Views Bangladesh Logo

চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-৫

সিলিকন ভ্যালির সংকট: জাপানের উত্থান ও আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা

Mahmud  Hossain

মাহমুদ হোসেন

শির দশক। আমেরিকার সেমিকন্ডাক্টর শিল্প যা একসময় সিলিকন ভ্যালির অহংকার ছিল, হঠাৎ করেই এক তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়ল। জাপানি কোম্পানিগুলো যেন অপ্রতিরোধ্য এক ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছিল। এই গল্পের এক নীরব কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নায়ক ছিলেন হিউলেট-প্যাকার্ড (এইচপি)-এর নির্বাহী রিচার্ড অ্যান্ডারসন। এইচপির জন্য কোন মেমরি চিপ কেনা হবে তার কঠিন মানদণ্ড তিনিই ঠিক করতেন। তাই, সেমিকন্ডাক্টর বিক্রেতাদের ভাগ্য অনেকটাই তার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করত।

১৯৩০-এর দশকে একটি সাধারণ গ্যারেজ থেকে যাত্রা শুরু করা এইচপি ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। তারা বিশাল পরিমাণে চিপ কিনত আর তাই অ্যান্ডারসনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত অনেক ছোট-বড় কোম্পানির ভাগ্য গড়ে দিত অথবা ভেঙে দিত। সেলসম্যানরা তাকে খুশি করতে মরিয়া হয়ে থাকত; কিন্তু অ্যান্ডারসন ছিলেন অসম্ভব রকমের পেশাদার। কখনো কখনো কেবল লাঞ্চ ছাড়া তাদের কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। নিজের গভীর পর্যবেক্ষণশক্তি দিয়ে তিনি খুব দ্রুতই আঁচ করতে পারলেন যে, আমেরিকার চিপ শিল্পের জন্য এক মারাত্মক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

তিনি দেখলেন, জাপানি কোম্পানিগুলো- যেমন তোশিবা, এনইসি এবং হিটাচি- যেসব DRAM চিপ তৈরি করছে সেগুলো আমেরিকান চিপের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে ওয়াশিংটনে এক সম্মেলনে তিনি যে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেন তা শুনে সবার চোখ কপালে উঠল। তিনি জানালেন, ব্যবহারের প্রথম ১,০০০ ঘণ্টার মধ্যে জাপানি চিপগুলোর অকার্যকারিতার হার ছিল ০.০২ শতাংশেরও কম! অথচ আমেরিকার সেরা কোম্পানির চিপের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ০.০৯ শতাংশ আর সবচেয়ে খারাপটির ০.২৬ শতাংশ! অবাক করা ব্যাপার হলো দুই দেশের চিপের দাম আর কার্যক্ষমতা ছিল প্রায় একই। তাহলে এমন অবস্থায় আমেরিকান চিপ কে কিনবে?

প্রথমদিকে সিলিকন ভ্যালির প্রকৌশলীরা জাপানিদের নিয়ে বেশ হাসাহাসি করত। তারা তাচ্ছিল্য করে বলত, ‘আরে বাবা, জাপানিরা তো শুধু কনফারেন্সে আসে, ক্যামেরায় “ক্লিক ক্লিক” করে ছবি তোলে, আর গিয়ে কপি করে!’ কিছু আমেরিকান কোম্পানি তো জাপানিদের বিরুদ্ধে মেধা সম্পত্তি চুরির মামলাও ঠুকে দিল; কিন্তু এই মামলাগুলোই যেন এক তিক্ত সত্যকে সবার সামনে নিয়ে এলো- জাপানিরা শুধু নকল করছে না, বরং গুণগতমানেও তারা বহুগুণ এগিয়ে যাচ্ছে!

শুধু চিপই নয়, সে সময় জাপান গাড়ি, স্টিল এবং ইলেকট্রনিক্স- সব খাতেই আমেরিকাকে কঠিন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল। সনির প্রতিষ্ঠাতা আকিও মরিতা একাই যেন জাপানের কপালে সেঁটে থাকা ‘সস্তা পণ্য’-এর বদনাম ঘোচাতে পেরেছিলেন। তার ট্রানজিস্টর রেডিও ছিল প্রথম বড় সাফল্য যা বিশ্ববাজারে জাপানকে এক নতুন পরিচিতি এনে দিয়েছিল। এরপর ১৯৭৯ সালে তিনি এক যুগান্তকারী পণ্য বাজারে আনলেন- ওয়াকম্যান। এটি ছিল একটি পোর্টেবল মিউজিক প্লেয়ার, যার ভেতরে ছিল সনির তৈরি পাঁচটি অত্যাধুনিক ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট। এই ছোট্ট যন্ত্রটি গান শোনার ধারণাই পাল্টে দিল। আর এতে যে চিপ ব্যবহার করা হয়েছিল তা আবিষ্কৃত হয়েছিল আমেরিকায়; কিন্তু সেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে পণ্যের উৎকর্ষতা এনেছিল জাপান।

মজার বিষয় হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চিপ তৈরির পথ জাপানকে দেখিয়েছিল স্বয়ং আমেরিকাই। ট্রানজিস্টর তৈরির জ্ঞান তারা জাপানি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে উদারভাবে ভাগ করে নিয়েছিল। মার্কিন নীতিনির্ধারকরা নিশ্চিত করেছিলেন, জাপানি কোম্পানিগুলো যেন সহজেই মার্কিন বাজারে প্রবেশ করতে পারে। এই কৌশল দারুণ কাজ করেছিল- জাপান একটি উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল; কিন্তু আশির দশকে এসে অনেক আমেরিকানই এই প্রশ্নটি তুলতে শুরু করল, ‘আমাদের এই উদারতা কি এমন এক প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করে ফেলেছে যা আমাদের নিজেদের ভালোর জন্যই এখন বড্ড বেশি শক্তিশালী?’

ফেয়ারচাইল্ড থেকে ন্যাশনাল সেমিকন্ডাক্টরের প্রধান নির্বাহী হিসেবে যোগ দেয়া চার্লি স্পর্ক ছিলেন অ্যাসেম্বলি লাইনে দক্ষতা বাড়ানোর একজন জাদুকর। সেই স্পর্কও অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, জাপানি শ্রমিকদের কর্মশক্তি, আনুগত্য এবং উৎপাদন দক্ষতা এতটাই বেশি যে, তার নিজের শ্রমিকরা তাদের ধারেকাছেও ছিল না। তিনি তার একজন ফোরম্যান এবং কয়েকজন শ্রমিককে জাপানের বিভিন্ন সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট ঘুরে দেখতে পাঠালেন। ফিরে এসে তারা জানাল- জাপানি কর্মীরা ‘কোম্পানির প্রতি আশ্চর্য রকমের আনুগত্যশীল!’ এমনকি একজন ফোরম্যান তো বলেই ফেলল, তারা কোম্পানিকে নিজের পরিবারের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেয়!

অন্যদিকে, আমেরিকানরা তখনো বিশ্বাস করত যে, তাদের ‘উদ্ভাবন ক্ষমতা’ জাপানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। জাপানি পদার্থবিদ মাকোতো কিকুচি নিজেও একবার বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে আমেরিকার মতো “জিনিয়াস” কম; কিন্তু আমেরিকায় অনেক মানুষ আছে যাদের বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিকের নিচে।’ তাই গুণগতমান এবং ধারাবাহিক কর্মদক্ষতায় জাপানই এগিয়ে। তবে, তারই বস আকিও মরিতা প্রমাণ করে দিলেন- জাপান কেবল অনুকরণে নয়, উদ্ভাবনেও সমান পারদর্শী। সনির ওয়াকম্যান ছিল তারই জ্বলন্ত প্রমাণ, একটি যুগান্তকারী পণ্য যা বিশ্বকে বদলে দিয়েছিল।

আশির দশকের শেষ দিকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল: জাপান কেবল আমেরিকাকে ধরে ফেলছে না- তারা অনেক ক্ষেত্রে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যে সেমিকন্ডাক্টর খাত একসময় ছিল আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক, তা এখন এক নতুন ও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ