খালেদা জিয়া: গৃহবধূ থেকে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির চেয়ারপারসন ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সহধর্মিনী খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য নাম। ১৯৮১ সালের মে মাসে যখন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, খালেদা জিয়া তখন নিছক একজন গৃহবধূ। রাজনীতি নিয়ে তাঁর কোনো প্রকাশ্য আগ্রহ ছিল না, এমনকি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেও তাঁকে খুব একটা দেখা যেত না। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই অন্তরালবর্তী গৃহবধূই হয়ে ওঠেন দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। ঘর এবং বাইরের নানা ষড়যন্ত্র আর চড়াই-উৎরাই মোকাবিলা করে তিনি এই দীর্ঘ ও বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন। স্বামী হারানোর শোকের মাঝেই তাঁকে দলের হাল ধরতে হয়েছিল, মোকাবিলা করতে হয়েছিল অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর রাজপথের সংগ্রাম। টানা আট বছর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আপস না করার চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে খ্যাতি পান।
জন্ম ও পারিবারিক জীবন
খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শৈশবে তাঁর ডাকনাম ছিল ‘পুতুল’। তাঁর পিতা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন ফেনীর পরশুরাম উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা এবং একজন সফল ব্যবসায়ী। ব্যবসার প্রয়োজনে তিনি দিনাজপুরে স্থানান্তরিত হন এবং ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সেখানে স্থায়ী হন। ১৯৩৭ সালে তাঁর বিয়ে হয় তৈয়বা মজুমদারের সঙ্গে, যিনি পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ীর বাসিন্দা ছিলেন। এই পরিবারটি ‘টি-ফ্যামিলি’ হিসেবে পরিচিত ছিল। খালেদা জিয়ার মা তৈয়বা মজুমদার ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী।
বিবাহ ও দাম্পত্য জীবন
১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট দিনাজপুরের মুদিপাড়ায় পারিবারিকভাবে তরুণ ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের সময় জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। জিয়ার মা বিয়ের বছরখানেক আগে মারা যান এবং বিয়ের সময় তাঁর বাবা করাচিতে থাকায় তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। খালেদা ও জিয়ার দুই পুত্রসন্তান—তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো। দীর্ঘ সময় তিনি সাধারণ বাংলাদেশি গৃহবধূর মতোই জীবন অতিবাহিত করেছেন। এমনকি জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও খালেদা জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াননি, কেবল ফার্স্ট লেডি হিসেবে আনুষ্ঠানিকতাটুকুই পালন করতেন।
জিয়ার উত্তরসূরি ও বিএনপিতে যোগদান
১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপি এক গভীর সংকটে পড়ে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করলে দলটি আরও অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। দলের ভেতরের কোন্দল আর বাইরের চাপের মুখে জিয়ার আদর্শের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে কোনো নির্ভরযোগ্য নেতার প্রয়োজন ছিল। যদিও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক পরিচিতি তখন খুব একটা ছিল না, কিন্তু দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন যে, দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার একমাত্র কান্ডারি তিনিই হতে পারেন। অবশেষে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপিতে যোগ দিয়ে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন।
রাজপথের নেতৃত্ব ও ‘আপসহীন’ খেতাব
১৯৮৩ সালে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং ১ এপ্রিল প্রথম রাজনৈতিক বক্তৃতা দেন। বিচারপতি সাত্তারের অসুস্থতায় তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হন এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি ৭ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেলেও খালেদা জিয়া বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি ‘এক দফা’ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার হটাও সংগ্রাম ত্বরান্বিত করেন। দীর্ঘ আট বছরের অবিচল লড়াইয়ের পর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। রাজপথের এই অনড় অবস্থানের কারণে তিনি দেশবাসীর কাছে ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি পান।
সরকার গঠন ও নির্বাচনী রেকর্ড
১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাস গড়েন। তিনি ১৯৯১ সালে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালেও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর অভাবনীয় জনপ্রিয়তা। তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন (১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ২৩টি সংসদীয় আসন), তার প্রতিটিতেই তিনি বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। উপমহাদেশে এমন বিরল কৃতিত্বের নজির আর কোনো নেতার নেই।
দুই প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই
১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি দুই ধরনের প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেছিলেন- এর একটি ছিল দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, যেমন আন্তঃকোন্দল এবং অন্যটি স্বৈরাচারী এরশাদ। তাঁর নেতৃত্বকালীন বছরগুলোতে তিনি দলের ওপর একক ও ফলপ্রসূ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি তিনটি বিষয়ে খুব জোর দিয়েছিলেন- জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ঐক্য ও রাজনীতি তৃণমূলের কাছে নিয়ে যাওয়া; প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়ার সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা এবং আওয়ামী লীগের প্রতি সম্যক দৃষ্টিভঙ্গি।
নব্বইয়ের নির্বাচনে তিনি ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে সংবিধানের সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং পদত্যাগ করেন। ওই বছরের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১১৬টি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেত্রী হন। আর আওয়ামী লীগ ১৪৭ আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি ও জাসদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে।
‘এক-এগারো’র পটপরিবর্তন ও ক্ষমতা হাতছাড়া
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। তবে অষ্টম সংসদের মেয়াদপূর্তির পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিরোধে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ‘এক-এগারো’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে; তিনি ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েন। এ সময় তাঁকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু জুলুম-নির্যাতনের মুখেও তিনি দেশ ছেড়ে যাননি। ২০০৭ সালে ৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক বছর কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তিলাভ করেন। এর আগে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের পরের বছর জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে গুলশানে দলীয় কার্যালয়ে একটানা ৯৩ দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘেরাওয়ে ছিলেন। পরের বছরও তাঁকে একইভাবে ঘেরাওয়ের মধ্যে থাকতে হয়েছিল।
নিঃসঙ্গ ও যোগাযোগহীন জীবনযাপনে বাধ্য
৩৫ বছরের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া সবসময় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সোচ্চার ও সংগ্রামমুখর ছিলেন। তাঁর প্রতিশ্রুতির জন্য তাঁকে ভুগতে হয়েছে। তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল, তাঁর সভা ও মোটর শোভাযাত্রা বিরোধীদের ভয়ঙ্কর আক্রমণের শিকার হয়েছিল। তাঁকে নিঃসঙ্গ ও যোগাযোগহীন জীবনযাপন করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তিনি শুধু বাংলাদেশেই নয়, সম্ভবত বৈশ্বিক ক্ষেত্রেও একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ২৩ সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং কোনোটিতেই পরাজিত হননি।
২০১৮ সালের নির্বাচনেও খালেদা জিয়া তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। এসব আসন হচ্ছে ফেনী-১. বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৭। কিন্তু দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হবার কারণে নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে পড়েন। খালেদা জিয়ার অতীত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি বগুড়া, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের আসন থেকে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এছাড়া ১৯৯১ সালে ঢাকার একটি আসন থেকে এবং ২০০১ সালে খুলনার একটি আসন থেকে ভোটে লড়েছেন। নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শুধু জয়লাভই নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সাথে খালেদা জিয়ার ভোটের ব্যবধানও ছিল বেশি।
‘দেশনেত্রী’ সম্বোধন
তিনি দেশের অদ্বিতীয় জননন্দিত নেতা। দেশের প্রায় সব জায়গায় তিনি গেছেন। তিনি শ্রমসাধ্য দীর্ঘ সফর করতে পারঙ্গম ছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের ১৪ দিন আগে তিনি সারা দেশে প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেছিলেন। যখন তিনি কোনো নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতেন, তখন তিনি অদম্য প্রাণপ্রাচুর্যে বলীয়ান হয়ে উঠতেন। তখন তিনি সকাল, দুপুর বা রাতের খাবারের জন্য কোনো সময়সূচি বজায় রাখতেন না। তিনি রাত তিনটায় নির্বাচনী সভায় ভাষণ দিয়েছেন। তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতেন এবং একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে কঠোরভাবে তা মেনে চলতেন। বিশ্বের ১০০ জন ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় ফোর্বস ম্যাগাজিন খালেদা জিয়াকে ২০০৪ সালে ১৪তম, ২০০৫ সালে ২৯তম এবং ২০০৬ সালে ৩৩তম স্থান দেয়। ২০১১ সালের ২৪ মে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি সিনেটে গণতন্ত্রের যোদ্ধা (ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি) হিসেবে সম্মানিত হন। তাঁর দলীয় কর্মী ও সমর্থকরা তাঁকে অকপটে সম্বোধন করেন ‘দেশনেত্রী’ বলে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে