Views Bangladesh Logo

সংশোধিত অধ্যাদেশ নিয়ে আইনজ্ঞদের অভিমত: বাধ্যতামূলক সালিশে বাড়বে ভুক্তভোগীদের ভোগান্তি

ইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ কার্যকর হয়েছে গত ১ জুলাই। এই সংশোধনীতে পাঁচটি দেওয়ানি ও চারটি ফৌজদারি- মোট ৯টি আইনের বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাধ্যতামূলকভাবে মধ্যস্থতার (সালিশ) পথ বেছে নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এসব আইনের আওতায় কোনো বিরোধে সরাসরি মামলা করা যাবে না। দ্বারস্থ হতে হবে স্থানীয় লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতার। আইনজ্ঞদের মতে, এই বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। একইসঙ্গে হয়রানির শিকার হবেন বিচারপ্রার্থী এবং বিচারপ্রাপ্তিতে আরও বাড়বে দীর্ঘসূত্রতা।


রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারিকৃত এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০০০ সালের ৬ নম্বর ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন’ সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে গত ১ জুলাই। এই অধ্যাদেশে ৯টি আইনের ধারা লিগ্যাল এইড অফিসে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধারাগুলো হচ্ছে- ‘পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩-এর ধারা ৫’, ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’, ‘সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত বণ্টন সম্পর্কিত বিরোধ’, ‘স্টেট অ্যাকুজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০-এর সেকশন ৯৬-এ উল্লিখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ’, ‘নন-এগ্রিকালচারাল টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৪৯-এর সেকশন ২৪-এ উল্লিখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ’,‘পিতামাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩-এর ধারা ৮ অনুসারে পিতামাতার ভরণপোষণ সম্পর্কিত বিরোধ’, ‘নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট, ১৮৮১-এর সেকশন ১৩৮-এ বর্ণিত চেক ডিসঅনার সম্পর্কিত অভিযোগ (অনধিক ৫ লাখ টাকা মূল্যমান চেকের ক্ষেত্রে)’, ‘যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ধারা ৩ ও ৪-এ বর্ণিত যৌতুক সম্পর্কিত অভিযোগ’ এবং ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ধারা ১১(গ)-তে বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতন সম্পর্কিত অভিযোগ।’


আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন- ‘আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ পাঁচটি দেওয়ানি ও চারটি ফৌজদারি অপরাধে মামলা দায়েরের আগে নতুন করে আরবিট্রেশনের (মধ্যস্থতায়) বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এসব মামলা এমনিতেই আপসযোগ্য। এ ধরনের মামলায় রায়ের আগে আপসের মাধ্যমে প্রত্যাহারের সুযোগ আছে। তাই মামলা দায়েরের আগেই লিগ্যাল এইডে যাওয়ার বিধান করে অভিযোগকারী ও অভিযুক্তকে হয়রানি থেকে দূরে রাখা হয়েছে। আর মধ্যস্থতায় সমাধান না হলে আদালতে যাওয়ার সুযোগও থাকছে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সংশোধিত এই অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য হলো- ভুয়া মামলা কমানো, নির্দোষ ব্যক্তিকে মামলায় জড়ানো রোধ করা, মামলার চাপ হ্রাস এবং বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি কমানো। আর আপসযোগ্য এসব বিষয়ে শুরুতেই মামলায় যাওয়া হলে মামলা জট বাড়বে।’
তবে এ বিষয়ে সাধারণ আইনজীবীদের অভিমত ভিন্ন। তাদের মতে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার আওতায় আসা এসব ধারা ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করবে। বিচারপ্রার্থীরা অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আগ্রহ হারাবে লিগ্যাল এইডের দীর্ঘসূত্রতায়। অন্যদিকে তদন্তের নামে হয়রানি আরও বাড়ার সম্ভাবনা থকবে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম এ ব্যাপারে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকার ৩৭টি সিএমএম আদালতে প্রতিদিন সংশোধিত এসব ধারার মামলা গ্রহণ ও বিচার পূর্ববর্তী কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে। আর একজন বিচারকের নেতৃত্বাধীন লিগ্যাল এইড অফিস কীভাবে তা পরিচালনা করবে? তাকে তো পারিবারিক মামলা, যৌতুক, নারী-শিশু নির্যাতন, চেক ডিজঅনার ও দেওয়ানি মামলার মধ্যস্থতা করতে গিয়ে পাহাড় সমান চাপ সামলাতে হবে। অর্থাৎ এটা খুবই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। আমি মনে করি এই অধ্যাদেশের কারণে সাধারণ মানুষের হয়রানি এবং ক্ষতি আরও বাড়বে।’


সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার নেত্রী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন করার পর একজন নারীকে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে আগে যেতে হবে লিগ্যাল এইড অফিসে। এরপর মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা না হলে ভুক্তভোগীর ক্ষত বা আঘাতের আলামতই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই পরে মামলা করেও সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে। তাছাড়া নারীরা সমাজ ও পরিবারে এমনিতেই দুর্বল পক্ষ। এখন এ আইনে তাদের আরও দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। একজন মানুষ আগে যেখানে অন্যায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনের কাছে আশ্রয় নিতে পারতো এখন সেখানে তাকে লিগ্যাল এইডে মধ্যস্থতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’


এই ধরনের বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার বিধান করার আগে সিনিয়র আইনজীবী ও বিচারপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘লিগ্যাল এইড অফিসে যাওয়া মানে এক নতুন প্রক্রিয়া শুরু হওয়া যা মামলা শুরুর পূর্বে সময় নষ্ট ও জটিলতা সৃষ্টি করবে। বিচারপ্রার্থীকে আরও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া আর্থিক খরচের বিষয়ও আছে। ভুক্তভোগীকে দ্বৈত খরচ যেমন- প্রথমে মধ্যস্থতা ও পরে মামলার ব্যয় মেটানোর দরকার হতে পারে। তাই এই সংশোধিত অধ্যাদেশটি আবার সংশোধনের বিষয়ে বিবেচনা করা দরকার।’


সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ এ ব্যাপারে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘পারিবারিক আদালত আইন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, বণ্টন সম্পর্কিত বিরোধ, অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন, চেক ডিসঅনার সম্পর্কিত অভিযোগ, যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ধারা ৩ ও ৪-এ বর্ণিত যৌতুক ও যৌতুকের জন্য নির্যাতন সম্পর্কিত অভিযোগগুলো খুবই জটিল ও স্পর্শকাতর। তাই এসব বিষয়ে সরাসরি মামলায় না যেয়ে বাধ্যতামূলত মধ্যস্থতার অধ্যাদেশটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে অনতিবিলম্ব এই অধ্যাদেশ বাতিল বা আবার সংশোধন করা উচিত।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ