জাতিসংঘের সহায়তায় গুমবিষয়ক আইন ও কমিশন গঠন চূড়ান্ত
দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘গুম’। যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের জন্য এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। বিগত কয়েক যুগে ‘গুম সংস্কৃতি’ দেশবাসীকে চরম আতঙ্কিত করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রণয়ন করতে যাচ্ছে গুম বিষয়ে আইন। এ আইনের অধীনে গঠন করা হবে গুমবিষয়ক কমিশনও। এরই মধ্যে আইনের খসড়াও প্রস্তুত করেছে আইন মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘের সহায়তায় আগামী জুলাই মাসের মধ্যেই গুম সংক্রান্ত কমিশন গঠন ও পূর্ণাঙ্গ আইন পাস করা হবে বলে জানা গেছে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গুমবিষয়ক আইন প্রণয়ন ও এ আইনের আওতায় গুমবিষয়ক কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ আইন কমিশন, অ্যাটর্নি অফিস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটোরিয়াল বডি। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ও কয়েকটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এই আইন প্রণয়নে সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। এছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল (United Nations Human Rights Council) বাংলাদেশে গুম বিষয়ে আইন প্রণয়ন ও এ আইনের আওতায় গুমবিষয়ক কমিশন গঠনে সরাসরি কাজ করছে। সূত্র আরও জানায়, মূলত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হওয়া প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সবগুলো গুমের ঘটনার রহস্য উন্মোচন, এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা ও ভবিষ্যতে যেন এমন গুমের ঘটনা দেশে না ঘটে বা ঘটলেও যেন দ্রুত ভুক্তভোগীকে উদ্ধার ও জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা যায় সে কারণেই আইনটি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে গুমবিষয়ক আইনের খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে। এ আইনের অধীনে যে গুমবিষয়ক কমিশন করা হবে তার কাজ হবে আইনটির অধীনে গুমের ঘটনা তদন্তে সহযোগিতা করা, এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করা ও ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করা। এছাড়া গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধান, শনাক্তকরণ এবং তাদের গুমের কারণ অনুসন্ধানে কাজ করবে গুমবিষয়ক কমিশন। আগামী জুলাই মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত আইনটি পাস ও গুম কমিশন গঠন করা হতে পারে।
নতুন আইনে যা যা থাকছে সে বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার শাখা সূত্র ভিউজ বাংলাদেশকে জানায়- প্রথমেই গুমকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর আওতায় গুমের ঘটনাকে একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। আইনে দণ্ডের বিষয়ে বলা হয়েছে- গুমের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক দশ বছর কারাদণ্ড হতে পারে। কমিশন গঠন বিষয়ে বলা হয়েছে- একটি শক্তিশালী গুমবিষয়ক কমিশন গঠন করা হবে যা গুমের ঘটনা তদন্ত করবে এবং ভুক্তভোগীদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করবে। এই কমিশন গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধান, শনাক্তকরণ এবং তাদের গুমের কারণ অনুসন্ধানে কাজ করবে। ভুক্তভোগীদের আইনগত সহায়তার বিষয়ে খসড়া আইনে বলা হয়েছে- গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে আইনি সহায়তা প্রদান করা হবে এবং তাদের আইনি অধিকার সম্পর্কে অবহিত করা হবে। এতে ক্ষতিপূরণ বিষয়ে বলা আছে- গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। গুমের তদন্তের বিষয়ে বলা হয়েছে- গুমের ঘটনার নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করা হবে। অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে বলা হয়েছে- গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। আইনটির খসড়ায় আরও বলা হয়েছে- যুদ্ধ বা জরুরি অবস্থার অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না। গুম করার ক্ষেত্রে যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা বা জরুরি অবস্থার অজুহাত কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে যারা গুমের শিকার হয়েছেন তাদের মিসিং সার্টিফিকেট দেয়ার বিষয়টি আইনে যুক্ত করা হচ্ছে। এর মধ্যে ডেথ সার্টিফিকেটের মতো সব ধরনের কাজ করা যাবে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘গুমবিষয়ক আইন প্রণয়ন ও এ আইনের অধীনে গুমবিষয়ক কমিশন গঠন করা হচ্ছে। গুম সংক্রান্ত কমিশন গঠন ও আইন তৈরিতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। আইনটি আগামী জুলাই মাসের মধ্যে হবে বলে আশা করছি।’ এই আইন হলে কাউকে গুম করা যে কোনো সরকারের জন্যই অনেক ঝুঁকির ও কষ্টসাধ্য হবে। আইনটি করলেও পরবর্তীতে কোনো সরকার আইনটি বাতিল করতে পারে কি-না জানতে চাইলে আসিফ নজরুল বলেন, ‘সাধ্য থাকলে নিজেদের স্বার্থে সংবিধানও পারিবর্ত করতে পারে যে কোনো সরকার। যেমনটা আমরা বিগত সরকারের আমলে দেখেছি। তাই যে কোনো আইনও যে কোনো সরকার চাইলে বাতিল করতে পারে। আমাদের কাজ বা দায়িত্ব দেশের মানুষের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গুমবিষয়ক আইন প্রণয়ন করে যাওয়া। দেশের মানুষের নাকের ডগায় এই আইনটি অন্তত ভবিষ্যতে কোনো সরকার চাইলেও বাতিল করার সাহস দেখাবে না। কারণ দেশবাসীর নিরাপত্তার জন্য করা হচ্ছে গুমবিষয়ক আইন। এটি বাতিল করা মানে হবে গুমকে স্বীকৃতি দেয়া।’
এ ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘গুমবিষয়ক আইনটি পাস হলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে ন্যায়বিচার পেতে সহায়তা করবে এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সহায়ক হবে।’
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, দেশে প্রতিটি সরকারের সময়ই গুমের ঘটনা ঘটেছে। এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে হলে গুমবিষয়ক একটি আইন ও এই আইনের আওতায় গুমবিষয়ক কমিশন করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই আইন করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে এই আইন করার পর এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে