চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-৭
আশির দশকের ক্রুড অয়েল যুদ্ধ
পালো আল্টোর (ক্যালিফোরনিয়ার একটি শহর) এক হিমেল সন্ধ্যায় মিংস চাইনিজ রেস্টুরেন্টের উষ্ণ পরিবেশে সমবেত হয়েছিলেন মার্কিন চিপশিল্পের তিন কিংবদন্তি- বব নয়েস, জেরি স্যান্ডার্স এবং চার্লি স্পর্ক। এক সময় ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলেও, পরবর্তীতে তারা নিজেদের কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসেবে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন; কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় তাদের সামনে ছিল এক অভিন্ন, বিশাল চ্যালেঞ্জ: জাপানের অপ্রতিরোধ্য উত্থান। তাই তারা একমত হলেন যে, সরকারের প্রতি আর উদাসীন থাকা যাবে না; এবার তাদের সরকারের দ্বারস্থ হতেই হবে।
এএমডির সিইও জেরি স্যান্ডার্স সেদিন এক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন- ‘সেমিকন্ডাক্টর হলো আশির দশকের ক্রুড অয়েল।’ তার এই উক্তির পেছনে ছিল এক অকাট্য যুক্তি। ততদিনে প্রযুক্তি-
নির্ভর জীবনযাত্রার প্রায় সবকিছু তৈরি করতেই চিপের প্রয়োজন হতো। কম্পিউটার থেকে শুরু করে গাড়ি, বিমান, ওয়াকম্যান, এমনকি সাধারণ মাইক্রোওভেনও চিপ ছাড়া ছিল অচল। তেলের মতোই দৈনন্দিন জীবনে চিপের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য।
বিদেশি সরবরাহের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে তা সত্তর দশকের ভয়াবহ তেল সংকটের মধ্য দিয়ে আমেরিকা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। যখন আরব দেশগুলো ইসরায়েলকে সমর্থনের জের ধরে আমেরিকায় তেল রপ্তানি বন্ধ করে দিল তখন গোটা মার্কিন অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল। সরকার এর প্রতিক্রিয়ায় তেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পররাষ্ট্রনীতিকে গুরুত্ব দিল, এমনকি প্রয়োজনে সামরিক শক্তিও ব্যবহার করল। স্যান্ডার্স সিলিকন সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর কথা বলেননি- তবে তিনি বিশ্বাস করতেন, আমেরিকার উচিত সময় থাকতে তার চিপ শিল্প সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা নেয়া।
এর আগে সিলিকন ভ্যালির কোম্পানিগুলো সরকার থেকে দূরে দূরে থাকত; কিন্তু পরিস্থিতির চাপে এবার তারা সরকারের শরণাপন্ন হতে চাইল। মিংস রেস্টুরেন্টের সেই ঐতিহাসিক ডিনারের পর স্যান্ডার্স, নয়েস ও স্পর্ক মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (SIA)- যার মূল লক্ষ্য ছিল ওয়াশিংটনে লবিংয়ের মাধ্যমে আমেরিকার এই গুরুত্বপূর্ণ চিপশিল্পকে রক্ষা করা।
চিপকে ক্রুড অয়েলের সঙ্গে তুলনা করার ব্যাপারটি পেন্টাগনের কাছে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলো। কারণ, আমেরিকার সামরিক শক্তির মূলে ছিল এই সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি। যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, কৃত্রিম উপগ্রহ- সবকিছুই ছিল সেমিকন্ডাক্টরের ওপর নির্ভরশীল। সত্তর দশক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক আধিপত্য মোকাবেলায় আমেরিকার মূল কৌশল ছিল প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠতা অর্জন, আর এর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সেমিকন্ডাক্টর।
কিন্তু ১৯৮৬ সালে জাপান আমেরিকাকে পেছনে ফেলে চিপ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করে ফেলে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী লিথোগ্রাফি যন্ত্রের (চিপ তৈরির মূল সরঞ্জাম) ৭০ শতাংশ তারাই সরবরাহ করছিল, যেখানে আমেরিকার অংশীদারিত্ব ছিল মাত্র ২১ শতাংশ। লিথোগ্রাফির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো মানে চিপ শিল্পে বিদেশনির্ভর হয়ে যাওয়া।
পেন্টাগন এই আসন্ন বিপদ মোকাবেলায় জ্যাক কিলবি, বব নয়েসসহ ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা সবাই মিলে একটি বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়:
# আমেরিকার সামরিক শক্তিমত্তা নির্ভর করে প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠতার ওপর।
# ইলেকট্রনিক্স সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি।
# ইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের মূলে রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর।
# অচিরেই আমেরিকা অ্যাডভান্সড চিপের ক্ষেত্রে বিদেশনির্ভর হয়ে পড়বে।
জাপান তখনো আমেরিকার এক ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকাই জাপানের সংবিধানে যুদ্ধবিরোধী ধারা যুক্ত করেছিল, যাতে তাদের সামরিক শক্তি সীমিত থাকে। এরপর থেকে জাপানের সামরিক বাজেট জিডিপির ১ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ফলশ্রুতিতে জাপান সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থনীতি গঠনে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পেরেছিল অন্যদিকে আমেরিকা নিজেদের ছাড়াও আরও অনেকের জন্য সামরিক ব্যয়ের বোঝা বহন করে চলছিল।
এর ফল হিসেবে জাপানের অর্থনীতি প্রবল গতিতে এগোতে থাকে। একসময় যে দেশটি ‘ট্রানজিস্টর বিক্রেতা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল, তারাই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়ে উচ্চপ্রযুক্তি শিল্পে আমেরিকাকে টক্কর দিতে শুরু করে। সামরিক প্রযুক্তির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে জাপানি কোম্পানিগুলো তাদের মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে দেয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতেই চার্লি স্পর্ক পেন্টাগনকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘যদি চিপস নিয়ে আমরা এখনই সচেতন না হই তাহলে টেলিভিশন বা ক্যামেরা শিল্পের মতো এই খাতটিও আমরা [জাপানের কাছে] হারাব। আর চিপ ছাড়া আমরা কোথাও পৌঁছাতে পারব না- না অর্থনৈতিকভাবে, না সামরিকভাবে।’
[ক্রিস মিলারের সাড়াজাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ১৮তম অধ্যায় (দ্য ক্রুড অয়েল অফ দ্য ১৯৮০) থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন]
লেখক পরিচিতি: মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে