Views Bangladesh Logo

ধর্ষণে মামলার বিচার, শেষ হয়না অপেক্ষার প্রহর

দেশে ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়। এরপর কেটে গেল পাঁচ বছর। সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও কমাতে পারেনি ধর্ষণের মতো চরম নৃশংসতা। বেড়েই চলছে এ সংক্রান্ত মামলা। কিন্তু নিষ্পত্তি নেই বললেই চলে।

সূত্র জানায়, ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার পরে গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে অধস্তন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ৩৩ হাজার ১০৫টি মামলা। এছাড়া হাইকোর্টে স্থগিত রয়েছে আরো এক হাজার ৭০২টি মামলা। এর বাইরে পুলিশের তদন্তে রয়েছে ১৯ হাজার ৭৯৬টি মামলা। অন্যদিকে, পিবিআইয়ের ৪৭টি জেলা ইউনিট গত ৫ বছরে থানায় হওয়া ৯শ ২৬টি মামলা তদন্ত করেছে। একই সময়ে আদালতের নির্দেশে ১ হাজার ২০৯টি সিআর মামলা (আদালতে করা) তদন্তাধীন আছে পিবিআইয়ে।

ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত শেষ করতে ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই হাইকোর্ট সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাতটি নির্দেশনা দেন। সেগুলো হচ্ছে- ১. দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে বিচারাধীন ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলাগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আইনের নির্ধারিত সময়সীমার (বিচারের জন্য মামলা প্রাপ্তির তারিখ থেকে ১৮০ দিন) মধ্যে দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সবধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে। ২. দেশের সব ট্রাইব্যুনালকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ধারা ২০ এর বিধান অনুসারে মামলার শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা মামলা পরিচালনা করতে হবে। ৩. ধার্য তারিখে সাক্ষী উপস্থিতি ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতি জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন), সিভিল সার্জনের একজন প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। ৪. ট্রাইব্যুনালে পাবলিক প্রসিকিউটর কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকবেন এবং কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতি মাসে সুপ্রিম কোর্ট, স্বরাষ্ট্র এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবেন। যে সব জেলায় একাধিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে সেসব জেলায় সব ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর মনিটরিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং তাদের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠ তিনি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন। ৫. ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ সঙ্গত কারণ ছাড়া সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হলে মনিটরিং কমিটিকে জবাবদিহি করতে হবে। মনিটরিং কমিটি সাক্ষীদের উপর দ্রুততম সময়ে যাতে সমন জারি করা যায়, সে বিষয়টাও মনিটরিং করবে। ৬. ধার্য তারিখে সমন পাওয়ার পরও অফিসিয়াল সাক্ষী যেমন- ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, ডাক্তার বা অন্য বিশেষজ্ঞরা সন্তোষজনক কারণ ব্যতিরেকে সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত না হলে, ট্রাইব্যুনাল উক্ত সাক্ষীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ ও প্রয়োজনে বেতন বন্ধের আদেশ দেয়া বিবেচনা করবেন। ৭. আদালতের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন এবং আদালত এটাও প্রত্যাশা করছে যে, সরকার অতি স্বল্প সময়ে উক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করবে।

হাইকোর্টের এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন না হওয়ায় ধর্ষণ মামলার জট কমা তো দুরের কথা উল্টো আরো বেড়েছে। এমন অবস্থায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন সরকার গত অক্টোবরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে। এতে ধর্ষণের মামলা তদন্তের সময় অর্ধেক করে ৩০ দিনের জায়গায় ১৫ দিন করা হয়। বিচারের সময়ও অর্ধেক করে ১৮০ দিনের জায়গায় ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তাতেও খুব একটা গতি পায়নি ধর্ষণ মামলার বিচারে।

মানবাধীকার নেত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এলিনা খান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘নানা কারণে আমাদের দেশে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে না। এটা খুবই দুঃজনক।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান আইন অনুযায়ী ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে ডিএনএ সার্টিফিকেট। আমাদের দেশের সব অঞ্চলে ডিএনএ সার্টিফিকেট নেওয়ার সুযোগ নেই। শুধু ভিকটিম না, আসামিরও একটা ফরেনসিক রিপোর্ট লাগে। অথচ ডিএনএ ফরেনসিক রিপোর্ট করার সুযোগ-সুবিধা অত্যন্ত অপ্রতুল। এজন্য ধর্ষণ মামলার বিচারে অনেক দেরি হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রমান নষ্ট হওয়ায় মামলাই বাতিল হয়ে যায়। তখন বিচারের বানী শুধু নিভৃতে কঁদে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘রাজনৈতিক মামলাগুলোর বিচারে বিশেষ আদালতে হলেও ধর্ষণ মামলার বিচার হয় ট্রাইব্যুনালে। যা বিশেষ আদালতের চেয়ে অনেকটাই মন্থর।’ তিনি বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অনেকগুলো অপরাধের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। পরে আইন সংশোধন করে ধর্ষণের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধানও যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আইনে শাস্তি কঠিন হলেও এর প্রয়োগ জটিলতা আরো বেড়েছে। তাই ধর্ষণ মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কমেনি মোটেই।’

এ ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ধর্ষণের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে বর্তমান অন্তবর্তীকালিন সরকার এসব মামলা তদন্ত ও বিচারের সময় অর্ধেক করে দিয়েছে। আগে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হতো, এজন্য মামলার কাজ শেষ হতে দেরি হতো। নতুন সংশোধনীতে তদন্তকারী কর্মকর্তা যাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তাকেই তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করা যাবে না বলে বলা হয়েছে। এছাড়া সংশোধনীতে বিচার ৯০ দিনের মধ্যে শেষ না হওয়ার অজুহাতে কাউকে জামিন দেওয়া যাবে না। বর্তমান আইনে রয়েছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার না হলে জামিন দেওয়া যেত। আইনের এই নতুন সংশোধনীর জন্য আশা করছি ধর্ষণের মামলা আগামীতে দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ