Views Bangladesh Logo

নিছকই দুর্ঘটনা নয়, এটি চরম অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড

Rased Mehedi

রাশেদ মেহেদী

ক বছর আগে ফার্মগেট এলাকাতেই মেট্রোরেল লাইনের স্থাপনা থেকে প্রথমবার বেয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। সেবার কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। আর গুরুত্ব দিয়ে না দেখার কারণে এক বছরের ব্যবধানে সেই একই স্থানে আবারও খুলে পড়ল বেয়ারিং প্যাড এবং মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হলেন এক তরতাজা যুবক। স্বামীকে হারালেন স্ত্রী, অনাথ হয়ে গেল তার দুই শিশু। আর সরকার তার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করল ৫ লাখ টাকা! শুধু তাই নয়, এ ধরনের যে প্রতিষ্ঠানের দায়-দায়িত্বহীনতার কারণে একই ধরনের দুর্ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটল, সেই ডিএমটিসিএলের সাবেক এমডিকে প্রধান করে গঠিত হলো তদন্ত কমিটি! সরকারি এ দুটি সিদ্ধান্তই নাগরিকের সঙ্গে চরম প্রহসন এবং ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেবে।

দ্বিতীয়বার বেয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার পর বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ধরনের মতামত দিয়েছেন। কেউ বলেছেন নির্মাণকালে নকশার ত্রুটি থাকতে পারে। কেউ বলেছেন, নিম্নমানের বেয়ারিং প্যাড ব্যবহার করা হতে পারে, কেউ বলেছেন যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামতটি হচ্ছে, এক বছর আগে প্রথমবার বেয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার পর কেন ডিএমটিসিএল তার কারণ সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারল না? প্রথমবার ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বেয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার পর এটাকে নকশা কিংবা নির্মাণজনিত ত্রুটি হিসেবে মেনে নেয়া যায়; কিন্তু এক বছর পর যখন একই প্রকল্পের সেই একই লাইন (লাইন-৬) এলাকায় দ্বিতীয়বার বেয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে, তখন শুধু নকশার ত্রুটি কিংবা নির্মাণকালে নিম্নমানের বেয়ারিং প্যাডের অভিযোগ মেনে নেয়া যায় না। এ দুর্ঘটনার দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ডিএমটিসিএলের দায়িত্বশীলদের। বিশেষ করে অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স বিভাগ এবং লাইন-৬ এর প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা কোনোভাবেই এ দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।

এক বছর আগে বেয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার পর নিশ্চয় একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। সেই কমিটির রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা ছিল অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স বিভাগের। দ্বিতীয়বার দুর্ঘটনার পর এটা স্পষ্ট যে ডিএমটিসিএলের এই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগটি কোনো দায়িত্বই পালন করেনি। বরং গত রোববার দ্বিতীয় দুর্ঘটনার পর সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে গত বছর প্রথমবার দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ডিএমটিসিএলের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. আব্দুল বাকী মিয়া বলেন, ‘ওই সময় বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছিল। কী কী সুপারিশ করা হয়েছিল, এখন তা মনে নেই।’ (সূত্র: দৈনিক আজকের পত্রিকা-২৮ অক্টোবর, ২০২৫)। এই হচ্ছে অবস্থা! অতএব দ্বিতীয়বার দুর্ঘটনা এবং একজন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য অবশ্যই ডিএমটিসিএলের দায়িত্বশীল সবাই দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে এখনই প্রাথমিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, এর জন্য তদন্ত কমিটির দরকার হয় না।

বরং তদন্ত কমিটি সুস্পষ্টভাবে বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনার কারণ নির্ধারণ করুক এবং ডিএমটিসিএলের কর্কমকর্তাদের দায়-দায়িত্বহীনতার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরুক, যার মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত শান্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। মেট্রোরেল প্রকল্প বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে সে সময়ে সব মেগা প্রকল্পে অ্যাডমিন ক্যাডার কর্মকর্তাদের ভয়াবহ দৌরাত্ম্য দেখা গেছে। টেকনিক্যাল প্রকল্পগুলোতেও প্রেষণে অ্যাডমিন ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যেমন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরবর্তী সময়ে ডিএমটিসিএলের দুজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকাই ছিলেন নন-টেকনিক্যাল কর্মকর্তা। এমনকি নির্মাণকালীন সময়ে লাইন-৬ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আফতাবউদ্দিন তালুকদারও ছিলেন নন-টেকনিক্যাল কর্মকর্তা!

সে সময় শর্তই দেওয়া হয়েছিল অ্যাডমিন ক্যাডারের সচিব সাহেব ছাড়া কেউ ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে পারবেন না। এ ধরনের অপরিণামদর্শী উদ্ভট সিদ্ধান্ত শুধু মেট্রোরেল নয় বরং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পেও দেখা গেছে। বিআরটি প্রকল্পেও নির্মাণ পর্যায়ে গার্ডার ভেঙে পড়ে আরও বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অ্যাডমিন ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে একজন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা অবশ্যই ইতিবাচক; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় আট মাস পরও প্রথমবার বেয়ারিং প্যাড খুলে যাওয়ার ঘটনার বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেননি। একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিও আমলতান্ত্রিক পদে বসার পর দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে যান!

প্রথমবার দুর্ঘটনার পরই বেয়ারিং প্যাড কেনা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠেছিল। একাধিক সংবাদমাধ্যম কারণ অনুসন্ধান করে বিস্তারিত প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনগুলোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যখন ইতাল-থাই নামক কোম্পানির কাছ থেকে বেয়ারিং প্যাডগুলো কেনা হয়, তখনই বুয়েটের পরীক্ষায় কিছু কিছু প্যাড মানোত্তীর্ণ বিবেচিত হয়নি। তারপরও সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, কেন? প্রথমবার বেয়ারিং প্যাড খুলে যাওয়ার পর তদন্ত কমিটির এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা উচিত ছিল। তাহলে নির্মাণকালীন সময়ে প্রকল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ ক্রয় নিয়ে দুর্নীতির আরও প্রমাণ পাওয়া সম্ভব হতো। একই সঙ্গে এ ধরনের মানহীন বেয়ারিং প্যাড আরও কোথায় বসানো হয়েছে সেটা নির্ধারণ করে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে দ্বিতীয়বার দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।

অথচ লাজ্জাজনক হচ্ছে, দ্বিতীয়বার দুর্ঘটনার পরও ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা জানালেন, ইতাল-থাই কোম্পানির কাছ থেকে কেনা বেয়ারিং প্যাড ছাড়া আর কোনো প্যাড স্টকে নেই এবং বেয়ারিং প্যাড খুলে পড়া অংশে এই কোম্পানির প্যাড দিয়েই তা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কতটা নির্বিকার ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা! নতুন করে পুরোনো সেই কোম্পানির ত্রুটিপূর্ণ বেয়ারিং প্যাড ব্যবহার করার কারণে আরও একটি দুর্ঘটনা এবং হতাহতের আশঙ্কার মধ্যে রাখা হলো রাজধানীতে চলাচল করা কোটি মানুষকে। অথচ সে কথা কত নির্বিকারভাবে বললেন কর্মকর্তারা। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের জীবনের মূল্য সবচেয়ে কম। এ কারণে অবলীলায় একটি দুর্ঘটনার পর সেটি মেরামত কার্যক্রম হয় আরও একটি বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি করে! অথচ সভ্য কোনো দেশ হলে দুর্ঘটনার ন্যূনতম কোনো ঝুঁকি থাকলেও সে অংশ দিয়ে ট্রেন চলাচল কিংবা নাগরিকদের চলাচল করতে দেওয়া হতো না।

এই ইতাল-থাই কোম্পানি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজও করেছে এবং করছে। জাপানি ঠিকাদারি কোম্পানি মূল কাজের দায়িত্বে থাকলেও মেট্রোরেল প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের কাজ করেছে একাধিক সাব-ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। যেমন ইতাল-থাই প্রকল্পের বড় অংশের কাজ করেছে। অবশ্য আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত অংশ নির্মাণের দায়িত্বে ছিল দেশীয় প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড। অতএব, ফার্মগেট এলাকায় প্রথমবার বেয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার পরই আব্দুল মোনেম লিমিটেডকেও প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করানো উচিত ছিল ডিএমটিসিএলের; কিন্তু সেটাও করা হয়নি। বিশেষ করে বেয়ারিং প্যাড সরবরাহকারী ইতাল-থাই কোম্পানিকে বাধ্য করা উচিত ছিল পুরো মেট্রোরেল লাইনের বেয়ারিং প্যাড নতুন করে পরীক্ষা করা এবং স্টকে থাকা প্যাডগুলো নতুন করে পরীক্ষা করে সেগুলো মানোত্তীর্ণ বিবেচিত হলে রেখে দেয়া, আর না হলে প্রতিস্থাপনে বাধ্য করা।

একই সঙ্গে প্রকল্পের জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও বাধ্য করা নকশাজনিত ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা; কিন্তু কোনটিই না করে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষই আরও একটি প্রাণঘাতী বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছেন। এ কারণে একজন তরুণের মর্মান্তিক মৃত্যু শুধুই মৃত্যু নয়, বরং একটি দায়িত্বে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। এবারের তদন্ত কমিটির উচিত সেভাবেই বিবেচনা করা। আর ৫ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ আর একটি চাকরিই শেষ কথা হতে পারে না। একটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার ক্ষতিপূরণ কত হতে পারে, সেজন্যও একটি ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ কমিটি করে সে অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। সর্বোপরি যদি দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া না নয়, তাহলে প্রমাণিত হবে, আরও একটি বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কাই শুধু জিইয়ে রাখা হচ্ছে।

রাশেদ মেহেদী: সম্পাদক, ভিউজ বাংলাদেশ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ