Views Bangladesh Logo

যৌতুক-জখমের বাধ্যতামূলক সালিশের বিধানে আইনজ্ঞদের উদ্বেগ

যৌতুকের জন্য নির্যাতনের মামলা আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচার হলেও গত ২৫ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ জারি করে তা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারের বিধান করা হয়। আর এবার সেটাও পরিবর্তন করে সালিশ বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির বিধান করা হয়েছে।


সম্প্রতি ‘আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে সরকার। সংশোধিত এই আইনের ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারার অপরাধের ক্ষেত্রে যৌতুক চাওয়া ও এর জন্য ‘অল্প’ নির্যাতনের শিকার নারীকে মামলার আগে মধ্যস্থতার পথে হাঁটতে হবে। অর্থাৎ কোনো নারীকে তার স্বামী অথবা স্বামীর পক্ষের কোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম (simple hurt) করলে তাকে মামলা না করে বাধ্যতামূলক লিগ্যাল এইড অফিসে সালিশ বা মধ্যস্থতার দ্বারস্থ হতে হবে। এ ধরনের বিধান ভুক্তভোগী নারীর দ্রুত ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা।

আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুযায়ী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারার অপরাধের ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার নারীকে মামলার আগে মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ধারা ৩ ও ৪-এ বর্ণিত যৌতুক সম্পর্কিত অভিযোগ এবং ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ধারা ১১(গ)-তে বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতন সম্পর্কিত অভিযোগের ক্ষেত্রেই নতুন এই সিদ্ধান্ত গত ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার নারীর মামলায় কোনো বাধা নেই। তবে নির্যাতন ও আঘাতের মাত্রা বিবেচনায় ভিন্ন শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারার অপরাধের ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার নারীকে মামলার আগে মধ্যস্থতার আশ্রয় নিতে হবে।

এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য উক্ত নারীকে সাধারণ জখম (simple hurt) করলে তার শাস্তি অনধিক পাঁচ বছর; কিন্তু অন্যূন দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড। উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডও হবে।’ আর নতুন অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘এখন থেকে এ ধরনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার নারী সরাসরি মামলা করতে পারবেন না। তাকে প্রথমে লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে আবেদন করতে হবে। সেখানে মধ্যস্থতা ব্যর্থ হলে যে কোনো পক্ষ মামলা করতে পারবে।’

এদিকে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ গত ২৫ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে। এই অধ্যাদেশে ৩৫ ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, যৌতুকের কারণে সাধারণ জখমের ১১(গ) ধারায় করা মামলা এখন থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হবে। ১১(গ) ধারায় বর্ণিত অপরাধ প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট গ্রহণ করবেন ও বিচার করবেন। তবে এই অধ্যাদেশ কার্যকর হওয়ার আগে ১১(গ) ধারায় মামলা যেভাবে পরিচালিত হচ্ছিল, সেভাবেই হবে। ওই সব মামলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বদলি হবে না। এ ধারার মামলা আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পরিচালনা হতো। আর আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশের বলে এ সংক্রান্ত বিষয় মীমাংসা করতে হবে লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতার মাধ্যমে। শুধু যৌতুক ও নির্যাতনই নয়, এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেক ডিজঅনার, ভাড়া সংক্রান্ত বিরোধ, বণ্টন মামলা, পিতা-মাতার ভরণপোষণ, জমি-বাড়ি, পাওনা টাকা ও ক্ষতিপূরণের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর ফৌজদারি বিষয়ে সরাসরি আদালতে মামলা করা যাবে না। আগে যেতে হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার লিগ্যাল এইড অফিসে।

মানবাধিকার নেত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এলিনা খান ভিউজ বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ১১(গ) ধারার অপরাধটিকে বাধ্যতামূলক মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার আওতায় আনা হয়েছে। যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম বিষয়ে সরাসরি মামলা করতে না পারা ও লিগ্যাল এইডে মধ্যস্থতা ভুক্তভোগী নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। এতে বিচারপ্রার্থী হয়রানির শিকার হবেন এবং বিচারপ্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা আরও বাড়বে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী ভুক্তভোগীকে সরকার অনুমোদিত হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা ও সনদ নিতে হবে, হাসপাতাল থেকে তাকে পাঠানো হবে থানায়। এখন নতুন বিধান অনুসারে ভুক্তভোগীকে হাসপাতালে না গিয়ে আগে যেতে হবে লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার কাছে। এমন হলে চিকিৎসা সনদ না থাকার কারণে পরে সাধারণ জখমের অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যাবে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার নেত্রী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশে আইনি সহায়তার কাঠামো এখনো গড়ে উঠেনি। তাই যৌতুকের কারণে নির্যাতিত নারীকে সরাসরি মামলা করার ক্ষেত্রে বাধা দেয়া হলে আইনি প্রতিকার থেকে তারা বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ১০৯ হেল্পলাইনে পারিবারিক সহিংসতা সম্পর্কিত ৪ লাখ ৬০ হাজার ৩৫৮টি ফোনকল আসে। এমন অবস্থায় লিগ্যাল এইডের সীমিত জনবল নিয়ে দেশে এত বিপুলসংখ্যক যৌতুক ও এর কারণে নির্যাতনের ঘটনা নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। এতে করে অভিযোগের জট আরও বাড়বে। নষ্ট হবে সময়। শেষ পর্যন্ত মামলায় যেতেই হবে। তাই আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ আরও পরিকল্পিতভাবে সংশোধন করে মানুষের দ্রুত ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘যৌতুকের জন্য সাধারণ জখমের অপরাধটি উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে ২০২০ সালে আপসযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। এই আপস প্রক্রিয়াকে অর্থবহ করতে মধ্যস্থতার জন্য আনা হয়েছে নতুন বিধান। এতে নারীর অধিকার সুসংহত হবে। নতুন আইনে লিগ্যাল এইড অফিসে আবেদনের যে বিধানটি আনা হয়েছে সেটিও একটি আইনি প্রক্রিয়া। আর আপস ব্যর্থ হলে ভুক্তভোগী নারীর মামলার অধিকার তো থাকছেই। বরং আদালতে মামলা জট কমাতে ও বিচার প্রক্রিয়া সহজ করতে এই বিধান কাজ করবে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ