Views Bangladesh Logo

টেলিযোগাযোগ খাতের নীতি

অস্তিত্ব বিপন্ন করবে, এমন নীতিমালা চূড়ান্ত হলে আইনগত পদক্ষেপ নেবেন দেশীয় উদ্যোক্তারা

দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে টেলিযোগাযোগ খাতের নতুন লাইসেন্সিং নীতিমালার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হলে এর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ঘোষণা দিয়েছেন ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবি’র সভাপতি আমিনুল হাকিম। আজ শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে টিআরএনবি(টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি) আয়োজিত মত বিনিময় সভায় তিনি এ ঘোষণা দেন। সভায় টেলিযোগাযোগ খাতের বিভিন্ন স্তরের দেশীয় উদ্যোক্তারা অংশ নেন।

সভায় আরও বক্তব্য দেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকটিভিস্ট মাসুদ কামাল, তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির, আবু নাজম তানভীর হোসাইন, সামিট কমিউনিকেশনের চিফ টেকনোলজি অফিসার কে এম তারিকুজ্জামান, বাহন লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার রাশেদ আমিন বিদ্যুত, ফাইবার অ্যাট হোমের চিফ কমিউনিকেশন অফিসার আব্বাস ফারুক, আইসিএক্স অপারেটরদের সংগঠন এওআইবি’র কেন্দ্রীয় নেতা এম নুরুল আলম, আইএসপিএবি’র সাধারন সম্পাদক নাজমুল করিম ভুঁইয়া এবং আইজডব্লিউ অপারেটরস ফোরামের সিইও মুশফিক মনজুর। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন টিআরএনবি’র সাধারন সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন। সভায় সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাবেক সভাপতি ও ভিউজ বাংলাদেশ সম্পাদক রাশেদ মেহেদী।

আমিনুল হাকিম বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে বার বার নতুন নীতি নিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতের দেশীয় শিল্পদ্যোক্তাদের উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু সেটা আমলে নেওয়া হয়নি। বরং শুধুমাত্র বিদেশী তিনটি মোবাইল অপারেটরকে টেলিযোগাযোগ খাতের সব ব্যবসার সুবিধা দিয়ে গাইডলাইন চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এর ফলে এ খাতের সব স্তরের দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারাই ব্যবসা হারিয়ে অস্তিত্বহীন হওয়ার আশংকার মধ্যে পড়ে যাবে। অথচ দেশীয় উদ্যেক্তারা প্রায় ১০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। সুলভ মূল্যে দেশের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিয়েছেন। এখন নীতিমালায় শুধুমাত্র বিদেশী অপারেটরদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হলে ইন্টারনেটের দাম কমপক্ষে ২০ শতাংশ বাড়বে এবং প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ কার্যত ইন্টারনেট বঞ্চিত হবে।


তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেন, যদি শেষ পর্যন্ত দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করা ধারাগুলো রেখেই গাইডলাইন চূড়ান্ত করা হয় তাহলে এর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এ সরকারের সময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের মত গুরুত্বপূর্ণ খাতে কোন সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া না হলেও টেলিযোগাযোগ খাতে কার স্বার্থে তড়িঘড়ি করে এত সংস্কারের পদক্ষেপ কেন, তা অবশ্যই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, এ সরকার কোন বিবেচনায় কোন কাজ করছে সেটা বোঝা মুশকিল। এ সরকারের কোন কাজে কি ধরনের ক্ষতি হচ্ছে সেটা ধরিয়ে দিলেও তা কানেই তোলে না। অর্থাৎ তারা যেটা বোঝেন সেটাই করবেন, কারও কথা শুনবেন না, এটাই দাঁড়িয়েছে। এ কারনে এখন ভাল কিছুর জন্য নির্বাচিত সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই। তিনি নিজের ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, তিনি গত কয়েক বছরে একাধিক মোবাইল অপারেটরের সিমকার্ড ব্যবহার করে ইন্টারনেট সেবায় কাঙ্ক্ষিত মান পাননি। একাধিক আইএসপি বদল করেও সন্তুষ্ট হওয়ার মত সেবা পাননি।



সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ২০০৮ সালের আইএলডিটিএস পলিসির সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। যে কারনে সংস্কার পদক্ষেপের শুরুতে তিনি সাধুবাদও জানিয়েছিলেন। কিন্তু সংস্কারের একটা পর্যায়ে এসে দেখা গেল সংস্কার হচ্ছে শুধুমাত্র কোন একটি পক্ষের স্বার্থে। এবং এই সংস্কারের ফলে টেলিযোগাযোগ খাতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের অস্তিত্ব ভীষণভাবে সংকটে পড়ছে। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভবিষ্যতে তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় সাইবার নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেখানে দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নীতি গ্রহন করছে, সেখানে বাংলাদেশে একেবারে বিপরীত চিন্তা দেখা যাচ্ছে। এটা কোনভাবেই দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। সরকার শেষ পর্যন্ত এ ধরনের বিতর্কিত গাইডলাইন চূড়ান্ত করবে না বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

আবু নামজ তানভীর হোসাইন বলেন, বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকারের মাত্র এক-দেড় বছর সময়ের মধ্যে টেলিযোগাযোগ খাতে এত বেশী নীতি ও আইনের ড্রাফট এসেছে যে পড়তে পড়তে জেরবার অবস্থা। তিনি বলেন, ভবিষ্যতের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতি বা আইন তৈরি করতে হয়। কিন্তু এ সরকারের আমলে খুব কম সময়ে এত ড্রাফট হয়েছে যেটা নজিরবিহীন। এভাবে কোন নীতিমালা কিংবা আইন কোনটিই যথাযথভাবে করা সম্ভব হয় না। তিনি টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশের খসড়া ২০২৫ এর প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, এখানে ৩৩ নম্বর ধারায় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ লাইসেন্সের ক্ষেত্রে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রী সমন্বয়েী কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র ভূমিকা হবে শুধুমাত্র নথি প্রক্রিয়াজাতকরণ সংস্থা হিসেবে। কারন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ লাইসেন্স বলতে কি বোঝায় তার কোন সংজ্ঞা নাই। এ ছাড়া আগের এনটিএমসি বদলে ক্লিপ নামে নতুন একটি সংস্থা কেন করা হচ্ছে সেটাও বোধগম্য নয়।

কে এম তারিকুজ্জামান বলেন, দেশীয় উদ্যোক্তারাই টেলিযোগাযোগ খাতে সুলভে সেবা নিশ্চিত করার দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করেছেন। এ খাতের ব্যবসায় একটি মোবাইল অপারেটরের মনোপলি ভেঙ্গে দিয়েছেন। এখন নীতি সংস্কারের নামে সেই আগের মনোপলি যুগে ফিরে যাওয়ার পথ তৈরি করা হচ্ছে। সেই পথ তৈরি করতে গিয়ে দেশীয় উদ্যোক্তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করা হচ্ছে, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

রাশেদ আহমেদ বিদ্যুত বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছিল বৈষম্য দূর করার অঙ্গীকার নিয়ে। কিন্তু টেলিযোগাযোগ খাতের নতুন লাইসেন্সিং নীতিতে বিদেশী অপারেটরদের সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়ে এবং দেশীয় উদ্যোক্তাদের সুবিধা বঞ্চিত করে বড় ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি করা হচ্ছে।


আব্বাস ফারুক তার বক্তব্যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতি জোর দেন। তিনি বলেন, এখন দেশীয় উদ্যোক্তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সব স্তরের প্রতিনিধি মিলে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করা উচিত।

মুশফিক মনজুর উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, এরশাদ সরকারের আমলে সঠিক নীতির কারনে দেশের ওষুধ শিল্পে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটেছিল। বিদেশী কোম্পানিগুলোর পরিবর্তে দেশীয় কোম্পানিগুলো বিশ্ব মানের ওষুধ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করে এবং দেশের মানুষ অত্যন্ত কম মূল্যে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ কেনার সুযোগ পায়। এই ধরনের নীতিই টেলিযোগাযোগ খাতে নেওয়া উচিত।

কে এম নুরুল আলম বলেন, ২০০৮ সালের আগে যে একক অপারেটরের মনোপালি ছিল সেই যুগে ফিরে যাওয়ার নীতি আগামী দিনে সামগ্রিকভাবে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকেই পিছিয়ে দেবে।

রাশেদ মেহেদী মত বিনিময় সভার ধারনাপত্র তুলে ধরে বলেন, ২০০৮ সালে আইএলডিটিএস পলিসি তৈরির আগে দেশের টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে দেশীয় উদ্যোক্তা ছিল না বললেই চলে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত একটিমাত্র বিদেশী মোবাইল অপারেটরের হাতে ভয়েস কল, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ, ট্রান্সমিশন সেবা, আন্তর্জাতিক ভয়েস কলের বাজার সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ ছিল। এ কারনে সে সময় এক এমবিপিএস ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ১০ হাজার টাকা। ভিওইপি প্রযুক্তির অবৈধ ব্যবহারের কারনে আন্তর্জাতিক ভয়েস কল থেকে সরকার বিপুল অংকের টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছিল। এখন আইএলডিটিএস পলিসি হালনাগাদ হতে পারে। কিন্তু সেটা একটা অপোরেটরের হারানো মনোপলি ব্যবসা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে হচ্ছে, এমন সংশয়ের সৃষ্টি হলে নীতি প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ