Views Bangladesh Logo

চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-১১

সেমিকন্ডাক্টরে তাইওয়ানের উত্থান এবং টিএসএমসির জন্ম

Mahmud  Hossain

মাহমুদ হোসেন

১৯৮৫ সালের এক দুপুরে তাইওয়ানের প্রভাবশালী মন্ত্রী কে টি লি তার অফিসে আমন্ত্রণ জানালেন মরিস চ্যাংকে। প্রায় দুই দশক আগে লি-ই টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাইওয়ানে প্রথম চিপ ফ্যাক্টরি খুলতে রাজি করিয়েছিলেন; কিন্তু এবার তিনি আরও বড় কিছু চাইছিলেন। চ্যাংয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি সরাসরি বললেন, ‘আমরা চাই তাইওয়ানে একটা সেমিকন্ডাক্টর শিল্প গড়ে উঠুক। বলুন, এ জন্য কত টাকা দরকার?’

তখনো ‘গ্লোবালাইজেশন’ শব্দটি এতটা জনপ্রিয় ছিল না; কিন্তু তাইওয়ান ১৯৬০-এর দশক থেকেই এই শিল্পে পরিকল্পিতভাবে প্রবেশ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশের মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা, উন্নত প্রযুক্তি আয়ত্ত করা এবং আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করা।

তখন তাইওয়ানে মূলত বিদেশি চিপ আমদানি করে টেস্টিং ও প্যাকেজিং করা হতো। তাইওয়ানে প্রচুর কাজ থাকলেও আসল মুনাফা চলে যেত বিদেশি কোম্পানিগুলোর পকেটে। কারণ, উন্নত চিপ ডিজাইন ও তৈরির মাধ্যমেই আসত সবচেয়ে বেশি লাভ। লি বুঝতে পারছিলেন, শুধু অ্যাসেম্বলিং করে তাইওয়ানের অর্থনীতিকে আর বেশিদূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।

তখন এশিয়ায় সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে প্রতিযোগিতা ছিল তুঙ্গে। ১৯৬৮ সালে চ্যাং যখন প্রথম তাইওয়ান যান, দেশটি তখন হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছিল। ১৯৮০-এর দশকে স্যামসাং ও দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যান্য বড় কোম্পানি উন্নত মেমরি চিপে বিশাল বিনিয়োগ শুরু করে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াও এগিয়ে যেতে চাইছিল; কিন্তু খুব বেশি সফল হতে পারছিল না। টিকে থাকতে হলে তাইওয়ানকে দ্রুত নিজেদের উন্নতি করতে হতো।

এর মধ্যেই এলো চীনের চ্যালেঞ্জ। ১৯৭৬ সালে মাও সে তুংয়ের মৃত্যুর পর চীন তার অর্থনীতি উন্মুক্ত করে দেয়। সস্তা শ্রম ও বিপুল কর্মীর কারণে তারা ইলেকট্রনিকস অ্যাসেম্বলিংয়ে তাইওয়ানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াল। দামের দিক থেকে চীনের সঙ্গে পাল্লা দেয়া অসম্ভব ছিল। তাই উন্নত প্রযুক্তির দিকে যাওয়াই ছিল তাইওয়ানের জন্য একমাত্র পথ।

এই সংকটময় মুহূর্তে লি আবারও মরিস চ্যাংয়ের কাছে গেলেন। ওদিকে চ্যাং টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসে দুই দশকেরও বেশি সময় কাটিয়েছিলেন; কিন্তু সিইও হতে না পারার ক্ষোভে তিনি চাকরি ছেড়ে নিউইয়র্কের জেনারেল ইনস্ট্রুমেন্টসের প্রধান হয়েছিলেন। সেখানেও তিনি খুশি ছিলেন না। ৫৪ বছর বয়সে তিনি নতুন কোনো চ্যালেঞ্জ খুঁজছিলেন। তাইওয়ান যখন তাকে পুরো শিল্প গড়ার দায়িত্ব এবং একটি ‘ব্ল্যাংক চেক’ দিল, তিনি রাজি হলেন।

চ্যাংয়ের পরিকল্পনা ছিল একেবারেই ভিন্ন। তিনি এমন একটি কোম্পানি গড়তে চাইলেন যা শুধু চিপ তৈরি করবে; কিন্তু নিজেদের কোনো ডিজাইন থাকবে না। তখন টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস, ইন্টেল, মটোরোলার মতো বড় সব কোম্পানি একই সঙ্গে চিপ ডিজাইন ও ম্যানুফ্যাকচারিং দুটিই করত। চ্যাং ১৯৭৬ সালে টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসকে এই ‘ফাউন্ড্রি মডেল’-এর প্রস্তাব দিয়েছিলেন; কিন্তু কোম্পানি তা নাকচ করে দেয়। ১৯৮০-এর দশকে নতুন ডিজাইন পদ্ধতি এসে ডিজাইন ও ম্যানুফ্যাকচারিংকে আলাদা করা আরও সহজ করে তোলে। তাই যখন সুযোগ এলো, চ্যাং আবার তার স্বপ্নকে সামনে নিয়ে এলেন।

মন্ত্রী লি তার কথা রাখলেন। সরকার নতুন কোম্পানির মূলধনের ৪৮ শতাংশ বিনিয়োগ করল, এই শর্তে যে, বিদেশি কোনো অংশীদার আনতে হবে। চ্যাং টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস ও ইন্টেলের সঙ্গে কথা বললেন, কিন্তু তারা তাকে ফিরিয়ে দিল। ইন্টেলের গর্ডন মুর তো বলেই দিলেন, ‘মরিস, তুমি অতীতে চমৎকার কিছু আইডিয়া দিয়েছ। তবে এটা তেমন কিছু নয়।’ শেষ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসের ফিলিপস এগিয়ে এলো- তারা ৫৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করল, প্রযুক্তি দিল এবং ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার নিল। বাকি টাকা এলো তাইওয়ানের ধনাঢ্য পরিবারগুলোর কাছ থেকে। সরকার তাদের বিনিয়োগ করতে বলেছিল। সরকার তাদের ট্যাক্স সুবিধাও দিল। এভাবেই জন্ম নিল টিএসএমসি, যা শুরু থেকেই ছিল একটি রাষ্ট্রীয় প্রকল্প, পুরোপুরি বেসরকারি কোম্পানি নয়।
প্রথম থেকেই আমেরিকার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক টিএসএমসিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। তাদের প্রধান গ্রাহক ছিল মূলত আমেরিকান ডিজাইনাররা। অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি থেকে এসেছিলেন বা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালের দিকে টিএসএমসির অর্ধেক বিক্রি হতো আমেরিকান কোম্পানিগুলোর কাছে।

টিএসএমসি আসার আগে, ছোট ছোট ‘ফ্যাবলেস’ (যেসব কোম্পানির নিজস্ব ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা নেই) কোম্পানিগুলো ডিজাইন করলেও ম্যানুফ্যাকচারিং নিয়ে সমস্যায় পড়ত। বড় কোম্পানিগুলো তাদের অগ্রাধিকার দিত না, কখনো কখনো তাদের আইডিয়াও চুরি করে নিত। তাছাড়া, বিভিন্ন কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়াও ভিন্ন ছিল।

টিএসএমসির ‘ফাউন্ড্রি মডেল’ এই সমস্যার সমাধান করল। চ্যাং প্রতিশ্রুতি দিলেন, টিএসএমসি নিজে কখনো চিপ ডিজাইন করবে না, শুধু গ্রাহকের জন্য ম্যানুফ্যাকচারিং করবে। তারা গ্রাহকের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহযোগী। এই মডেল পুরো শিল্পকে বদলে দিল। নতুন নতুন ডিজাইন কোম্পানি তৈরি হলো এবং প্রযুক্তির প্রসার ঘটল।

১৯৯০-এর দশকে টিএসএমসি দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকল। তখন কেউ বুঝে উঠতে পারেনি; কিন্তু মরিস চ্যাং, টিএসএমসি এবং তাইওয়ান- এই ত্রয়ী মিলে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত চিপ উৎপাদনের চূড়ায় ওঠার পথে এগিয়ে যাচ্ছিল।

[ক্রিস মিলারের সাড়া জাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ২৯তম অধ্যায় (উই ওয়ান্ট এ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি ইন তাইওয়ান) থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন]

লেখক পরিচিতি: মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ