Views Bangladesh Logo

চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-১২

চীনের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের শুরু

Mahmud  Hossain

মাহমুদ হোসেন

৯৮৭ সালে এশিয়ায় জন্ম নিল দুটি ভিন্ন স্বপ্ন। তাইওয়ানের মরিস চ্যাং লক্ষ্য নিলেন TSMC নামে একটি কোম্পানি গড়ার যা বিশ্বের সেরা চিপ তৈরি করবে। একই সময় চীনের শেনজেনে রেন ঝেংফেই শুরু করলেন হুয়াওয়ে, একটি ছোট্ট ব্যবসা যা হংকং থেকে সস্তা টেলিকম সরঞ্জাম কিনে চীনের বাজারে বিক্রি করত।

তাইওয়ান ছোট হলেও প্রযুক্তিতে ছিল অনেক এগিয়ে। সিলিকন ভ্যালির সঙ্গে তাদের ছিল গভীর সম্পর্ক। স্ট্যানফোর্ড ও বার্কলি থেকে অনেক ইঞ্জিনিয়ার দেশে ফিরে আসতেন বিশাল স্বপ্ন নিয়ে। মরিস চ্যাং শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে তাকালেন, আমেরিকান গ্রাহক টানার এবং চিপ উৎপাদনে দক্ষতা অর্জনের কৌশল নিলেন।

এদিকে চীনের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশাল জনসংখ্যা থাকলেও প্রযুক্তিতে তারা ছিল অনেক পিছিয়ে। তাদের সেরা চিপগুলো ছিল ১৯৭০-এর দশকের ইন্টেলের প্রাথমিক চিপের মতোই- বিশ্বমানের চেয়ে এক দশকেরও বেশি পিছিয়ে।

একটা সময় চীনেরও সম্ভাবনা ছিল। ১৯৫০-৬০-এর দশকে তারা বিজ্ঞানী তৈরি করল, ট্রানজিস্টর রেডিও বানাল এবং ১৯৬৫ সালে প্রথম ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট তৈরি করল- আমেরিকার মাত্র পাঁচ বছর পর; কিন্তু মাও সেতুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লব সবকিছু তছনছ করে দিল। স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেল, বিজ্ঞানীদের গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হলো এবং বিদেশি প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করা হলো।

এরই মধ্যে হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরে ফেয়ারচাইল্ড ও টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসের মতো মার্কিন কোম্পানিগুলো কারখানা খুলল। এখানকার শ্রমিকরা কাজ শিখে দক্ষ হয়ে উঠল আর চীন ক্রমেই পিছিয়ে পড়ল। ১৯৭৫ সালে চীনা কর্মকর্তারা স্বীকার করলেন, ‘আমাদের তৈরি ১০০০ সেমিকন্ডাক্টরের মধ্যে মাত্র একটি মানসম্মত।’ সেই বছর নোবেলজয়ী পদার্থবিদ জন বার্ডিন বেইজিং সফরে এসে দেখলেন, এখানে মেধা আছে; কিন্তু সমাজ খুবই রক্ষণশীল। ১৯৭৯ সালে পুরো চীনে মাত্র ১ হাজার ৫০০টি কম্পিউটার ছিল।

১৯৭৬ সালে মাওর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় এলেন দেং শিয়াওপিং। তিনি ‘চারটি আধুনিকীকরণ কর্মসূচি’ শুরু করলেন, যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পেল। ১৯৭৮ সালের এক বিজ্ঞান সম্মেলনে চিপ উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দেয়া হলো। ১৯৮০-এর দশকে সরকারের স্লোগান ছিল- ‘প্রথমে আমদানি, পরে দেশে উৎপাদন, শেষে রপ্তানি।’ কিন্তু দুর্বল দক্ষতা আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তেমন কোনো অগ্রগতি হলো না। চীনের ইলেকট্রনিক শিল্প তখনো বিদেশি চিপের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল।

এই সময়েই মঞ্চে এলেন রিচার্ড চ্যাং। ১৯৪৮ সালে নানজিংয়ে জন্ম নেয়া এই খ্রিষ্টান উদ্যোক্তা তাইওয়ানে বড় হয়েছেন এবং টেক্সাসে পড়াশোনা করেছেন। তার স্বপ্ন ছিল চীনে আধুনিক চিপশিল্প গড়ে তোলা। টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসে কাজ করার সময় তিনি চিপের সহ-আবিষ্কারক জ্যাক কিলবির সঙ্গেও কাজ করেছিলেন।


২০০০ সালে চ্যাং বেইজিংকে একটি আধুনিক চিপ কারখানা বানানোর জন্য রাজি করালেন। তিনি সাংহাইয়ে SM C (সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন) প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি ১.৫ বিলিয়ন ডলারের পুঁজি জোগাড় করলেন, যার অর্ধেক এসেছিল আমেরিকান বিনিয়োগকারী গোল্ডম্যান স্যাক্স ও মোটোরোলার কাছ থেকে। ২০০১ সালের মধ্যে SM C-এ এক হাজারের বেশি ইঞ্জিনিয়ার ছিল, যাদের এক-তৃতীয়াংশ বিদেশি। কোম্পানির মূলনীতি ছিল- ‘একজন পুরোনো কর্মী দুজনকে প্রশিক্ষণ দেবে’, যার ফলে দ্রুত দক্ষতা ছড়িয়ে পড়ল।

SMIC সরকারি কর ছাড় ও ভর্তুকি পেলেও, রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপর ভরসা না করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে জোর দিল। ২০০০-এর দশকের শেষ দিকে তারা বিশ্বসেরা কোম্পানিগুলোর চেয়ে মাত্র দুই বছর পিছিয়ে ছিল। টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস থেকে অর্ডার পেল এবং ২০০৪ সালে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হলো।

এদিকে বিশ্বজুড়ে বড় পরিবর্তন আসছিল। ১৯৯০ সালে আমেরিকান কারখানাগুলো ৩৭ শতাংশ চিপ তৈরি করত, ২০০০ সালে তা কমে ১৯ শতাংশ এবং ২০১০-এ মাত্র ১৩ শতাংশ হলো। জাপানও পিছিয়ে পড়ল। নতুন নেতৃত্ব চলে এল এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং সিঙ্গাপুরে। ১৯৯২ সালে স্যামসাং জাপানকে ছাড়িয়ে শীর্ষ মেমরি চিপ নির্মাতা হলো। তারা কখনোই বিনিয়োগ থামায়নি, তাই বাজারে তাদের আধিপত্য বজায় থাকল।

চীন তখন বিশ্বের ইলেকট্রনিক্স অ্যাসেম্বলির কেন্দ্রবিন্দু। কোটি কোটি ডিভাইস সেখানে তৈরি হতো, যেগুলোতে চিপের প্রয়োজন ছিল। SMIC-এর মাধ্যমে চীন অবশেষে নিজস্ব চিপ তৈরির সুযোগ পেল। পূর্ব এশিয়ার ভর্তুকিপ্রাপ্ত চিপ কারখানাগুলো উৎপাদন খরচ কমিয়ে দিল যা মার্কিন ফ্যাবলেস কোম্পানিগুলোর জন্য সুবিধাজনক হলো। এই কোম্পানিগুলোই পর স্মার্টফোন বিপ্লব শুরু করল।

বিশ্বায়নের ঢেউয়ে যা হওয়ার কথা ছিল, ঠিক তাই হলো- উৎপাদন খরচ কমে এল, বাজারে প্রতিযোগিতা তীব্র হলো আর এর ফলস্বরূপ গ্রাহকদের হাতে পৌঁছানো ডিভাইসগুলো আরও সস্তা হয়ে গেল। রিচার্ড চ্যাংয়ের কাছে এর অর্থ ছিল আরও গভীর। তার বিশ্বাস-প্রণোদিত স্বপ্ন অন্তত কিছুটা হলেও চীনে বিশ্বমানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বীজ রোপণ করেছে।

(ক্রিস মিলারের সাড়া জাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ৩০তম ও ৩১তম অধ্যায় থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)

লেখক পরিচিতি:
মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ