বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে
বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমেই জটিল, দ্বিধাগ্রস্ত ও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠছে। নেতৃত্বহীন, আদর্শশূন্য ও নৈতিকতার অবক্ষয়ই এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের অনিবার্য রূপ।
নেতৃত্বহীন ও গণঅভ্যুত্থানের হতাশা
২০২৫ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত গণঅভ্যুত্থান একসময় নতুন নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটাবে বলে মনে হয়েছিল। তরুণদের সেই শৃঙ্খল ভাঙা স্লোগানে অনেকেই আশার আলো দেখেছিলেন; কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই আলো নিভু নিভু প্রদীপে পরিণত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিভাজন, অপরিণত কৌশল এবং নীতিহীন তাড়াহুড়ো গোটা আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ রাজপথে নেমেছিল, তা আজ ব্যর্থতার এক করুণ প্রতিমূর্তি। এই অবস্থায় হতাশা আসাটাই স্বাভাবিক। মানুষ এখন প্রশ্ন তোলে- এই পরিবর্তনের জন্যই কি তরুণরা রক্ত দিয়েছিল? যে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা গর্জে উঠেছিল, সেই কাঠামো তো ভাঙেনি; বরং নতুন মুখোশে, আরও পরিপক্ব চেহারায় হাজির হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও বৈশ্বিক পুঁজি যেমন আগ্রাসীভাবে তৎপর, তেমনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও চলছে ক্ষমতার সামন্তীয় পুনর্বিন্যাস
সারজিস আলমের দ্বিমুখিতা
এই প্রেক্ষাপটে যখন সরকারের ঘনিষ্ঠজন সারজিস আলম বলেন- ‘বিচার না হওয়া পর্যন্ত সরকার যেন অন্য কিছু না ভাবে’- তখন কথায় যুক্তি থাকলেও বিশ্বাস জাগে না। কারণ এই তিনিই তো আগে শহীদদের কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। অথচ গোপালগঞ্জে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হলে সরকার পরে বাধ্য হয় লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করতে। তাহলে জুলাই শহীদদের বেলায় এই ব্যতিক্রম কেন?
নিরাপদ দূরত্ব ও ‘ট্যাগিং সংস্কৃতি’
আজ কেবল রাষ্ট্র নয়, তথাকথিত প্রগতিশীল, এনজিওপন্থি ও সামাজিক মিডিয়ার 'ট্যাগিং সংস্কৃতিও' মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করছে। ভিন্নমত পোষণ করলেই কাউকে ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। এই সংস্কৃতি এক ধরনের ‘সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসে’ রূপ নিয়েছে- যেখানে সত্য বলা মানে নিজের বিরুদ্ধে সামাজিক রোষ ডেকে আনা। সুশীল সমাজ ও সাংস্কৃতিক বলয়ের মানুষরাও আজ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। আপনি যদি মুজিববাদী হন, সেটা স্পষ্টভাবে বলুন। আওয়ামী প্রগতিশীলতা যদি আপনার আদর্শ হয়, লুকাবেন না। কিন্তু যারা প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব থাকে, তারাই প্রকৃতপক্ষে নিপীড়কের পাশে দাঁড়ায়।
বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় দমননীতি
বিচারব্যবস্থার কথা বললে বারবার একই জায়গায় ফিরে আসি- কাঠামোগত দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব। সরকার আন্দোলন দমনে ‘ঢালাও মামলা’ সংস্কৃতি চালু করেছে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ বিনা বিচারে আটক। কেউ কেউ ১১ মাস ধরে জামিন পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে বিচারকরা কতটা স্বাধীন? রাষ্ট্রের ছায়া যদি প্রতিটি আদালতের দেয়ালে পড়ে, তাহলে সেখানে ন্যায়বিচার আশা করা কঠিন। ফলে বিচারপতিরা হয় নিশ্চুপ, নয়তো নিরাপদ সিদ্ধান্তে অভ্যস্ত।
বিএনপি ও বিকল্প শক্তির বিপর্যয়
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, বিএনপির মতো বৃহৎ একটি গণদল আজ সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল। একদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের দমন, অন্যদিকে নিজেদের ভেতরের বিভক্তি দলটিকে কার্যত অচল করে ফেলেছে। তৃণমূল ও কেন্দ্রের মধ্যে ভাষাগত, মানসিক ও সাংগঠনিক দূরত্ব দিন দিন প্রকট হচ্ছে। গ্রুপিং, অবিশ্বাস এবং সমন্বয়হীনতার ফলে জামায়াত ও ইসলামপন্থি শক্তিগুলো নতুন করে পা রাখছে মাঠে
সাম্রাজ্যবাদ, কূটনীতি ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ আজ আর নিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা পরাশক্তি দেশটিকে নিজেদের বলয়ের মধ্যে রাখতে মরিয়া। ফলে আমরা হয়ে উঠেছি ‘মাল্টি-অ্যালাইনড’ এক রাষ্ট্র- যার নিজের কূটনৈতিক নীতি নেই, কেবল প্রতিক্রিয়া আছে। এই আন্তর্জাতিক কৌশলের সুযোগে সরকার দেশে গণতন্ত্রকে দুর্বল করে, উন্নয়নের গল্পে নিজেদের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করছে; কিন্তু এই আপসকামী রাজনীতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে সাধারণ মানুষকে।
একটি অপ্রকাশিত ষড়যন্ত্র: পিআর নির্বাচন ও শাসকচতুরতা
সরকার যেকোনো মূল্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন পিআর (Proportional Representation) পদ্ধতিতে করতে চায়। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের শ দেড়েক প্রার্থীকে সংসদে আনার সুযোগ করে দেওয়া। এতে সরকারের "সহনশীলতা" দেখানোও হবে, আবার মৌলবাদীদের সঙ্গে আপোষের জায়গাও তৈরি হবে। যদি পিআর পদ্ধতিতে না পারা যায়, তাহলে নির্বাচন ঝুলিয়ে দেওয়া হবে- উসিলা তৈরি করে। হয়ত সহিংসতা, হয়ত জরুরি অবস্থা, কিংবা ভুয়া সংলাপের নামে বিলম্ব।
ধরা যাক, বিদ্যমান ভোটিং সিস্টেমেই বিএনপি ক্ষমতায় এলো; কিন্তু তারা দেখবে- রাষ্ট্রব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো যে তাদের পক্ষে দেশ চালানো কার্যত অসম্ভব। প্রশাসন, অর্থনীতি, আইন- সবই থাকবে অন্যের নিয়ন্ত্রণে। তখন হয় তারা নিজেই আবার নতুন নির্বাচনের পথে যাবে, না হয় আরেকটি অভ্যুত্থানে তাদের পতন হবে।
এই দুই পরিণতিই এক দীর্ঘ প্রতিহিংসার রাজনীতির অংশ। অথচ এর বাইরেও একটি সহজ, সম্মানজনক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাধান আছে- একটি নিরপেক্ষ, জনআস্থাপূর্ণ নির্বাচনি কাঠামো- যেখানে প্রশাসন, কমিশন, বিচারব্যবস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনী জনগণের আস্থার জায়গায় দাঁড়াবে। কিন্তু এই পথ হয়ত আমাদের কপালে নেই।
উত্তরণের পথ: সাহস, শিক্ষা, সংগঠন
এই সংকট থেকে বের হওয়ার কোনো শর্টকাট নেই। আমাদের দরকার-
১. নৈতিক সাহস: সত্য বলার ও দাঁড়িয়ে থাকার মনোবল
২. রাজনৈতিক শিক্ষা: নাগরিককে জানতে হবে, বোঝাতে হবে
৩. সংগঠন: রাজনীতি ফেসবুকে হয় না- হয় মাঠে, মানুষের পাশে
এই তিনটির ঘাটতির কারণেই আন্দোলন ব্যর্থ হয়, বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হয় না, আর দমননীতির বিরুদ্ধে জয়ের সম্ভাবনাও হারিয়ে যায়।
প্রতারণা না হোক আমাদের ভবিষ্যৎ
সেই সামরিক শাসকের ঘোষিত ‘কঠিন রাজনীতি’ এখন বাস্তবতা। কিন্তু এই কঠিনতাকে ভাঙা সম্ভব- যদি সত্য বলার সাহস, রাজনৈতিক সংগঠন গড়া, এবং ন্যায়ভিত্তিক আন্দোলনের পথে আমরা হাঁটি। জনগণ এখনো জেগে আছে। তাদের হৃদয়ে এখনো স্বপ্ন জ্বলছে। সেই স্বপ্ন যেন আবার প্রতারিত না হয়- এই হোক আমাদের সংগ্রামের মূলমন্ত্র। আমি বহুবার বলেছি, আবারও বলি- আমাদের জীবদ্দশায় এই দেশে শান্তি আসবে না।
আমরা শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য চিৎকার করেই মরব। আমাদের সন্তানেরা কী পাবে, জানি না। তারা কি আমাদের মতোই বিভ্রান্তি, গুলি আর প্রতারণার মধ্য দিয়ে বড় হবে? নাকি একদিন সত্যিকার শান্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে তারা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবে? জানি না। শুধু জানি- আমরা চিৎকার করেই হারিয়ে যাব।
হাবীব ইমন: কলামিস্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে