চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-৯
শত্রুর শত্রুই মিত্র: কোরিয়ার উত্থান
লি বিয়ং-চুল ছিলেন এক জন্মগত ব্যবসায়ী। তার হাতে যেন জাদু ছিল- তিনি যে ব্যবসায় হাত দিতেন তাতেই সফল হতেন। ১৯৩৮ সালে যখন চারদিকে যুদ্ধের দামামা বাজছে, কোরিয়া জাপানের শাসন থেকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে, তখন তিনি শুরু করলেন তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান স্যামসাং।
শুরুটি কিন্তু খুবই সাধারণ- চীনের উত্তরাঞ্চলে জাপানি সৈন্য-সামন্তদের জন্য শুঁটকি মাছ আর সবজি রপ্তানি করে। তখনকার কোরিয়া ছিল একেবারে গরিব, শিল্প বা প্রযুক্তির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তবুও লির স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া: স্যামসাং একদিন অনেক বড় ও শক্তিশালী হবে এবং যুগের পর যুগ টিকে থাকবে।
১৯৪৫ সালে জাপান পরাজিত হলো আর কোরিয়া ভাগ হয়ে গেল উত্তর ও দক্ষিণে। বিচক্ষণ লি পরিস্থিতি বুঝে নতুন করে ছক সাজালেন। জাপানিদের ছেড়ে এবার তিনি সম্পর্ক গড়লেন আমেরিকান দখলদারদের সঙ্গে। ১৯৫০ সালে উত্তর কোরিয়া যখন দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে, যুদ্ধের সেই ভয়াবহ সময়ও তিনি তার বেশিরভাগ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন।
১৯৬১ সালে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করলে তারা লির ব্যাংকগুলো বাজেয়াপ্ত করে; কিন্তু তিনি দমে গেলেন না, বাকি ব্যবসা নিয়েই টিকে থাকলেন। লি সবসময় বলতেন, স্যামসাং মানেই জাতির সেবা আর কোরিয়ার উন্নতি নির্ভর করে স্যামসাংকে বিশ্বমানের কোম্পানি বানানোর ওপর। তাদের পারিবারিক মূলমন্ত্রই ছিল: ‘ব্যবসার মাধ্যমে জাতির সেবা।’ তার এই স্ট্র্যাটেজি ফলপ্রসূ হয়েছিল। মাছ-সবজি থেকে ব্যবসা সম্প্রসারিত হলো চিনি, টেক্সটাইল, সার, নির্মাণ, ব্যাংক ও বীমা পর্যন্ত। ’৬০ ও ’৭০-এর দশকে কোরিয়ার অর্থনৈতিক উত্থান ঘটল আর লি প্রমাণ হিসেবে সেটিকে দেখিয়ে বলতেন, ‘দেখ, আমি দেশকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’ সমালোচকরা অবশ্য বলতেন ভিন্ন কথা- ১৯৬০ সালের মধ্যে তিনি দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন যা প্রমাণ করে যে জাতিই তাকে সেবা করছে, তিনি জাতিকে নয়।
’৭০-এর দশকের শেষের দিকে লির নজর পড়ল সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের দিকে। তখন জাপানের তোশিবা আর ফুজিৎসুর মতো কোম্পানিগুলো এই বাজার দ্রুত দখল করে নিচ্ছিল। কোরিয়া তখনো শুধু মার্কিন ও জাপানি কোম্পানির চিপ অ্যাসেম্বলিং ও প্যাকেজিংয়ের জন্য সস্তা জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিল; কিন্তু শুধু চিপ জোড়া লাগানো থেকে অত্যাধুনিক চিপ বানানো সহজ কাজ ছিল না। ’৮০-এর দশকের শুরুতে পরিস্থিতি পাল্টে গেল। তখন জাপান আর সিলিকন ভ্যালি DRAM চিপ নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কোরিয়ান সরকার এ সুযোগটি লুফে নিল এবং সেমিকন্ডাক্টরকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করল। ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বিশাল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি এলো, সঙ্গে ব্যাংকগুলোও সরকারের নির্দেশে ঋণ দিতে প্রস্তুত।
১৯৮২ সালে লি গেলেন ক্যালিফোর্নিয়া সফরে। সেখানে হিউলেট-প্যাকার্ডে গিয়ে তো তার অবাক হওয়ার পালা- একটি গ্যারেজ থেকে শুরু হওয়া কোম্পানি কীভাবে সেমিকন্ডাক্টরের কল্যাণে প্রযুক্তির এক দানব হয়ে উঠেছে! আইবিএমের কারখানায় ছবি তোলার অনুমতি পেয়ে তিনি রসিকতা করে জানতে চাইলেন, ‘এত গোপনীয় জিনিস এভাবে দেখিয়ে দিচ্ছেন?’ উত্তরে এক কর্মী বলল, ‘শুধু দেখলেই এগুলো নকল করা যায় না’; কিন্তু লির পরিকল্পনা ছিল ঠিক এটিই- সিলিকন ভ্যালিকে নকল করে শেখা।
তবুও সেমিকন্ডাক্টরে বিনিয়োগের সিদ্ধান্তটি ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এতে কমপক্ষে ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারত আর ব্যর্থ হলে পুরো স্যামসাং ধসে যেত। লি মাসের পর মাস দোটানায় ছিলেন। অবশেষে, ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক নির্ঘুম রাতের পর তিনি ঘোষণা করলেন: ‘স্যামসাং সেমিকন্ডাক্টর বানাবে।’
স্যামসাংয়ের এই দুঃসাহসিক বাজি সফল হতো না যদি আমেরিকার সমর্থন না থাকত। মার্কিন চিপ কোম্পানিগুলো তখন জাপানের বিরুদ্ধে এক মিত্র খুঁজছিল। ইন্টেলের বব নয়েস বিশ্বাস করতেন, কোরিয়ানরা জাপানিদের চেয়ে সস্তায় চিপ বানাতে পারবে। এতে জাপান একচেটিয়া বাজার দখল করতে পারবে না। তার যুক্তি ছিল-‘আমার শত্রুর শত্রুই আমার বন্ধু।’
’৮০-এর দশকে ইন্টেলসহ কয়েকটি মার্কিন কোম্পানি স্যামসাংয়ের সঙ্গে চুক্তি করে। স্যামসাং ইন্টেলের নামেই চিপ তৈরি করত। কোরিয়ায় তখন শ্রমিক খরচ জাপানের চেয়ে অনেক কম ছিল যা ছিল স্যামসাংয়ের জন্য এক বড় সুবিধা। এর ওপর, ১৯৮৬ সালে আমেরিকার চাপে জাপান সস্তায় চিপ বিক্রি বন্ধ করতে রাজি হলো। ফলে কোরিয়ানরা আরও বেশি দামে চিপ বিক্রি করার সুযোগ পেল।
আমেরিকা শুধু বাজারই দেয়নি, প্রযুক্তিও দিয়েছে। তখন প্রায় সব মার্কিন মেমরি কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ার পথে। নিজেদের বাঁচাতে তাদের প্রযুক্তি বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। স্যামসাং আইডাহোভিত্তিক নতুন কোম্পানি মাইক্রন থেকে 64K DRAM -এর ডিজাইন কিনে নিল। মাইক্রনের প্রতিষ্ঠাতা ওয়ার্ড পারকিনসন বলেছিলেন, ‘আমরা যা করতাম, স্যামসাংও তাই করত।’ স্যামসাংয়ের দেয়া অর্থ মাইক্রনের টিকে থাকার জন্য প্রায় অপরিহার্য ছিল।
মার্কিন কোম্পানিগুলো মরিয়া হয়ে মূল্যবান প্রযুক্তি বিক্রি করছে - এ নিয়ে ইন্টেলের গর্ডন মুর অবশ্য উদ্বিগ্ন ছিলেন; কিন্তু তখন সিলিকন ভ্যালির অনেকেই মনে করত DRAM আর ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নয়। তাই কোরিয়ানরা যদি এই খাতটি দখল করে জাপানকে হারাতে পারে তাতে তাদের কী-ই বা ক্ষতি!
এভাবেই সরকারের সমর্থন, আমেরিকার সহযোগিতা আর লির সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে স্যামসাং মেমরি চিপের দুনিয়ায় শক্তিশালী হয়ে উঠল। যে কোরিয়া একসময় গরিব ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছিল, সেই কোরিয়াই হয়ে উঠল বিশ্বের সেরা সেমিকন্ডাক্টর কেন্দ্র। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, বিশ্বব্যবসা ও রাজনীতিতে অনেক সময় শত্রুর শত্রুই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় বন্ধু।
(ক্রিস মিলারের সাড়াজাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ২৩তম অধ্যায় (দ্য রাইজ অফ কোরিয়া) থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)
লেখক পরিচিতি: মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে