মিথ্যা মামলাকারীর বাধ্যতামূলক সাজা 'যুগান্তকারী বিধান'
সম্প্রতি ফৌজদারি কার্যবিধি (সংশোধন) আইন ২০২৫ অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত সংশোধিত আইনে মিথ্যা মামলার সাজার ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘কোনো কারণে মিথ্যা মামলা প্রমাণিত হলে মামলাকারীকে বাধ্যতামূলক সাজা দিতে হবে। এক্ষেত্রে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড হবে।’ এই বিধান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা। নতুন এই বিধান মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ বা কমিয়ে আসতে সাহায্য করবে বলেও জানিয়েছেন তারা।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি সারা দেশে মিথ্যা বা গায়েবি মামলার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। বিভিন্ন মামলার প্রাথমিক তদন্তে তা প্রমাণিত হয়েছে। আবার অনেক মামলায় বহু নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে শত্রুতাবশত কিংবা টাকার জন্য। এ কারণে মিথ্যা মামলা ও নিরপরাধ আসামিদের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধি (সংশোধন) আইন ২০২৫-এ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সংশোধনীতে মিথ্যা মামলার সাজার ব্যাপারে বলা হয়েছে,‘কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি মিথ্যা মামলা করেন বা সত্য মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করেন এবং তা যদি প্রমাণিত হয়- তাহলে মামলাকারীকে বাধ্যতামূলক সাজা দিতে হবে। এক্ষেত্রে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড হবে।’ এক্ষেত্রে আগের আইনে বলা ছিল- ‘কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি মিথ্যা মামলা করেন বা সত্য মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করেন এবং তা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে ভুক্তভোগী চাইলে সংশ্লিষ্ট মামলার বাদীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবেন। এক্ষেত্রে মিথ্যা মামলাকারীর সাজা হবে অনধিক এক বছর ও অর্থদণ্ড হবে ৫০ হাজার টাকা। তবে এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর অভিযোগ করতে হবে।’
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়- সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে ৫৪ ধারায় পুলিশের গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা অবারিত থাকছে না। কগনিজেবল অফেন্স পুলিশের সামনে ঘটতে হবে বা পুলিশকে সন্তুষ্ট হতে হবে যে আসামি এই অপরাধ করেছে। সন্তুষ্টির কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে। পুলিশকে পরিচয় প্রকাশ করে গ্রেপ্তার করতে হবে। গ্রেপ্তার করলেই মেমোরেন্ডাম অব অ্যারেস্ট পূরণ করতে হবে পুলিশকে। গ্রেপ্তারকৃতের সব আইনি সুরক্ষা প্রতিপালিত হয়েছে কি না, মেমোরেন্ডাম অব অ্যারেস্টে তার চেকলিস্ট পূরণ করতে হবে যা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তারকৃতের পরিবারকে যত দ্রুত সম্ভব (কমপক্ষে ১২ ঘণ্টার মধ্যে) জানাতে হবে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দিতে হবে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি বা রিমান্ডের পর আসামি অসুস্থ বা আহত হলে তাকে ডাক্তার কর্তৃক পরীক্ষা করতে হবে এবং আঘাতের কারণ নিশ্চিত হতে হবে, তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে হবে। এক্ষেত্রে পুলিশের দায় থাকলে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। কোনোভাবে ১৫ দিনের বেশি পুলিশ রিমান্ড দেয়া যাবে না।
সংশোধিত আইনে আরও বলা হয়েছে, সাক্ষী ও ভিকটিমের সুরক্ষায় আদালত প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারবে। আদালত সাক্ষীর প্রয়োজনীয় খরচ দিতে পারবে। এক মামলায় পুলিশ রিমান্ড কোনোভাবে ১৫ দিনের বেশি দেয়া যাবে না, আগে আনলিমিটেড দেয়ার সুযোগ ছিল। যে সংস্থাই গ্রেপ্তার করুক না কেন, গ্রেপ্তারের তথ্য সংশ্লিষ্ট থানায় জিডিভুক্ত করতে হবে। প্রত্যেক থানায় ও জেলা বা মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে প্রতিদিনের গ্রেপ্তারের তথ্য ও তালিকা প্রদর্শন করতে হবে।
এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ইদানীং মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে গেছে। গত জুনে পুলিশের এক তদন্তে বিষয়টি উঠে এসেছে। এমন অবস্থায় ফৌজদারি কার্যবিধিতে সংশোধন এনে তাকে মিথ্যা মামলার বাদীর বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলক শাস্তির বিধান যুক্ত করা খুবই যৌক্তিক বলে মনে করি। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই বিধান খুবই কার্যকর হবে।’
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ফিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এ ব্যাপারে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় আবার অনেক সময় সত্য মামলায় মিথ্যা আসামি অর্থাৎ নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। দুটোই জঘন্য অপরাধ। একজন নিরপরাধ মানুষের জীবন শেষ করে দিতে পারে এমন মামলা। তাই মিথ্যা মামলার বাদীকে বাধ্যতামূলক শাস্তির আওতায় আনার বিধান জরুরি ছিল। এটা আরও আগেই করা হলে সম্প্রতি এমন ঢালাও গায়েবি মামলা বা গায়েবি আসামি করার ঘটনা ঘটতো না।’
মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘মিথ্যা মামলা প্রমাণিত হলে মামলাকারীকে বাধ্যতামূলক সাজা দিতে হবে এমন বিধান যুক্ত করে ফৌজদারি কার্যবিধির যে সংশোধনী আনা হয়েছে তা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ফলে এখন থেকে মিথ্যা বা গায়েবি মামলা দায়ের করা ও নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে বলে আশা করছি।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সম্প্রতি পুলিশের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- সারা দেশে মিথ্যা বা গায়েবি মামলার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। অনেক মামলায় বহু নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে শত্রুতাবশত কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা থেকে নাম প্রত্যাহারের জন্য টাকা আদায় করতে। এ কারণে মিথ্যা মামলা ও নিরপরাধ ব্যক্তিদের সুরক্ষা দিতে মিথ্যা মামলার বাদীর শাস্তি বাধ্যতামূলক করে ফৌজদারি কার্যবিধি (সংশোধন) আইন ২০২৫ অনুমোদন করেছে সরকার। এটা ন্যায়বিচারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে