মাহফুজা খানম: এক মহীরুহের মহাপ্রস্থান
একটি তারার প্রস্থান, একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের সমাপ্তি। শিক্ষাবিদ, নারীনেত্রী, সমাজসেবী, মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী ভিপি অধ্যাপক মাহফুজা খানম আজ মঙ্গলবার সকালে পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সহধর্মিনী অধ্যাপক মাহফুজা খানমের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তার প্রাণবন্ত পদচারণায় মুখর থাকা প্রতিটি ক্ষেত্রে।
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এর প্রথম ভিপি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ছিলেন অধ্যাপক মাহফুজা খানমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তারা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম রাজনৈতিক বলয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। মাহফুজা খানমের মৃত্যুতে ভীষণ মর্মাহত মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘খবরটা (মাহফুজা খানমের মৃত্যু) শুনে আমি আরও অসুস্থ হয়ে গেছি। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।’ নিজেকে কিছুটা সামলে তিনি বলেন, ‘মাহফুজা খানমের মতো এত আন্তরিক ও প্রাণবন্ত মানুষ আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি। যেখানেই তার পদচারণা সেখানেই তার সফলতা।
সেটা হোক ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষকতা, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা পারিবারিক জীবন।’ মাহফুজা খানমের বিষয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আরও বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে শিক্ষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারি একজন ছিলেন মাহফুজা খানম। এর সুবাদে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মনোনয়ন পেয়ে ১৯৬৬-৬৭ মেয়াদে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। তখন পরোক্ষ নির্বাচনে ভিপি নির্বাচন হতো। এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ও সংগ্রামী সাহসী মাহফুজা খানম স্বাধীনতার পর সক্রিয় রাজনীতি না করলেও সারা জীবন বামপন্থি মতাদর্শ ধারণ করে গেছেন। ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে বিয়ের পর তার রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা আরও জাগ্রত হয়।’
সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী, আইনি সহায়তা সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের ট্রাস্টি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্নাও ছিলেন মাহফুজা খানমের ঘনিষ্ঠ। তিনি মাহফুজা খানমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘মাহফুজা খানমের ছিল এক বর্ণাঢ্য জীবন। তিনি ছিলেন নারীনেত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক ও ডাকসুর একমাত্র নারী ভিপি। শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখায় ২০২১ সালে একুশে পদক পান মাহফুজা। এমন বর্ণাঢ্য জীবনের বাইরে তিনি ছিলেন একজন ভালো মানুষ। এত সরল, এত আন্তরিক, এত দয়ালু। তাদের ইন্দিরা রোডের বাসায় গেলে কখনো ভাত না খাইয়ে আসতে দিতেন না। ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ আর মাহফুজা খানম দুজনেই মানুষকে শ্রদ্ধা করতে জানেন। কখনো ফোন করলে মাহফুজা খানম শুরুতেই বলতেন, পান্না ভাই বাসায় আসেন না কত দিন হলো..। এখন তো মাহফুজা খানমই আর বাসায় নেই....।
মাহফুজা খানমের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৪ এপ্রিল কলকাতায়। তিনি বাংলাবাজার গার্লস স্কুলে পড়েছেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও ১৯৬৭ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে লন্ডন সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেলেও তৎকালীন মোনায়েম খান সরকার তাকে পাসপোর্ট দেয়নি। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মনোনয়ন পেয়ে ১৯৬৬-৬৭ মেয়াদে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে দুই পুত্র ও এক কন্যা রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রেখে যুদ্ধাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন মাহফুজা খানম। ২০১২ সালে নারী শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বেগম রোকেয়া পদক, ২০১৩ সালের ২৬ আগস্ট ‘অনন্যা শীর্ষ দশ ২০১৩’ পুরস্কার ও সম্মাননা পান। এ ছাড়াও বাংলাদেশের স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল আর টিভি থেকে "জয়া আলোকিত নারী-২০১৭" পুরস্কার লাভ করেন। ২০২১ সালে শিক্ষা বিভাগে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতায় নিযুক্ত থাকা অধ্যাপক মাহফুজা খানম এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্যও ছিলেন।
এ ছাড়া খেলাঘরসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপারসন এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন মাহফুজা খানম। তার ছেলে ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, ‘তার মা মাহফুজা খানম শারীরিকভাবে মোটামুটি সুস্থই ছিলেন। মঙ্গলবার সকালে অফিসার্স ক্লাবে সাঁতার কাটতে গিয়ে অসুস্থ বোধ করেন। সেখান থেকে পাশ্ববর্তী হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে