Views Bangladesh Logo

বিপজ্জনক ডাউকি-মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দেশ

বাংলাদেশের নিচে টেকটনিক প্লেটে বিশেষ করে ডাউকি ও মধুপুর ফল্টে প্রায় ৪০০ বছর ধরে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। শক্তিশালী এই চাপ মুক্তির সময় যে ভূমিকম্প হবে, তার মাত্রা রিখটার স্কেলে পৌঁছতে পারে ৮-এ। এতে ঢাকাসহ বাংলাদেশের মধ্য, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হবে। হতাহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে অতীত সব রেকর্ড। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেমন্ট-ডোহের্টি আর্থ অবজারভেটরির ভূতাত্ত্বিক বিভাগ চলতি বছরের জুনে এক গবেষণাপত্রে এ তথ্য জানায়।

বাংলাদেশ তিনটি গতিশীল প্লেটের (ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা প্লেট) সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই প্লেটগুলোর পারস্পরিক নড়াচড়ার কারণে টেকটোনিক ফাটল তৈরি হয়, যা ফল্ট নামে পরিচিত। এই ফল্টগুলোই ভূমিকম্পের প্রধান কারণ। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্র জানায়- বাংলাদেশে প্রধান যে কয়েকটি ভূমিকম্প ফল্ট বা ভূ-চ্যুতি রয়েছে, তার মধ্যে ডাউকি ফল্ট অন্যতম। এটি দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বিশেষ করে সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক। এ ছাড়াও ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্ট, টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত ফল্ট লাইন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ফল্ট রয়েছে, যা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চলকে একটি বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

ডাউকি ফল্টে ১৭৮৭ সালের শক্তিশালী ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। আবার এর ১১০ বছর পর ১৮৯৭ সালে ‘গ্রেট ইন্ডিয়া আর্থকোয়েক’নামে পরিচিতি ভূমিকম্পও হয় এই ফল্টে। এর ফলে আসাম, মেঘালয় ও ঢাকা শহর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডাউকি ফল্ট ভারতের শিলং মালভূমি থেকে বাংলাদেশের সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের দিকে বিস্তৃত। এই ফল্ট লাইনটি বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং এই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। এরপরই রয়েছে রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৭০ মাইল দূরে অবস্থিত মধুপুর ফল্ট। ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে এই ফল্টে সাড়ে ৭ মাত্রার বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল্ট যা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত। এছাড়া রয়েছে টেকনাফ-মিয়ানমার ফল্ট লাইন। এখানে ১৭৬২ সালে ৮.৫ মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল। এই ভূমিকম্পের ফলে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার উপরে উঠে এসেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের ফল্টও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রাঙামাটি ও বান্দরবানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু ছোট ফল্ট নিয়ে এর গঠিত এ ফল্ট লাইন ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পরিণত করেছে। তবে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কোনো ফল্ট না থাকায় খুলনা ও বরিশাল বিভাগ ভূমিকম্পের জন্য তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ।

চলতি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে দেশে দুটি মাঝারি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর একটির মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৯ ও আরেকটির ৪। দ্বিতীয় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের অভ্যন্তরে সিলেটের ছাতকে। এটি ডাউকি ফল্টের অন্ততর্গত। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দু–তিনটি ৪ বা এর চেয়ে কিছু বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয় এই অঞ্চলে। তাই বলাই যায় এলাকাটি ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রুবাইয়াত কবীর ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকায় ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হবার মতো ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা বা ফল্টলাইন নেই। তবে ঢাকার অদূরে (৬০ কিলোমিটার দূরে) মধুপুর অঞ্চলে ৭ থেকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো ফল্টলাইন আছে। আর সেখানে এমন মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সিলেট ও ময়নমনসিংহ অঞ্চলের ডাউকি ফল্টে ৮ বা তারও বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এটি হলে ওই অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থানই পাল্টে যেতে পারে। আর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হবে ভয়াবহ।’
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘ঢাকা শহর ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে নরম ও লাল মাটি রয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর বেশিরভাগ আবাসিক এলাকা বিভিন্ন ধরনের জলাশয় ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে। আর ভরাট করা ও নরম মাটিতে কম মাত্রার ভূমিকম্পের কম্পনেও তরঙ্গ অনেক বেশি হয়। অন্যদিকে ঢাকার বেশিরভাগ ভবন মাঝারি বা তীব্র ভূমিকম্প প্রতিরোধক নয়। তাই এই শহরে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হবে। অন্যদিকে সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর অঞ্চলে শক্ত মাটি থাকলেও সেখানে হতে পারে ৮ বা তার চেয়েও বেশি মাত্রার ভূমিকম্প। এতে করে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থানই পাল্টে যেতে পারে। এই অঞ্চলে নেমে আসতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়।’

রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা- ১ থেকে ৪ দশমিক ৯৯ মৃদু, ৫-৫ দশমিক ৯৯ মাঝারি, ৬-৬ দশমিক ৯৯ তীব্র, ৭-৭ দশমিক ৯৯ ভয়াবহ এবং ৮-এর ওপর হলে তাকে বলে অত্যন্ত ভয়াবহ। বুয়েটের গবেষকদের ভূ-কম্পন নিয়ে এলাকাভিত্তিক মানচিত্রে বাংলাদেশকে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে জোন-১। দেশের ৪৩ শতাংশ এলাকা এর আওতাভুক্ত।

সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কক্সবাজারের কিছু অংশসহ পদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকা রয়েছে জোন-১-এ। মাঝারি মাত্রার ঝুঁকিতে থাকা জোন-২-এর আওতায় আছে- ঢাকা, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ফেনী, নাটোর, মাগুরা মানিকগঞ্জ, মেহেরপুর ও রাজশাহী অঞ্চল। যা দেশের ৪১ শতাংশ এলাকা। এ ছাড়া ভূমিকম্পের নিম্ন ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ১৯ শতাংশ এলাকা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা বিভাগ ও বরিশাল বিভাগসহ এসব অঞ্চলের দ্বীপ ও চরগুলো ভূমিকম্পের সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে আছে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ