Views Bangladesh Logo

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির অবসান হোক

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কথা দিয়ে লেখা শুরু করি; তিনি বলেছেন, ‘আমরা এমন নির্বাচন চাই, যা দেখে অভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মা তৃপ্তি পাবে।’ তার মতে এই নির্বাচন হবে এমন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ যা জাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। নির্বাচন নিয়ে তিনি আরও বলেছেন, মানুষের ন্যায়বিচার, সমতা, স্বাধীনতা, মর্যাদা নিশ্চিত করতে এবং গণতন্ত্রে মসৃণ রূপান্তরের লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সাধারণ নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার প্রতিটি কথায় বিন্যস্ত ছন্দের শৈল্পিক দোলা থাকা, শ্রোতা মুগ্ধ হয়, ভক্তের সংখ্যা বাড়ে; কিন্তু বিশ্বাস হয় না।

ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের কারণেই অতীতের নির্বাচনগুলো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল- এই কথাটিও প্রধান উপদেষ্টার; কিন্তু তিনি বা তার সরকার কি নিরপেক্ষ? জনগণের ভোটে তিনি নির্বাচিত নন, তার কথা মোতাবেক বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররাই তাকে নিয়োগ দিয়েছে এবং নিয়োগদাতা ছাত্রদের দ্বারা গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপিকে সরকারের তরফ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ উঠেছে।

ড. ইউনূস বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে জামায়াত ইসলাম। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক এবং বৈঠক শেষে বিদেশে বসেই যৌথ প্রেস ব্রিফিং ও যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে একটি দলের প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ হয়েছে মর্মে অভিযোগ করেছে জামায়াতে ইসলাম এবং এর মাধ্যমে ড. ইউনূসের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হওয়ার কথাও উল্লেখ করেছে তারা। জামায়াতে ইসলামের অভিযোগ একেবারে অমূলক নয়, লন্ডনের এই সাক্ষাতের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জামায়াত ও এনসিপির গুরুত্ব কমেছে, বিএনপির গুরুত্ব বেড়েছে। লন্ডন বৈঠকের কারণে জনগণও বুঝতে পেরেছে, বিএনপিই পরবর্তী সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।

মনে হচ্ছে লন্ডন বৈঠকের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃশ্যমান আলোচনা হচ্ছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে; কিন্তু সিদ্ধান্তমূলক অদৃশ্যমান আলোচনা হচ্ছে শুধু বিএনপির সঙ্গে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাহী আদেশগুলো সংসদে পাস করতে হলে বিএনপির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির সঙ্গে নির্বাচনে ঐক্য হবে কি না তা বলার সময় এখনো হয়নি; কিন্তু নির্বাচনোত্তর কালে এনসিপির ওপর ক্ষমতাসীন বিএনপির আশীর্বাদ থাকার আশ্বাস লন্ডন বৈঠকে হয়তো পাওয়া গেছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার বলেছেন, নির্বাচন হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, অর্থাৎ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে। সেনাপ্রধানও একই কথা বলেছেন। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন সহ্য করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এনসিপির কথা না শুনে উপায় নেই, কারণ গণঅভ্যুত্থানে রক্ত দিয়েছে তারা, তারাই ড. ইউনূসকে ক্ষমতায় বসিয়েছে; কিন্তু অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হচ্ছে সব দলের অংশগ্রহণ। আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হলেও তা ‘সাময়িক’- কথাটি উচ্চারণ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস; ‘সাময়িক’ হলেও নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। বহির্বিশ্বের চাপ না থাকলে ‘সাময়িক’ নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনের পূর্বে উঠিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বীকৃতি প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। ড. ইউনূস বা সেনাপ্রধানের কথামতো নির্বাচন ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ না হলে কমপক্ষে ৩০-৩৫ শতাংশ ভোটারের ভোট অন্তর্ভুক্ত হবে না। কারণ ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৮.১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

বাংলাদেশের রাজনীতি ও ভোটে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। অভ্যুত্থানে পতনের পর আওয়ামী লীগ মাঠছাড়া। ফলে এবার ভোটের মাঠ বিএনপির জন্য একেবারেই ফাঁকা, প্রতিদ্বন্দ্বী দল জামায়াতে ইসলাম গোলরক্ষক হলেও বিএনপির শট ঠেকাতে পারবে না। ইসলামপন্থি দলগুলোর জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। জামায়াতে ইসলামের ‘ইসলাম’ নাকি সত্যিকারের ইসলাম নয়- এমন প্রচারণায়ও নেমেছেন অনেক আলেম। জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নতুন, জনগণের পাহাড়সম প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাটতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর জনতার আস্থা ও নির্ভরতায় ধস নেমেছে। বড় বড় চাঁদাবাজিতে এনসিপির কর্মীরাও গ্রেপ্তার হওয়ায় বিএনপির দেশব্যাপী চাঁদাবাজি কিছুটা গৌণ হয়ে পড়ছে। এনসিপির মধ্যেও জাতীয় পার্টির মতো অনৈক্য শুরু

হয়েছে, তাদের সহযোদ্ধারাই এনসিপির বিরুদ্ধে ‘প্রতারণার’ অভিযোগ আনছেন, প্রতিদিন কেউ না কেউ এনসিপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিচ্ছেন। তাদের ওপর সরকারের আনুকূল্য ওঠে গেলে তাদের বিভেদ ও অনৈক্য আরও বেড়ে যেতে পারে। তাই ভোটের মাঠে বিএনপির বিপক্ষে এনসিপিও কোন শক্ত খেলোয়াড় নয়। তবে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের অনিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার হলেও দেশের ভোটারদের খুব বেশি নড়াচড়া হবে না, দলের ভুলত্রুটি বা অপরাধকে কর্মী-সমর্থকরা ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না; তারপরও কিছু ভোট বিএনপি হারাতে পারে; কিন্তু তা বিএনপির পরাজয়ের জন্য পর্যাপ্ত নয়। জাতীয় পার্টি নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে বিধ্বস্ত, তারপরও রংপুর এলাকায় তাদের অবস্থান নিশ্চিহ্ন হয়নি।

নির্বাচনে এনসিপি কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ চাইবে না, কারণ তারা মনে করে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন হবে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে বিএনপির মধ্যেও দোটানা রয়েছে। এক বিবেচনায় বিএনপি চায় মুমূর্ষু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলে বিজয়ী বিএনপি পাঁচ বছর শান্তি ও নিরুপদ্রবে দেশ শাসন করতে পারবে; আর অংশগ্রহণ না করলে অতীতের মতো একচেটিয়া নির্বাচনের বিরুদ্ধে নির্বাচনোত্তর ৩৫ শতাংশ লোকের মিছিল, মিটিং, আন্দোলন চলতেই থাকবে, অর্থাৎ বিগত পনেরো বছরে বিএনপি যা করেছে তা ৩৫ শতাংশ লোক এবার থেকে করবে। এমন চিন্তা-ভাবনা থাকলেও বিএনপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের ঘোর বিরোধী; কারণ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে এলে তাদের নিশ্চিত বিজয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে, বিএনপির তিনশত আসনেই জেতার প্রত্যাশা ও সম্ভাবনায় অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।

সতেরো বছরের বুভুক্ষু বিএনপির পক্ষে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করা কঠিন হবে, কারণ আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে এবারের নির্বাচনে নিশ্চিত বিজয়ের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে সেই সুযোগ স্থানীয় পর্যায়ের বিএনপির কোন নেতা হারাতে চাইবে না। তাই কোন এক বা একাধিক দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলেও বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বিজয় নিশ্চিত হওয়ায় জোট না হলেও বেশ কিছু আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে। বিএনপির মারদাঙ্গা কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে যতবেশি বিভেদ হবে ততবেশি বিএনপি সমস্যায় পরবে। ইসলামপন্থি দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হবে। বিএনপির একচেটিয়া জয় লাভের সম্ভাবনায় ভোটের মাঝখানে কোন দল নির্বাচন বয়কট করলেও আশ্চার্য হবো না।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিশ্রুত অদ্বিতীয়, অনুপম, অনন্য, দুর্লভ, বিরল ও অসামান্য নির্বাচন উপহার দেওয়ার কোন প্রস্তুতি জনগণ এখনো দেখতে পাচ্ছে না। ব্যালটপেপার ও ভোটকেন্দ্র জোর করে দখলে নেওয়ার চিরাচরিত সংস্কৃতি এবারের নির্বাচনে উবে যাবে এমন আশা করা বোকামি হবে। ‘মব সন্ত্রাস’ ও চাঁদাবাজি বন্ধ করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা জিরো। আওয়ামী লীগের ট্যাগ লাগিয়ে সারা দেশে যে কোন লোককে ধরে থানায় নিয়ে যাচ্ছে, কোপাচ্ছে, পিটাচ্ছে, জুতার মালা পরাচ্ছে, এগুলো হচ্ছে পুলিশের অজান্তে, পুলিশের সম্মুখে।

বিগত বার মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নৈরাশ্যজনক নিষ্ক্রিয়তা জনগণকে হতাশগ্রস্ত করে তুলেছে। পুলিশ কেন নিষ্ক্রিয়? অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে, বিগত বার মাসে পুলিশকে আক্রমণকারী নয়, আক্রান্ত ব্যক্তিকেই গ্রেফতার করতে হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশ নিজেদেরও এখন আর রক্ষা করতে পারছে না, তাদের রক্ষা করতে লাগছে সেনাবাহিনী। লন্ডন বৈঠকের পর প্রশাসনের নিকট দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বিএনপি ক্ষমতায় আসছে। এই সুসংবাদে স্থানীয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা ইতোমধ্যে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর তোয়াজ শুরু করে দিয়েছেন, বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীকে ফোন করছেন, কুশল বিনিময় করছেন, এলাকায় গেলে খাতির করছেন, তার সমর্থক-কর্মীদের লাই দিচ্ছেন। নির্বাচনেও প্রশাসনের এই স্বভাবসিদ্ধ আচরণের পরিবর্তন হবে না, অতীতের মতো সম্ভাব্য বিজয়ী বিএনপির ইচ্ছা অনুযায়ী নির্বাচনে তারা ভূমিকা পালন করবেন।

তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নয়, এর আগে কয়েকবার এসেছে, কিন্তু ড. ইউনূস সরকারের মতো এত দুর্বল, অসহায়, অক্ষম ও মাজুর সরকার আগে আর কখনও দেখা যায়নি। এমন একটা দুর্বল সরকারের পক্ষে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা কঠিন। রাজনৈতিক দলগুলোর উপর ড. ইউনূসের অতি নির্ভরতা রাজনীতিকে গুবলেট করে দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা তাকে নিয়োগ দিলেও এখন তিনি হয়ে গেছেন অনেকটা বিএনপি নির্ভর প্রধান উপদেষ্টা এমন অভিযোগও আছে। অবশ্য তার কাছে এর কোনো বিকল্প নেই। এখন বিএনপি যেভাবে চাইবে নির্বাচন সেভাবেই হবে। বিএনপির এমন একচেটিয়া অবস্থানের মধ্যেও পরিবর্তন আসবে যদি প্রভাবক সেনাবাহিনীর যথাযথ ভূমিকা থাকে।

নির্বাচন হবে ছয় মাস পর, অনেক সময়। এই দীর্ঘ সময়ে কতকিছু হয়ে যেতে পারে। যতকিছুই হোক না কেন, ছয় মাসে নির্বাচনে তৈরি হওয়া অতীত স্বভাবের বদল হবে না। আমাদের দেশে যে সকল ক্ষমতাসীন দল ভোট চুরি করেছে, তারাই আবার বিরোধী দলে গিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করেছে। আপন অন্যায়ের সাফাই দিয়ে অন্যের অন্যায়ের দোহাই পাড়ার অভ্যাস অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও দৃশ্যমান। তবে স্ট্রাইকিং ফোর্স সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খলাকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আমাদের এইসব উদ্ভট আশঙ্কার মৃত্যু ঘটবে, ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির অবসান হবে, আর ড. ইউনূসের ইমেজ কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার হবে।

জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাঁকশাল।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ