চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-২
এশিয়ার ট্রানজিস্টর গার্লদের সস্তা শ্রমের হাত ধরে বিশ্ব চিপ শিল্পের উত্থান
আধুনিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের একেবারে গোড়ার দিকে, চিপ তৈরির বিপ্লবে এশিয়ার নারী শ্রমিকরা এক অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন। যদিও ট্রানজিস্টরের ডিজাইন নিয়ে মূলত পুরুষ কাজ করতেন; কিন্তু সেই ডিজাইন করা চিপকে হাতে ধরে বাস্তব পণ্যে রূপান্তর করার জন্য দরকার ছিল এমন একগুচ্ছ দক্ষ হাত, যা হবে দ্রুত, নিখুঁত এবং একই সঙ্গে সাশ্রয়ী। এই অভাব পূরণ করেছিলেন নারীরা, বিশেষ করে অ্যাসেম্বলি লাইনে কাজ করা নারী শ্রমিকরা।
নিউইয়র্কের প্রকৌশলী চার্লি স্পর্ক ছিলেন এই বিশাল পরিবর্তনের মূল কাণ্ডারি। ১৯৫০-এর দশকে ইস্ট কোস্টের জেনারেল ইলেকট্রিকে কাজ করার সময় ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিল না। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, সেখানকার ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীরা তার কুশপুত্তলিকা পর্যন্ত দাহ করেছিল। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই ১৯৫৯ সালে তিনি যোগ দেন ওয়েস্ট কোস্টের উদীয়মান কোম্পানি ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টরে, যেখানে উন্মোচিত হচ্ছিল আধুনিক চিপ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত।
সেই সময় ওয়েস্ট কোস্টে ট্রেড ইউনিয়ন ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল, আর স্পর্ক চাইলেন যেন এই অবস্থাটাই বজায় থাকে। তিনি উৎপাদনশীল কর্মীদের ‘স্টক অপশন’ দিয়ে পুরস্কৃত করা শুরু করলেন, যা সে সময়ে ছিল এক বৈপ্লবিক ধারণা। তবে এর বিনিময়ে তিনি কর্মীদের কাছ থেকে পারফরমেন্সের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি চাইতেন।
ইস্ট কোস্টের ইলেকট্রনিক কোম্পানিগুলো যেখানে প্রধানত পুরুষ কর্মী নিয়োগ দিত, সেখানে ফেয়ারচাইল্ড এবং সিলিকন ভ্যালির অন্যান্য নতুন চিপ কোম্পানিগুলো অ্যাসেম্বলি লাইনে নারী কর্মী নিয়োগ করত। এই সিদ্ধান্ত কোনো লিঙ্গসমতা বা অন্তর্ভুক্তির ভাবনা থেকে নেয়া হয়নি, বরং নারীদের কম মজুরি দেয়া যেত, আর ম্যানেজমেন্টের বিশ্বাস ছিল, নারী কর্মীদের ছোট হাতের গঠন সিলিকন চিপ বসানো, স্বর্ণের তার জোড়া দেওয়া, সার্কিট টেস্টিং- এসব অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাজের জন্য আদর্শ।
নারীদের দিয়ে কাজ করানো ওয়েস্ট কোস্টে পুরোপুরি নতুন কিছু ছিল না। সেখানকার সান্তা ক্লারা উপত্যকার নারীরা আগেও কৃষিতে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে কারখানায় কাজ করত। তবে চিপ শিল্প সেই শ্রমকে দিল এক নতুন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন আইন পরিবর্তনের ফলে আরও বেশি, বিশেষ করে বিদেশি নারীরা এই শিল্পে যুক্ত হতে শুরু করে।
এসবের পরেও যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম ব্যয় ছিল অনেক বেশি। তাই স্পর্ক ও অন্যান্যরা সস্তা শ্রমের খোঁজে ক্যালিফোর্নিয়ার বাইরে তাকালেন। ফেয়ারচাইল্ড কারখানা খুলল মেইনে এবং নিউ মেক্সিকোর নাভাজো রিজার্ভেশনে - কিন্তু তাতেও বড় কোনো পরিবর্তন এলো না। একসময় ফেয়ারচাইল্ডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বব নয়েস স্পর্ককে হংকং-এর একটি কারখানা পরিদর্শন করতে পাঠালেন। সেখানে কর্মীরা, প্রধানত নারীরা, ঘণ্টায় মাত্র ২৫ সেন্ট আয় করত, যা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এক-দশমাংশ। তাছাড়া সেখানকার কর্মীরা ছিল কাজে দ্রুততর, ধৈর্যশীল এবং কম মজুরি নিয়ে সন্তুষ্ট।
চীনের এত কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও সবকিছু মিলিয়ে স্পর্ক ভীষণভাবে আকৃষ্ট হলেন। তিনি ফেয়ারচাইল্ডের জন্য হংকং বিমানবন্দরের কাছে একটি পুরোনো স্যান্ডেল কারখানা ভাড়া নিলেন। একটি বিশাল ফেয়ারচাইল্ড লোগো বন্দর এলাকাকে আলোকিত করতে শুরু করল। সিলিকন ওয়েফার যদিও আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় তৈরি হতো, তবে চূড়ান্ত অ্যাসেম্বলি হংকংয়ে শুরু হলো। শুধু ১৯৬৩ সালেই ফেয়ারচাইল্ডের হংকং কারখানায় ১২০ মিলিয়ন সেমিকন্ডাক্টর যন্ত্রাংশ অ্যাসেম্বল করা হয়। সেগুলোর গুণগত মানও ছিল খুব ভালো। ফেয়ারচাইল্ড সেখানে প্রশিক্ষিত প্রকৌশলী নিয়োগ দিতে পারত, যা আমেরিকায় করা সম্ভব ছিল না।
আমেরিকার চিপ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ফেয়ারচাইল্ডই প্রথম অ্যাসেম্বলি কাজ এশিয়ায় সরিয়ে নেয়। এরপর খুব দ্রুতই টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস ও মটোরোলা-সহ আরও অনেকে একই পথ ধরে। এক দশকের মধ্যেই প্রায় সব আমেরিকান সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি বিদেশে, বিশেষ করে এশিয়ায়, অ্যাসেম্বলি কারখানা স্থাপন করে।
১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি এশিয়ার আরও কিছু দেশে মজুরি ছিল হংকংয়ের চেয়েও কম: প্রতি ঘণ্টায় তাইওয়ানে ১৯ সেন্ট, মালয়েশিয়ায় ১৫, সিঙ্গাপুরে ১১ এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০ সেন্ট। স্পর্ক এরপর গেলেন সিঙ্গাপুরে- সেখানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ তখন শ্রমিক ইউনিয়নকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন, যা ছিল মার্কিন কোম্পানি ফেয়ারচাইল্ডের জন্য আরও আকর্ষণীয় ব্যাপার। কিছুদিনের মধ্যেই ফেয়ারচাইল্ড মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে কারখানা স্থাপন করে।
'গ্লোবালাইজেশন' শব্দটি তখনো অতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি; কিন্তু কার্যত ব্যয় কমানো আর উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প এশিয়াকেন্দ্রিক এমন এক সাপ্লাই চেইন গড়ে তুলছিল, যা আজকের 'গ্লোবালাইজড' ইলেকট্রনিক্স উৎপাদনের ভিত্তি।
চার্লি স্পর্কের মনে বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থা বদলানোর কোনো অভিপ্রায় ছিল না, তিনি শুধু চিপকে সস্তা করতে চেয়েছিলেন। আর এশিয়ার বিশাল, সুশৃঙ্খল ও সস্তা শ্রমবাজার, বিশেষ করে নারী শ্রমবাজার, ছিল তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।
(ক্রিস মিলারের সাড়া জাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর দশম অধ্যায় 'ট্রানজিস্টর গার্লস' থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে