চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-২২ (শেষ পর্ব)
তাইওয়ান সঙ্কট: সিলিকন শিল্পের কেন্দ্রে যুদ্ধের পদধ্বনি
২০২১ সালের জুলাই মাস। বিশ্ব তখন চিপের তীব্র সঙ্কটে হাবুডুবু খাচ্ছে। এমন এক সময়ে, প্রযুক্তি জগতের কেন্দ্রবিন্দু টিএসএমসি-এর চেয়ারম্যান মার্ক লিউকে এক বিশ্লেষক একটি অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলেন: "চীন যখন তাইওয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দেয়, তখন আপনার গ্রাহকরা কি উদ্বিগ্ন হন না?"
প্রশ্নটি অস্বাভাবিক হলেও, এর কারণ ছিল স্পষ্ট। টিএসএমসি তখন মুনাফার শীর্ষে, আর বৈশ্বিক চিপ-সংকট তাদের গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছিল। কিন্তু তাদের কারখানাগুলো যে চীনের ঠিক উল্টো দিকে, তাইওয়ানের পশ্চিম উপকূলে! এতদিন বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এই ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা উপেক্ষা করলেও, ২০২১ সালে আতঙ্ক নিয়ে অনেকেই নতুন করে তাইওয়ানের মানচিত্র দেখতে শুরু করলেন।
মার্ক লিউ অবশ্য আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, সবাই শান্তি চায়। যেহেতু বিশ্ব তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টরের ওপর নির্ভরশীল, তাই কেউ এই সাপ্লাই চেইনকে ভাঙতে চাইবে না। বরং, তাইওয়ানের চিপ শিল্প একরকম 'সিলিকন শিল্ড' হিসেবে কাজ করবে।
কিন্তু পরদিনই চীন প্রমাণ করল শান্তি কত ভঙ্গুর। তাইওয়ান আক্রমণের জন্য অপরিহার্য অ্যামফিবিয়াস আর্মর্ড গাড়ি নিয়ে তারা সমুদ্রে নামল। যুদ্ধজাহাজে করে 'দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা' অনুশীলন করল এবং তীরে উঠে আক্রমণের মহড়া দিল। সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মহড়া বা চীনের ছোট দ্বীপ দখলের 'সালামি-স্লাইসিং' কৌশলই বড় সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। প্রশ্ন হলো: সামান্য একটি দ্বীপের জন্য কি যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে?
আমেরিকার সামরিক বিশ্লেষকরা মূল্যায়ন করলেন, চীন পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ না করে বরং কম ঝুঁকিপূর্ণ দুটি কৌশল বেছে নিতে পারে। প্রথমত, চীন নৌ ও আকাশপথ আংশিকভাবে অবরুদ্ধ করলে তাইওয়ানের বাণিজ্য দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই অবরোধ ভাঙতে হলে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানকে মূল ভূখণ্ডের সামরিক স্থাপনায় হামলা করতে হবে, যা সরাসরি মহাযুদ্ধের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। দ্বিতীয়ত, চীন দ্রুত ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলায় তাইওয়ানের সামরিক ঘাঁটি, রাডার ধ্বংস করতে পারে, চিপ কারখানাগুলোকে অক্ষত রেখেই।
মার্ক লিউ ঠিকই বলেছিলেন, কেউ সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ বন্ধ করতে চায় না। তবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দু'জনেই এই সাপ্লাই চেইনকে আরও বেশি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে। চীন টিএসএমসির কারখানা ধ্বংস করবে, এমন ধারণা বাস্তবসম্মত নয়, কারণ চীন নিজেও এসব চিপের ওপর নির্ভরশীল।
তবে চীন আক্রমণ করে ফ্যাক্টরি দখল করলেও তা চালানো প্রায় অসম্ভব। কারণ এতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার আসে আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপ থেকে। আর অসন্তুষ্ট প্রকৌশলীরা চাইলেই কোটি কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি মুহূর্তেই নষ্ট করে দিতে পারেন। সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাক্টরি চালানো পাহাড় দখলের মতো সহজ নয়, এটি অত্যন্ত জটিল প্রযুক্তি ও দক্ষতার বিষয়।
চীন বহুবার ঘোষণা করেছে, তাইওয়ানের 'পুনর্মিলন' তাদের জাতীয় অগ্রাধিকার। সামরিকভাবে তারা এখন প্রণালীতে এতটাই শক্তিশালী যে, চীনের ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ এবং জাপান-গুয়ামের ঘাঁটিতেও আঘাত করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বড় যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চাইবে না। ফলস্বরূপ, বিশ্বকে চীনের প্রভাবাধীন তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টরের ওপর নির্ভর করতে হতে পারে।
যদি কোনো কারণে টিএসএমসি-এর কারখানা ধ্বংস হয়, তবে বিপর্যয় হবে আরও ভয়ংকর। তাইওয়ান বিশ্বের ৩৭% লজিক চিপ তৈরি করে, যা কম্পিউটার, ফোন, ডেটা সেন্টার - সবকিছুর প্রাণ। তাইওয়ান বন্ধ হলে বিশ্ব এক ধাক্কায় ৩৭% কম্পিউটিং ক্ষমতা হারাবে। পিসি প্রসেসরের এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন বন্ধ হবে; এআই-এর বৃদ্ধি থমকে যাবে; নতুন ফোন তৈরি প্রায় অসম্ভব হবে। এই অর্থনৈতিক আঘাত মহামারির চেয়েও ভয়ংকর হবে, যার ক্ষতি হতে পারে বহু ট্রিলিয়ন ডলার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ক্ষতি বিশ্বকে প্রায় ৫ বছর পিছিয়ে দেবে। ৫জি, এআই - সবকিছু ভুলে গিয়ে মানুষ হয়তো দৈনন্দিন জিনিসপত্র কেনার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকবে।
অতীতে ১৯৫৪ ও ১৯৫৮ সালে তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনা হলেও তখন চীন দুর্বল ছিল। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাইওয়ানের চিপ শিল্পকে তাদের প্রেসিডেন্ট 'সিলিকন শিল্ড' বললেও, এটি অতিরিক্ত আশাবাদ। ২০২১ সালে অনেক তাইওয়ানিজ মনে করতেন যুদ্ধ অসম্ভব। ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমাণ করেছে, দীর্ঘ শান্তির পরও হঠাৎ যুদ্ধ হতে পারে। চীন কিন্তু রাশিয়া নয়। চীন নিজস্ব চিপ শিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে এবং তাইওয়ানের কারখানার খুব কাছেই বসে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখে।
এবারের এই নতুন সঙ্কট আগের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক। নিউক্লিয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। কারণ এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প, যা বিশ্বের 'ডিজিটাল হৃদস্পন্দন'। চীন হয়তো এবার বিশ্বাস করতে পারে যে তারা জিততে পারে, আর সেই বিশ্বাসই এই সঙ্কটকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে।
(ক্রিস মিলারের সাড়াজাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ৫৪তম অধ্যায় “দ্য তাইওয়ান ডাইলেমা” থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)
লেখক পরিচিতি:
মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসি’র কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে