Views Bangladesh Logo

পৃথক সচিবালয়ই কি স্বাধীন বিচার বিভাগের পথ খুলতে যথেষ্ট?

ইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপ মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারাই হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের সংবিধানেও স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। মাজদার হোসেন মামলার রায়ের পর গত ২৬ বছরেও বিচার বিভাগ স্বাধীন হতে পারেনি। সবশেষ গত ৩০ নভেম্বর বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা জন্য সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ জারি করা হয়। তবে এই পৃথক সচিবালয়ও বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য যথেষ্ট হবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আইনজ্ঞরা।


বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সরকারের নির্বাহী ও আইন বিভাগের হস্তক্ষেপ বা প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করা। এর অর্থ হলো, বিচার বিভাগ কোনো রাজনৈতিক বা বাহ্যিক চাপের অধীন না হয়ে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী কাজ করবে এবং জনগণের অধিকার রক্ষা করবে। এ লক্ষ্যে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলায় ১৯৯৭ সালে হাইকোর্ট ও ১৯৯৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় দিয়েছিলেন। সেই রায়ে ১২ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।


১২ দফা নির্দেশনাগুলো ছিলো: ১. সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অফ রিপাবলিকের ভেতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে একত্রিত করা যাবে না। ২. বিচারিক (জুডিশিয়াল) ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করতে হবে এবং নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না। সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের পদ সৃষ্টি, নিয়োগ পদ্ধতি, নিয়োগ বদলিসহ অন্যান্য কাজের বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারবেন। ৩. সিভিল সার্ভিস অর্ডার ১৯৮০ অনুযায়ী সব ম্যাজিস্ট্রেটকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি। ৪. এই রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। এই কমিশনে নারী ও পুরুষ বলে কোনো বৈষম্য থাকবে না। ৫. সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়ারির সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন। ৬. সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবেন। ৭. সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে। ৮. বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। ৯. জুডিশিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন এবং বরাদ্দ করবে। ১০. জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন। ১১. এই রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ পৃথককরণের জন্য সংবিধানে কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথককরণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে। এবং ১২. জুডিশিয়াল পে-কমিশন: জুডিশিয়াল পে-কমিশন জুডিশিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।


এসব নির্দেশনার বাস্তবায়ন গত ২৬ বছরেও খুব বেশি দেখা যায়নি। তবে গত ৩০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয়। এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে পুরোপুরি পৃথক হয়েছে বিচার বিভাগ। কিন্তু এর মাধ্যমেও বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন হবে কিনা সে বিষয়ে সন্দিহান আইনজ্ঞরা।


এ ব্যপারে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এটি একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় ও এটি নিশ্চিত করার জন্য নাগরিকদের সজাগ দৃষ্টি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কার্যকর সাংবিধানিক কাঠামোর প্রয়োজন। বিচার বিভাগকে স্বাধীন রাখতে হলে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে বিচারকরা যেন সরকারের অন্য কোনো বিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিরপেক্ষভাবে বিচারিক কাজ পরিচালনা করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীন বিচার বিভাগের লক্ষ্যে মাসদার হোসেন মামলার ১২ দফা নির্দেশনা এখনো ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। এখন বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় হয়েছে। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে এরপরেও বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে না। এটি তো একটি শুধু আলাদা সচিবালয়, যা নিয়ন্ত্রণ করবে প্রধান বিচারপতি। কিন্তু সেখানেও যদি সরকার হস্তক্ষেপ করে তাহলে কি তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন?


সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় হয়েছে, এটা ভালো খবর। কিন্তু মাসদার হোসেন মামলার ১২ দফা নির্দেশনা তো বাস্তবায়ন করতে হবে। এর জন্য সরকারকে উদার হতে হবে। বিচারক নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি কিংবা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কার্যক্রম, সব ক্ষেত্রেই সরকার চাইলে তার ক্ষমতা দেখাতে পারে। সেটা বিভিন্নভাবেই হতে পারে। কারণ কেউই তো সরকারের বাইরে নয়। তাই বিচার বিভাগ পৃথক হলেও সম্পূর্ণ স্বাধীন হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।’


সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে বলেন, ‘বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার চূড়ান্ত রায়ের ২৬ বছর পরও সেই রায়ের ১২ দফা নির্দেশনার একটি ছাড়া বাকিগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। এটা হতাশার বিষয়। তাই সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আসলে বিচার বিভাগকে কতটা সরকারের হস্তক্ষেপ মুক্ত ও স্বাধীন রাখতে পারবে তা বলা কঠিন। এছাড়া স্বাধীন বিচার বিভাগ মানে সবার জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা-এ বিষয়টিও প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।’


তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে ১৯৯৯ সালে সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছিলো। কিন্তু গত ২৬ বছরে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারাই তো ওই রায় বাস্তবায়ন করেনি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন সরকার তো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় করে দিয়েছে। এখন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে তো উদ্যোগ নিতে হবে। পরে না তা বাস্তবায়ন হবে। আশা করছি বিচার বিভাগ এখন সত্যিকারার্থে স্বাধীন হবে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ