Views Bangladesh Logo

বিবিসি থেকে

ইরান-ইসরায়েল হামলা: খারাপ পরিস্থিতি কি অপেক্ষা করছে

রান-ইসরায়েলের সংঘাত আপাতত শুধু দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ মনে হচ্ছে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য দেশ দুপক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু অন্যদের কথায় তারা কান দেবে কি? না দিলে কী হবে? সংঘাত যদি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে রূপ নেয় তার ফলে কী হবে?

কী হতে পারে তা আমরা জানি না। আমরা কেবল সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কা করতে পারি। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে বৈশ্বিকভাবে কী কী খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তার কয়েকটি সম্ভাব্য আলামত এখানে প্রকাশ করা হলো।

যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়তে পারে
যদিও যুক্তরাষ্ট্র বারবার অস্বীকার করেছে যে এই সংঘাতে তারা জড়িত নয়। ইরান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি না হলেও অন্তত পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছে। এই বিশ্বাস থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অবস্থানে হামলা চালিয়ে ইরান প্রতিশোধ নিতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রও আশঙ্কা করছে। ইরাকে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর ক্যাম্প, উপসাগরীয় অঞ্চলের ঘাঁটি এবং কূটনৈতিক মিশন ইরানের হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইরানের প্রধান দুই প্রতিনিধি শক্তি হামাস ও হিজবুল্লাহ যদিও এখন কিছুটা দুর্বল; কিন্তু এই দুটি দলকে সমর্থন দেয়া ইরাকের ইরানপন্থি আধাসামরিক শক্তিগুলো এখনো বেশ সশস্ত্র ও সক্রিয়। তারাও যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনাগুলোতে হামলা করতে পারে, এ ধরনের হামলার আশঙ্কায় নিজেদের বেশ কিছু লোক ইতোমধ্যে সরিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রও এর মধ্যে প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, কোনো ধরনের হামলার পরিণাম ভয়াবহ হবে।

তেল আবিবে বা অন্য কোথাও যদি কোনো মার্কিন নাগরিক নিহত হয় তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। এমন ঘটনা ঘটলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো মানুষ চুপচাপ বসে থাকবেন না। তিনি তখন বাধ্য হতে পারেন সামরিক পদক্ষেপ নিতে। অন্যদিকে নেতানিয়াহুও এটাই চান। বহুদিন শোনা যাচ্ছে, নেতানিয়াহু ইচ্ছাকৃতভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে সংঘাতে জড়াতে চান। যেন ইরানকে সহজেই পরাস্ত করা যায়।

ইসরায়েল ভালো করেই জানে, তাদের পক্ষে ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা সম্ভব নয়। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়েছে সেই ধরনের বোমারু বিমান ও বাঙ্কার-ধ্বংসকারী অস্ত্র। অন্যদিকে, ট্রাম্প তার সমর্থকদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে আর কোনো চিরস্থায়ী যুদ্ধ শুরু করবেন না; কিন্তু একই সঙ্গে, রিপাবলিকানদের বড় একটি অংশ ইসরায়েলপন্থি। তারা মনে করে ইরানে সরকার পরিবর্তনের জন্য এই মুহূর্তটাই মোক্ষম। যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সেটি কীরকম ভয়াবহ ব্যাপার হবে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।

উপসাগরীয় দেশগুলোও জড়িয়ে পড়তে পারে
যদি ইরান ইসরায়েলের সুরক্ষিত সামরিক স্থাপনা ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুগুলোতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি চালাতে না পারে তারা উপসাগরীয় অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত দুর্বল লক্ষ্যবস্তুগুলোর দিকে হয়তো আঘাত হানবে। যেগুলো মূলত ইসরায়েলের বন্ধু, যারা সরাসরি না হলেও ভেতরে ভেতরে ইরানের শত্রু দেশটিকে সহায়তা দিয়ে আসছে। ইরান যদি হেরে যেতে বসে, তাহলে মরিয়া হয়ে হয়তো ইসরায়েলের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো, যেগুলো ইরানের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত তাদের ওপরই হামলা চালাবে। উপসাগরীয় অঞ্চল জ্বালানি সম্পদে ভরপুর। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে ইরান হামলা চালিয়েছিল, এমন অভিযোগ রয়েছে। ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা সংযুক্ত আরব আমিরাতে হামলা চালিয়েছিল ২০২২ সালে।

এর মধ্যে উপসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশের সঙ্গে ইরান কিছুটা সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করেছে। তবে এসব দেশেই রয়েছে মার্কিন বিমানঘাঁটি এবং কিছু দেশ গোপনে হলেও ইসরায়েলকে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করেছে। যদি উপসাগরীয় অঞ্চল ইরানের হামলার শিকার হয়, তাহলে সেসব দেশও হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই আর্জি জানাবে, মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো শুধু ইসরায়েলের হয়ে নয়, তাদের প্রতিরক্ষায়ও যেন এগিয়ে আসে।

ইসরায়েল ব্যর্থ হলে কী হবে?
ইসরায়েলের হামলা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে কী হবে? ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কতটা সুরক্ষিত এখনো বাইরের পৃথিবী জানে না। যদি ইরানের কাছে ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের ৪০০ কেজি থাকে যা দিয়ে প্রায় দশটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব সেগুলো যদি ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস না হয় তাহলে কী হবে? ইরান নিশ্চিতভাবেই আরও সতর্কতার সঙ্গে আরও শক্তিশালী হয়ে পারমাণবিক বোমা তৈরির দিকে এগিয়ে যাবে।

অনুমান করা হচ্ছে, এই ইউরেনিয়াম হয়তো গোপন খনির গভীরে লুকানো রয়েছে। ইসরায়েল হয়তো দু-একজন ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে; কিন্তু ইরানের জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ধ্বংস করার ক্ষমতা তো কোনো বোমার নেই। আর ইসরায়েলের এই হামলা নিশ্চিতভাবেই ইরানের নেতাদের এই সিদ্ধান্তই দিয়েছে, ভবিষ্যতের হামলা ঠেকাতে তাদের একমাত্র উপায় যত দ্রুত সম্ভব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে ফেলতে হবে।

ইসরায়েলও নিশ্চয়ই এই আশঙ্কাই করছে। তাই তাদেরও একমাত্র উপায় ইরানকে সম্পূর্ণ মাটির সঙ্গে শুইয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া। তার মানে ধারাবাহিক এক আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণের ফাঁদে এমনিতেই পড়েছে ইরান-ইসরায়েল। এই চক্র থেকে তারা সহজে বেরোতে পারবে না। যার নিশ্চিত পরিণাম - দীর্ঘ সংঘাত, দীর্ঘ যুদ্ধ!

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধাক্কা
এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে, ইরান-ইসরায়েলের দীর্ঘ সংঘাতে সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। এমনিতেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আছে, ইরান-ইসরায়েল দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ সংঘটিত হলে তার প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো এশিয়া-ইউরোপেই পড়বে। তেলের দাম ইতোমধ্যেই ঊর্ধ্বমুখী। ইরান যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে কী হবে? তখন তেলের সরবরাহ আরও কমে যাবে।

আর যদি আরব উপদ্বীপের অপর পাশে, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা আবারও লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা শুরু করে? হুতিরা ইরানের সেই মিত্রদের একপক্ষ, যারা এখনো যথেষ্ট সক্রিয়। তাদের অভিনব যুদ্ধ-কৌশল ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও শত্রুদের ঘায়েল করার জন্য তারা বিখ্যাত। বিশ্বের বহু দেশ এর মধ্যেই অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। এর মধ্যে যদি তেলের দাম আরও বাড়ে তাহলে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এখনই ধারণা করা যায়। ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধের চাপে বিশ্ব অর্থনীতি এমনিতেই নড়বড়ে অবস্থায়।

এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, তেলের দাম বাড়ার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হবে রাশিয়া। তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানে ক্রেমলিনে ঢুকে পড়বে আরও কয়েকশ কোটি ডলার। যা সরাসরি ব্যয় হবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে।

ইরানের কি সরকার পতন হতে পার?
এই সংঘাত যদি ইরানের ইসলামি বিপ্লবী সরকারকে পতনের মুখে ঠেলে দেয় তাহলে কী হবে? তাহলে অনিবার্যভাবেই ইরানি নেতৃত্বে সৃষ্টি হবে এই দীর্ঘমেয়াদি শূন্যতা। তা হয়তো দেশটিকে নতুন রূপ দেবে।

নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, তার প্রধান লক্ষ্য হলো ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করা। তবে গতকালের বিবৃতিতে তিনি স্পষ্ট করেছেন, তার আরও গভীর উদ্দেশ্য হলো সরকার পরিবর্তন। ইরানের ‘গর্বিত জনগণকে’ উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন, তার হামলা তাদের ‘মুক্তির পথ’ পরিষ্কার করছে। একটি অশুভ ও দমনমূলক শাসনব্যবস্থা থেকে এই হামলা তাদের মুক্তি পথ বাৎলে দিবে।

ইরানের সরকার পতন কতিপয়ের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে, এই অঞ্চলের কিছু পক্ষে, বিশেষ করে ইসরায়েলিদের; কিন্তু প্রশ্ন হলো, এরপর কী হবে? হয়তো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। যদি ইরানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তার রূপ কেমন হবে, এই ধরনের অনেক প্রশ্নই এখন অনেকের মনে দেখা দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ এখন কোন দিকে মোড় নেয় তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। ইরান কীভাবে এবং কতটা কঠোর প্রতিশোধ নিতে পারে তাও দেখার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র কি ইসরায়েলকে সংযত করবে না কি আরও উসকে দিবে তাও বোঝার বিষয়। অনেক প্রশ্নের ওপর ঝুলে আছে উপসাগরীয় অঞ্চল ও বিশ্বের এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ