস্ব কোনো ফ্যাব ছিল না। তবে এই কোম্পানির ডিজাইন করা গ্রাফিক্স চিপগুলো বাজারে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে, যা বড় বড় কোম্পানির পণ্যের সঙ্গেও পাল্লা দিতে শুরু করে। পরবর্তীতে ইন্টেল কোম্পানিটিকে কিনে নেয়। কিন্তু ততদিনে তারা প্রমাণ করে ফেলেছিল যে, একটি ভালো ব্যবসায়িক ধারণার সাথে কয়েক মিলিয়ন ডলার মূলধন থাকলেই ফ্যাবলেস মডেলে সফল হওয়া সম্ভব।

সেই সময় কম্পিউটার গ্রাফিক্স সেমিকন্ডাক্টর স্টার্ট-আপদের জন্য এক আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। কারণ মাইক্রোপ্রসেসরের বাজারে যখন ইন্টেল ও এএমডি-র একচ্ছত্র দাপট, সেখানে গ্রাফিক্স চিপের জগত কারও নিয়ন্ত্রণে ছিল না। নতুন নতুন ফাউন্ড্রির আবির্ভাব এবং স্টার্ট-আপের খরচ কমে যাওয়ায় সাধারণ উদ্যোগীরাও এই প্রতিযোগিতায় নামার সুযোগ পাচ্ছিল।

এই গুরুত্বপূর্ণ সময়েই, ১৯৯৩ সালে তিনজন তরুণ প্রকৌশলী - ক্রিস মালাখাউস্কি, কার্টিস প্রিয়েম ও জেনসেন হুয়াং- জন্ম দিলেন এনভিডিয়া নামের এক কোম্পানির। এদের মধ্যে জেনসেন হুয়াং পরবর্তীতে সবচেয়ে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন এবং কোম্পানিটির সিইও-এর দায়িত্ব নেন। তাইওয়ানে জন্ম নেয়া হুয়াং ছোটবেলায় আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন। তিনি সব সময় কালো জিন্স, কালো শার্ট ও লেদার জ্যাকেট পরেন এবং ভবিষ্যতের প্রযুক্তি সম্পর্কে স্টিব জবস-এর মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হিসেবে পরিচিত।

এনভিডিয়া শুরু করেছিল ভিডিও ও গেমিং কোম্পানিগুলোর জন্য চিপ তৈরি করে। তখন পিসির জগত ছিল প্রায় সম্পূর্ণ দ্বিমাত্রিক (2D)। এনভিডিয়া বুঝতে পারল, ভবিষ্যতের গ্রাফিক্সের দুনিয়া হবে ত্রিমাত্রিক (3D)। তারা তৈরি করল গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট (GPU)—এমন একধরনের চিপ যা একই সাথে হাজার হাজার গণনা সমান্তরালে চালাতে পারত এবং যা ইমেজ তৈরির জন্য উপযোগী। তাদের GPU শুধু গ্রাফিক্সের জন্য নয়, সমান্তরাল গণনার জন্যও ব্যবহৃত হতে শুরু হলো। এভাবে এনভিডিয়া নতুন এক বিশাল বাজার আবিষ্কার করে এবং খুব দ্রুতই এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভিত্তি হয়ে ওঠে এই GPU।

আজ এনভিডিয়ার চিপ প্রায় সব বড় ডেটা সেন্টারে ব্যবহৃত হয় এবং এগুলোর উৎপাদন করে টিএসএমসি। যদি এনভিডিয়াকে নিজের ফ্যাব বানাতে হতো, তাহলে এত দ্রুত এগোনো সম্ভব হতো না, কারণ একটি ফ্যাব তৈরি করতেই শত শত মিলিয়ন ডলার লাগে।

এদিকে, আরেক উদ্ভাবক আর্ভিন জ্যাকবস তখন ভাবছিলেন, মাইক্রোপ্রসেসর-এর ভবিষ্যৎ এখন মোবাইল ফোনে। তিনি ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কোয়ালকম, যার নামটি নেয়া হয়েছিল কোয়ালিটি কমিউনিকেশনস থেকে। তখন মোবাইল ফোন মানে ছিল বড়, ভারী, গাড়িতে লাগানো সেট। ২জি প্রযুক্তির পথে সবাই কাজ শুরু করেছিল।

কিন্তু জ্যাকবস প্রস্তাব করলেন ভিন্ন এক প্রযুক্তি CDMA, যেখানে কলের ডেটা বারবার ফ্রিকোয়েন্সি বদলে পাঠানো হবে, ফলে একসাথে অনেক কল সম্ভব হবে। অনেকেই ভাবল এটা বাস্তবে অসম্ভব। জ্যাকবস প্রমাণ করতে মাঠে নেমে গেলেন, কয়েকটি সেল টাওয়ার বসিয়ে ছোট নেটওয়ার্ক তৈরি করে দেখালেন যে এটা কাজ করে। এভাবেই CDMA প্রযুক্তির জন্ম হয়, যা পরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

কোয়ালকম প্রতিটি প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তিতে নতুন উদ্ভাবন এনেছে, রেডিও স্পেকট্রামকে আরও দক্ষতার সাথে ব্যবহার করার উপযোগী চিপ তৈরি করেছে, যা ছাড়া আধুনিক স্মার্ট ফোন সম্ভব নয়। তারা নিজস্ব চিপ ডিজাইন করে, কিন্তু উৎপাদন করে না-সেই কাজটি করে টিএসএমসি বা স্যামসাং-এর মতো ফাউন্ড্রি। কোয়ালকমের পেটেন্ট এত গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো ফোন তাদের প্রযুক্তি ছাড়া তৈরি করা যায় না।

অনেকে বলে থাকেন, সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন বাইরে (আফশোরে) চলে যাওয়া আমেরিকার জন্য এক ক্ষতি। কিন্তু কোয়ালকম বা এনভিডিয়ার মতো কোম্পানিগুলো টিকে থাকতই না যদি তাদের ফ্যাব তৈরিতে বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হতো। তারা তাদের আসল দক্ষতার জায়গায়- ডিজাইন, অ্যালগরিদম ও উদ্ভাবনে- মন দিতে পেরেছিল, কারণ উৎপাদনের কাজটি অন্যেরা করে দিচ্ছিল।

‘ফ্যাবলেস মডেল’ শুধু এই দুই কোম্পানিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আরও অনেক মার্কিন প্রতিষ্ঠানও ফাউন্ড্রির ওপর নির্ভর করত। শেষ পর্যন্ত এই মডেল শুধু উৎপাদন পদ্ধতি পাল্টায়নি, এটি পুরো কম্পিউটিংয়ের দুনিয়াকেই বদলে দিয়েছে। মোবাইল ফোন, উন্নত গ্রাফিক্স আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা - এই সবকিছুর পেছনে রয়েছে সেই ফ্যাবলেস বিপ্লব, যেখানে মেধা ও উদ্ভাবন ছিল কেন্দ্রবিন্দু, আর কারখানা ছিল অন্যের হাতে।

(ক্রিস মিলারের সাড়াজাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ৩৬তম অধ্যায় ‘দ্য ফ্যাবলেস রেভুল্যুশন’ থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)

লেখক পরিচিতি
মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসি’র কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ