Views Bangladesh Logo

চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-১

ট্রানজিস্টরের জাদুতে জাপানের বিস্ময়কর উত্থান

Mahmud  Hossain

মাহমুদ হোসেন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত তখনো দগদগে। শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল জাপানের প্রযুক্তি খাতকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভাবনা বদলায়। তারা বুঝতে পারে, বিশ্বে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে শক্তিশালী জাপানের প্রয়োজন। তাই আমেরিকা তার নিজের নেতৃত্ব বজায় রেখেই জাপানকে প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৫৩ সালে, যখন পদার্থবিজ্ঞানে দুবার নোবেল পুরস্কার পাওয়া মার্কিন বিজ্ঞানী জন বারডিন টোকিওতে আসেন, তাকে যেন এক আন্তর্জাতিক তারকার মতো বরণ করে নেয়া হয়। সে বছরই সনির প্রতিষ্ঠাতা আকিও মরিতা নিউইয়র্কে যান। তার লক্ষ্য ছিল ট্রানজিস্টর প্রযুক্তির লাইসেন্স সংগ্রহ করা। পদার্থবিজ্ঞানী মরিতা তখন ইলেকট্রনিক্সের এই জাদুকরী জগতের বাসিন্দা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই, ১৯৪৬ সালে, আকিও মরিতা ও মাসারু ইবুকা মিলে প্রতিষ্ঠা করেন সনি। তাদের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ‘রাইস কুকার’ আর ‘টেপ রেকর্ডার’ দিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে সেখানকার বিশালতা আর প্রাচুর্য দেখে মরিতা তো হতবাক! টেলিকমিউনিকেশন জায়ান্ট AT&T তাকে ট্রানজিস্টর তৈরির লাইসেন্স দিতে রাজি হয়। অবশ্য তারা ভেবেছিল, মরিতা হয়তো এটা কেবল 'হিয়ারিং এইড' বা শ্রবণযন্ত্র তৈরিতেই কাজে লাগাবেন; কিন্তু মরিতা অনেক আগেই বুঝেছিলেন, ভবিষ্যতের কনজিউমার ইলেকট্রনিক্সের মূল ভিত্তি হবে এই ট্রানজিস্টর। তার দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী, আর লক্ষ্য ছিল আমেরিকার বিশাল বাজার।

তবে সনির পথচলা সহজ ছিল না। জাপানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছুদিন ট্রানজিস্টর লাইসেন্সের অনুমোদন আটকে রাখে, কারণ তাদের অনুমতি ছাড়াই সনি বিদেশি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছিল; কিন্তু সনি তাতে দমে যায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো অন্য দেশগুলো যেখানে পশ্চিমা প্রযুক্তি নকল করার কৌশল নিত, সনি সেখানে লাইসেন্স নিয়ে প্রযুক্তি গ্রহণ করে এবং নিজস্ব উদ্ভাবনে মন দেয়। এটাই ছিল তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি। সনির সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে ট্রানজিস্টর রেডিওতে। মার্কিন টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস এই ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে না পারলেও মরিতা সফল হন। সনির সাশ্রয়ী ও সহজে বহনযোগ্য রেডিও দ্রুতই বিশ্ববাজার দখল করে নেয়।

তবে চিপ ডিজাইনে তখনো ফেয়ারচাইল্ড ও টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসের মতো মার্কিন কোম্পানিগুলোই এগিয়ে ছিল। জাপানি কোম্পানিগুলোকে মোটা অঙ্কের রয়্যালটি গুনতে হতো- ফেয়ারচাইল্ডকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টসকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ওয়েস্টার্ন ইলেকট্রিককে ২ শতাংশ। সেই সময় জাপান মূলত নিত্যনতুন ভোক্তা পণ্যের উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করত এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় চিপ প্রযুক্তি আসত আমেরিকা থেকে।

জাপান চিপ ব্যবহার করে ভোক্তা পণ্য উদ্ভাবনের যেসব ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছিল, তাদের মধ্যে ক্যালকুলেটর ছিল অন্যতম। মার্কিন কোম্পানি টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস ক্যালকুলেটর তৈরির উদ্যোগ নিলেও তাদের মার্কেটিং বিভাগ এর সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়। আর সেই সুযোগে জাপানের শার্প ইলেকট্রনিকস ছোট ও সস্তা ক্যালকুলেটর বানিয়ে ১৯৭০-এর দশকে বাজার নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।

১৯৬০-এর দশকে এসে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক জটিল পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৬৪ সালের মধ্যে জাপান ট্রানজিস্টর উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যায়, যদিও যুক্তরাষ্ট্র তখনো ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ও কম্পিউটার তৈরিতে এগিয়ে ছিল। ১৯৬৫ সালে জাপানের ইলেকট্রনিক্স রপ্তানি ছিল ৬০০ মিলিয়ন ডলার, যা মাত্র দুই দশকের মধ্যে বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ বিলিয়ন ডলারে!

পারস্পরিক নির্ভরতার এই পথ সব সময় মসৃণ ছিল না। ১৯৫৯ সালে মার্কিন ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে জাপানি ইলেকট্রনিক্স আমদানির বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার জাপানকে তৎকালীন শীতল যুদ্ধে মিত্র হিসেবেই দেখতে চেয়েছিল। এক্ষেত্রে যুক্তি ছিল, জাপান যদি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করতে না পারে, তবে তারা হয়ত চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি নীতি ছিল জাপানকে প্রযুক্তিগতভাবে আরও সক্ষম করে তোলা। জাপানের ব্যবসায়ীরাও এই ভিশনকে কাজে লাগায়। টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস জাপানে একটি চিপ কারখানা খুলতে চাইলে জাপানের কঠোর রেগুলেটরি বিধিনিষেধে তা আটকে যায়। সেই সময় মরিতা নিজেই এগিয়ে আসেন। তিনি ছিলেন টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসের চেয়ারম্যান প্যাট হ্যাগার্টির বন্ধু। মরিতার পরামর্শে টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসের কর্মকর্তারা গোপনে টোকিওতে আসেন। ওদিকে মরিতা জাপান সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করে একটি যৌথ উদ্যোগের প্রস্তাব দেন- টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস চিপ তৈরি করবে, আর সনি জাপানের সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করবে।

মরিতার এই অসাধারণ কৌশলের বদৌলতে টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসের জাপানে কারখানা খোলার অনুমোদন মিলে, আর মরিতা পরিচিত হন প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের কিংবদন্তি ব্যবসায়ী হিসেবে। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্পর্ক আরও গভীর হয়, জাপানের অর্থনীতিতে আসে দ্রুত সমৃদ্ধি। প্রধানমন্ত্রী হায়াতো ইকেদা ১০ বছরের মধ্যে জাপানের জাতীয় আয় দ্বিগুণ করার যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিলেন তা নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই অর্জিত হয়।
-----------------
(ক্রিস মিলারের সাড়া জাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর নবম অধ্যায় (‘দ্য ট্র্যানজিস্টর সেলসম্যান’) থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)

লেখক পরিচিতি: মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ