চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-৮
ভয়ই যেখানে প্রেরণা: যেভাবে ঘুরে দাঁড়ালো ইন্টেল
ইন্টেলের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডি গ্রোভ ছিলেন এক তেজি মানুষ। তার জীবন ছিল এক কঠোর লড়াইয়ের গল্প। তিনি ছিলেন হাঙ্গেরির এক শরণার্থী, যিনি সোভিয়েত ও নাৎসিদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। ভয় আর শৃঙ্খলাই ছিল ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে তার মূলমন্ত্র। তার বিখ্যাত বই ‘অনলি দ্য প্যারানয়েড সারভাইভ’-এ তিনি লিখেছেন: প্রতিযোগিতার ভয়, দেউলিয়া হওয়ার ভয়, আর ব্যর্থ হওয়ার ভয়- এসবই মানুষকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এক শক্তিশালী প্রেরণা জোগায়।
১৯৮০ সালের শুরুতেই গ্রোভের সামনে এসে দাঁড়াল এক বিশাল সংকট। ইন্টেলের প্রধান পণ্য ছিল মেমরি চিপ; কিন্তু জাপান থেকে আসা কোম্পানিগুলো মমরি চিপের বাজার দখল করে নিচ্ছিল। তাদের চিপ ছিল আরও ভালো মানের, আর দামও ছিল অনেক কম। দেখতে দেখতে ইন্টেলের বাজার হাতছাড়া হয়ে গেল। ইন্টেলই ছিল মেমরি চিপের আবিষ্কারক। তাই নিজেদের প্রধান পণ্য ছেড়ে দেয়া মানে ছিল নিজেদের পরিচয়কেই মুছে ফেলা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্রোভ আর ইন্টেলের কো-ফাউন্ডার গর্ডন মুর অফিসে বসে পথ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাদের আশা ছিল, হয়তো একদিন বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে; কিন্তু ইন্টেল এক্ষেত্রে সফল হলো না।
তবে ইন্টেলের হাতে তখনো একটি ছোট্ট কিন্তু সম্ভাবনাময় সুযোগ ছিল- মাইক্রোপ্রসেসর। ১৯৮০ সালে আইবিএম তাদের নতুন পার্সোনাল কম্পিউটার (পিসি)-এর জন্য চিপ বানানোর একটি ছোট কন্ট্রাক্ট দেয় ইন্টেলকে। একই সময়ে আইবিএম তরুণ প্রোগ্রামার বিল গেটসকে দায়িত্ব দেয় এই কম্পিউটারের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করার। ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে নিউইয়র্কের একটি হোটেলে আইবিএম ঘোষণা করল তাদের নতুন পিসি। দাম: ১,৫৬৫ ডলার। আর সেই কম্পিউটারের ভেতরে বসানো ছিল ছোট্ট একটি ইন্টেল চিপ।
সেই সময়ে কেবল মাইক্রোপ্রসেসরের পক্ষে বাজি ধরা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মেমরি চিপ ছিল সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির মূল ব্যবসা। তার তুলনায় মাইক্রোপ্রসেসর ছিল এক নগণ্য খাত। গ্রোভ তখন ইন্টেলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: ‘যদি আমাদের বরখাস্ত করে একজন নতুন সিইও আনা হয়, তাহলে সে কী করবে?’ মুর এক মুহূর্তও না ভেবে বললেন: ‘সে মেমরি চিপের ব্যবসা ছেড়ে দেবে।’ এই কথাতেই গ্রোভের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেল- ইন্টেল মেমরি চিপ ছেড়ে দিয়ে সব মনোযোগ দেবে শুধু মাইক্রোপ্রসেসরে।
এই সিদ্ধান্তে অনেকেরই মনে হচ্ছিল, ইন্টেল নিজের পরিচয় হারাচ্ছে; কিন্তু গ্রোভ ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। তার প্রথম পদক্ষেপ ছিল কর্মীদের ২৫ শতাংশ ছাঁটাই করা। সিলিকন ভ্যালি, ওরেগন, বার্বাডোস আর পুয়ের্তো রিকোর সব কারখানা বন্ধ করে দেয়া হলো। দ্বিতীয় পদক্ষেপ ছিল উৎপাদনে এক বড় পরিবর্তন আনা। ইন্টেলের মেমরি চিপের মান নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা ছিল। গ্রোভ আর আরেক নির্বাহী ক্রেইগ ব্যারেট কোম্পানিকে জাপানিদের পদ্ধতি অনুসরণ করতে বাধ্য করলেন। তাদের মূলমন্ত্র ছিল, ‘হুবহু নকল করো।’ এর অর্থ হলো, একটি কারখানায় যে পদ্ধতি ভালোভাবে কাজ করে, সেটি বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না করে অন্য সব কারখানায়ও চালু করতে হবে। যে প্রকৌশলীরা একসময় নিজেদের সৃজনশীলতার জন্য গর্ব করতেন, তাদের বলা হলো কেবল সিস্টেম অনুসরণ করতে। এটি ছিল ইন্টেলের সংস্কৃতির জন্য এক বড় ধাক্কা; কিন্তু ফল আসতে বেশি দেরি হলো না। উৎপাদন বেড়ে গেল, খরচ কমল এবং কারখানাগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হয়ে উঠল।
সেই সময়ে আরেকটা বৈশ্বিক বিষয় ইন্টেলকে সাহায্য করেছিল। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে জাপানি ইয়েনের মান ডলারের বিপরীতে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এতে জাপানি পণ্যের দাম বেড়ে গেল এবং আমেরিকান পণ্য সস্তা হয়ে গেল। একই সময়ে, আমেরিকায় সুদের হার কমে যাওয়ায় ইন্টেলের খরচ আরও কমল। অন্যদিকে, পিসি বাজার তখন রমরমা হয়ে উঠল। টেক্সাসের একটি ছোট কোম্পানি কমপ্যাক, আইবিএমকে চ্যালেঞ্জ জানাল সস্তা কম্পিউটার তৈরি করল। তারা ব্যবহার করল ইন্টেলের চিপ আর মাইক্রোসফটের সফটওয়্যার। এরপর আরও অনেক কোম্পানি বাজারে এসে ‘আইবিএম ক্লোন’ বানানো শুরু করল। অল্প সময়ের মধ্যেই এই ক্লোনগুলো বিক্রিতে আইবিএমকে ছাড়িয়ে গেল। কম্পিউটারের দাম কমতে শুরু করল, আর দেখতে দেখতে অফিস এবং ঘরে ঘরে পিসি প্রবেশ করল। অ্যাপল ছাড়া প্রায় সব পিসিই চলত ইন্টেলের প্রসেসর আর উইন্ডোজ সফটওয়্যার দিয়ে। ইন্টেল কার্যত মাইক্রোপ্রসেসরের বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য পেয়ে গেল।
ইন্টেলের ভেতরে গ্রোভের কার্যপদ্ধতি ছিল প্রচলিত সিলিকন ভ্যালির ঢিলেঢালা সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত। সকাল ঠিক আটটায় কাজ শুরু, দেরি মানেই সবার সামনে তিরস্কার। তিনি ‘কনস্ট্রাক্টিভ কনফন্ট্রেশন’-এ বিশ্বাস করতেন। এই কঠোর শৃঙ্খলাই ইন্টেলকে নতুন জীবন দিল। ১৯৮০ সালের শেষের দিকে ইন্টেল পুরো পিসি চিপের বাজার দখল করে নিল। প্রতি এক বা দুই বছর পর পরই তারা আনত নতুন, আরও দ্রুত গতির প্রসেসর। ইন্টেলের ব্র্যান্ড এত শক্তিশালী হয়ে উঠল যে পিসি নির্মাতারা তাদের বিজ্ঞাপনে গর্বের সঙ্গে লিখতে শুরু করল – ‘ইন্টেল ইনসাইড।’
অ্যান্ডি গ্রোভ ইন্টেলকে মেমরি চিপ থেকে সরিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মাইক্রোপ্রসেসর কোম্পানিতে রূপান্তরিত করলেন। এটি ছিল কর্পোরেট ইতিহাসের অন্যতম সাহসী কৌশলগত সিদ্ধান্ত। হার্ভার্ডের নামকরা অধ্যাপক ক্লেটন ক্রিস্টেনসেন বলেছিলেন যে, নতুন প্রযুক্তি একদিন পুরোনোকে ঠেলে সরিয়ে দেবে। অ্যান্ডি গ্রোভ নিজের কোম্পানিকে নিজেই ভেঙে দিয়ে সেই কথাকে বাস্তবে রূপ দিলেন। তার কাছে ভয় বা ‘প্যারানয়া’ ছিল টিকে থাকার এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। উদ্ভাবন বা ভাগ্যের চেয়েও গ্রোভের ব্যর্থ হওয়ার নিরন্তর ভয়ই ইন্টেলের ক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়াল সাফল্যের চাবিকাঠি।
(ক্রিস মিলারের সাড়াজাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ২২তম অধ্যায় (ডিজরাপটিং ইন্টেল) থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)
লেখক পরিচিতি:
মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে