Views Bangladesh Logo

চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-৪

ইন্টেলের বিপ্লবীরা: সিলিকনের এক নতুন যুগ

Mahmud  Hossain

মাহমুদ হোসেন

৯৬৮ সাল, বিশ্ব তখন বার্কলির ছাত্র আন্দোলন আর বেইজিংয়ের কমিউনিস্ট উত্তালতায় কাঁপছে। এরই মধ্যে ‘প্যালো অল্টো টাইমস’ একটি ছোট্ট অথচ যুগান্তকারী খবর ছাপে, যার শিরোনাম ছিল: ‘ফেয়ারচাইল্ড ছাড়লেন প্রতিষ্ঠাতারা; গড়ছেন নিজেদের ইলেকট্রনিকস কোম্পানি।’ বব নয়েস ও গর্ডন মুর, ফেয়ারচাইল্ডের করপোরেট হস্তক্ষেপে বিরক্ত আর সীমিত স্টক অপশনে অসন্তুষ্ট হয়ে নতুন কিছু গড়ার সিদ্ধান্ত নেন।

এটা তাদের বিদ্রোহ ছিল না বরং গোটা ব্যবস্থাটাকেই নতুন করে সাজানোর অভিপ্রায়ে তারা প্রতিষ্ঠা করেন ইন্টেল। তাদের বিশ্বাস ছিল, ট্রানজিস্টর একদিন হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত পণ্য, আর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মাইক্রোস্কোপিক উপাদানই হবে ভবিষ্যতের চালিকাশক্তি। তারা কল্পনা করতেন এমন এক পৃথিবীর, যেখানে সেমিকন্ডাক্টর শুধু সমাজকে সহায়তা করবে না বরং এর মেরুদণ্ড হয়ে উঠবে, আর সেই সঙ্গে প্যালো অল্টো, মাউন্টেন ভিউয়ের মতো ছোট্ট শহরগুলো পরিণত হবে বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রাণকেন্দ্রে।

মাত্র দুই বছরের মধ্যেই, ইন্টেল তাদের প্রথম বড় পণ্য DRAM (ডায়নামিক র‍্যান্ডম অ্যাকসেস মেমরি) চিপ বাজারে আনে। তখন পর্যন্ত কম্পিউটার মেমরি হিসেবে ব্যবহৃত হতো ‘ম্যাগনেটিক কোর’- ছোট্ট ধাতব তারের প্যাঁচানো রিং যা চৌম্বকত্ব (magnetism) দিয়ে ডেটা সংরক্ষণ করত। ডিজিটাল মেমরির চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পুরোনো পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা প্রকট হয়ে ওঠে।

ঠিক তখনই সমস্যার সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসেন আইবিএম-এর প্রকৌশলী রবার্ট ডেনার্ড। তিনি একটি ট্রানজিস্টরের সঙ্গে একটি ক্যাপাসিটর জোড়া দিয়ে এমন একটি ডিভাইসের প্রস্তাব করেন, যা ডিজিটাল পদ্ধতির ১ অথবা শূন্য বোঝাতে বৈদ্যুতিক চার্জকে ধরে রাখতে পারে। যেহেতু ক্যাপাসিটরের চার্জ চলে যাওয়ার কারণে এটিকে বারবার রিফ্রেশ করতে হয়, এ জন্যই এর নাম ‘ডায়নামিক’ মেমরি। আজ অবধি কম্পিউটার মেমরির মূলে রয়েছে এই DRAM চিপ।

DRAM চিপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল এটিকে সিলিকনের ওপর খোদাই করে বানানো যেত, হাত দিয়ে জোড়া লাগানোর দরকার ছিল না। ছোট, দ্রুত, নির্ভরযোগ্য ও সস্তা হওয়ার কারণে ইন্টেল DRAM-এর ওপর বিশাল বাজি ধরল। তাদের বিশ্বাস ছিল, মুরের সূত্র (Moore's Law) অনুসারে প্রতি দুই বছর অন্তর ট্রানজিস্টরের ঘনত্ব দ্বিগুণ হবে, ফলে ইন্টেল এই প্রতিযোগিতায় সবসময় এগিয়ে থাকবে।

লজিক চিপের মতো DRAM চিপকে আলাদা করে প্রতিটি ডিভাইসের জন্য ডিজাইন করতে হতো না। এগুলো ছিল জেনেরিক- অর্থাৎ ক্যালকুলেটর থেকে শুরু করে কম্পিউটার পর্যন্ত যে কোনো ডিভাইসে ব্যবহার করা যেত। এতে উৎপাদন খরচ বহুলাংশে কমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এই সেক্টরে ইন্টেলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

তবে বব নয়েস ছিলেন একজন চ্যালেঞ্জপ্রিয় মানুষ। ১৯৬৯ সালে জাপানের একটি ক্যালকুলেটর কোম্পানি ইন্টেলের কাছে তাদের নতুন ক্যালকুলেটরের জন্য ১২টি কাস্টম চিপ তৈরির অনুরোধ করে। এতে প্রয়োজন ছিল ২৪ হাজার ট্রানজিস্টর। নয়েস এই কাজটা দেন টড হফ নামের এক প্রকৌশলীকে, যিনি ছিলেন নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং কম্পিউটার আর্কিটেকচারে পারদর্শী। এই কাজে হফ এক নতুন সম্ভাবনা দেখলেন: ১২টি কাস্টম চিপ না বানিয়ে যদি একটি সাধারণ চিপ বানানো যায়, যা সফটওয়্যার দিয়ে যে কোনো কাজ করতে পারবে! এ ধারণাই হয়ে উঠল আরেকটি বিপ্লবের সূচনা।

এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিলো বিশ্বের প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর, Intel 4004। এটি ছিল একটি মাত্র চিপের মধ্যেই একটি প্রোগ্রামেবল কম্পিউটার। অন্য কোম্পানিগুলো এর আগে সামরিক প্রকল্পের জন্য গোপনে কিছু মাইক্রোপ্রসেসর বানালেও ইন্টেলই প্রথম এটি বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনে। এটি সব ধরনের প্রোডাক্টেই ব্যবহৃত হতে পারত, আর এর হাত ধরেই শুরু হয় কম্পিউটিং বিপ্লব। ইন্টেল তখন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত চিপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এবার তাদের হাতে এমন এক পণ্য আছে যা সব ধরনের ইন্ডাস্ট্রিকে আমূল পাল্টে দিতে পারে।

ভবিষ্যতের জন্য এই নতুন উদ্ভাবনের প্রভাবকে সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করেছিলেন ক্যালটেক-এর অধ্যাপক কার্ভার মিড। তিনি গর্ডন মুরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং ইন্টেলের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন। ‘Moore's Law’ নামটি তিনিই প্রথম দেন এবং হয়ে ওঠেন ডিজিটাল যুগের অন্যতম চিন্তানায়ক। সেই ১৯৭২ সালেই মিড ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন: ‘আগামী ১০ বছরের মধ্যেই আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনো না কোনোভাবে অটোমেশন চলে আসবে।’ তিনি কল্পনা করেছিলেন: ফোন, গাড়ি, হোম অ্যাপ্লায়েন্স- সবখানেই থাকবে মাইক্রোপ্রসেসর বা ক্ষুদ্র কম্পিউটার।

এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত বিপ্লব ছিল না, ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরও। বোঝা যাচ্ছিল, যারাই কম্পিউটিং সিস্টেম তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাই হবে ভবিষ্যতের ক্ষমতাধর। সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারের জ্ঞানই হবে ভবিষ্যতে আধিপত্যের চাবিকাঠি।

সিলিকন চিপ আর বাইনারি কোডের ওপর ভর করে শিল্পযুগ পেরিয়ে মানুষ প্রবেশ করল ডিজিটাল যুগে। আর ওই যুগসন্ধিক্ষণে ইন্টেলের প্রকৌশলীরা কেবল প্রযুক্তিবিদের ভূমিকায়ই ছিলেন না, তারা হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবী।

(ক্রিস মিলারের সাড়া জাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ত্রয়োদশ অধ্যায় (ইন্টেলস রেভলিউশনারিস) থেকে কিছুটা পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)



মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ