Views Bangladesh Logo

চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-১৪

ইন্টেলের ‘ইনোভেটর্স ডাইলেমা’

Mahmud  Hossain

মাহমুদ হোসেন

ময়টা ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাস। সান ফ্রান্সিসকোর ম্যাকওয়ার্ল্ড কনফারেন্সের মঞ্চে যেন ইতিহাস রচিত হতে চলেছে। একে একে মঞ্চে উঠে এলেন অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস আর ইন্টেলের সিইও পল ওটেলিনি। জবস সেদিন ঘোষণা দিলেন, এখন থেকে সব ম্যাক কম্পিউটারই চলবে ইন্টেল প্রসেসরে। সিলিকন ভ্যালির ইতিহাসে এ ছিল এক বিরাট মোড়, কারণ এতদিন পর্যন্ত অ্যাপলই ছিল একমাত্র বড় কম্পিউটার কোম্পানি, যারা ইন্টেলের x86 চিপ ব্যবহার করত না। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে পিসি জগতে ইন্টেলের আধিপত্য সেদিন চূড়ান্ত পূর্ণতা পেল।

স্টিভ জবস তখন এক জীবন্ত কিংবদন্তি- প্রযুক্তিকে শিল্পের সৌন্দর্যে রূপান্তরের এক কারিগর। এর আগে, ২০০১ সালে তার আইপড সংগীতের জগৎকেই বদলে দিয়েছিল। অন্যদিকে পল ওটেলিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের নেতা- ঠান্ডা, বিশ্লেষণভিত্তিক একজন ব্যবস্থাপক। ইন্টেলের প্রতিষ্ঠাতারা- বব নয়েস, গর্ডন মুর ও অ্যান্ডি গ্রোভ ছিলেন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী; কিন্তু ওটেলিনি ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ, হাতে এমবিএ ডিগ্রি।

ওটেলিনি যখন তিনি সিইওর দায়িত্ব নেন, ইন্টেল তখন এক দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো। আর তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সেই দুর্গ রক্ষা করা, মুনাফা ধরে রাখা। ইন্টেলের উত্থান ছিল কৌশল আর ভাগ্যের এক দারুণ মিশ্রণ। আশির দশকে আইবিএম তাদের প্রথম পিসির জন্য বেছে নিয়েছিল ইন্টেলের চিপ, আর মাইক্রোসফট তৈরি করেছিল উইন্ডোজ যা চলত সেই চিপেই।

তবে ঠিক সেই সময়ই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলেতে জন্ম নিল চিপ ডিজাইনের এক নতুন ভাবনা- Reduced Instruction Set Computing (RISC)। এটি অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো x86-এর চেয়েও কার্যকর ছিল। ইন্টেলের কিংবদন্তি নেতা গ্রোভ একবার ইন্টেলকে RISC আর্কিটেকচারে নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেলেন, কারণ এতে ইন্টেলের ব্যবসায়িক আধিপত্য ভেঙে পড়ার বিরাট ভয় ছিল। ফলে ইন্টেল রয়ে গেল সেই পুরোনো x86 আর্কিটেকচারেই।

তা সত্ত্বেও, ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে ইন্টারনেট ও ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের উত্থানে ইন্টেলের দাপট আরও বাড়ল। শুধু ঘরের পিসি নয়, অ্যামাজন, গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো টেক-জায়ান্টদের সার্ভারও চলত ইন্টেল চিপে। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি, ইন্টেল ও এএমডি মিলে দখল করে ফেলেছিল বিশ্বব্যাপী ডেটা-সেন্টার বাজারের প্রায় ১০০ শতাংশ। এক কথায়, পুরো ক্লাউডই তখন x86-এর ওপর ভর করে চলত।

ওই সময়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে শুরু হচ্ছিল এক নীরব বিপ্লব। ১৯৯০ সালে অ্যাপল ও তার দুই সহযোগী মিলে RISC-এর ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা করল ছোট্ট কোম্পানি Arm। এর প্রথম সিইও রবিন স্যাক্সবি জানতেন যে, নিজে চিপ তৈরি করা অনেক ব্যয়বহুল। তাই তিনি এক অভাবনীয় মডেলের প্রস্তাব দিলেন: Arm নিজে চিপ তৈরি করবে না, বরং তার ডিজাইন অন্যদের কাছে লাইসেন্স আকারে দেবে। এই ‘ফ্যাবলেস’ (Fabless) মডেল পুরো শিল্পকে নতুন পথে নিয়ে গেল। কোম্পানিগুলো Arm -এর ডিজাইন নিয়ে নিজেদের মতো সাজিয়ে নিত, আর উৎপাদনের জন্য চুক্তি করত TSMC -এর মতো ফাউন্ড্রির সঙ্গে।

পিসি-জগতে Arm ইন্টেল-মাইক্রোসফট জোটের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি; কিন্তু ছোট, ব্যাটারি-চালিত ডিভাইসে এর সাশ্রয়ী ডিজাইন দারুণ সাফল্য পেল। নিন্টেন্ডোর হ্যান্ডহেল্ড গেম কনসোল থেকে শুরু করে পরে মোবাইল ফোন ও ট্যাবলেট- সবখানেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল Arm। ইন্টেল তখন উচ্চ-লাভজনক পিসি বাজারে ব্যস্ত, তাই এই ‘তুচ্ছ’ বাজার তাদের কাছে কোনো গুরুত্ব পেল না।

ইন্টেলের ভেতরের কেউ কেউ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পাচ্ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে এক ম্যানেজার মিটিংয়ে পাম পাইলট হাতে নিয়ে বললেন, ‘এই মোবাইল ডিভাইসগুলো একদিন পিসির জায়গা নিয়ে নেবে।’ কিন্তু শীর্ষ কর্মকর্তারা হেসে উড়িয়ে দেন- পিসি তো বিলিয়ন ডলার আয় করে, এই ছোট খেলনা দিয়ে কী হবে? ইন্টেলের দুই দুর্গ পিসি ও সার্ভার প্রসেসরে বিপুল মুনাফার মাঝে ব্যবসা এতই নিরাপদ ছিল যে, কেউ এর বাইরে তাকাতেই পারল না।

হার্ভার্ডের অধ্যাপক ক্লেটন ক্রিস্টেনসন তখনই তার বিখ্যাত বই ‘দ্য ইনোভেটর্স ডাইলেমা’-তে সতর্ক করেছিলেন: বড় সফল কোম্পানিগুলো প্রায়ই ব্যর্থ হয় কারণ তাদের লাভজনক ব্যবসা তাদের চোখ ঢেকে রাখে। ইন্টেল হয়ে উঠল সেই তত্ত্বের এক জীবন্ত উদাহরণ।

অ্যাপল যখন ম্যাকে ইন্টেল চিপ ব্যবহার শুরু করল, তার কিছুদিন পর স্টিভ জবস আবার প্রস্তাব দিলেন- ইন্টেল কি নতুন আইফোনের জন্য প্রসেসর বানাবে? জবস ব্যাখ্যা করলেন, ফোনটি হবে অস্বাভাবিক শক্তিশালী, প্রায় এক ছোট কম্পিউটারের মতো; কিন্তু দাম রাখতে হবে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। ওটেলিনি হিসাব কষে না বলে দিলেন। ব্যস, তখনই অ্যাপল গেল আর্মের কাছে। স্যামসাংয়ের সঙ্গে মিলে তারা তৈরি করল প্রথম আইফোনের জন্য Arm -ভিত্তিক চিপ।

আইফোন বিশ্বজয় করার পর ইন্টেল তাদের ভুল বুঝতে পারল; কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারা বিলিয়ন ডলার ঢেলেও মোবাইল বাজারে ঢুকতে পারল না। অ্যাপলের Arm -ভিত্তিক ইকোসিস্টেম ততদিনে এক অদম্য দুর্গ তৈরি করে ফেলেছে। কয়েক বছরের মধ্যেই আইফোনের মুনাফা ছাড়িয়ে গেল ইন্টেলের পুরো পিসি চিপের আয়কে। যে কোম্পানি একসময় ছিল কম্পিউটার বিপ্লবের ইঞ্জিন, সে হারাল পরবর্তী বিপ্লবের ট্রেন।

ইন্টেলের এই পতন মোটেই প্রযুক্তিগত কোনো ব্যর্থতা ছিল না। তাদের ছিল বিশ্বের সেরা প্রকৌশলী, সেরা কারখানা; কিন্তু উচ্চ মুনাফা রক্ষা করাই ছিল তাদের মূল চিন্তা। ওটেলিনি, যিনি ২০০৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সিইও ছিলেন, পরে স্বীকার করেন- আইফোনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া ছিল মূলত ‘প্রফিট মার্জিন’ কমে যাওয়ার ভয়ের ফল।

প্রকৌশলীরা চেয়েছিল উদ্ভাবন; কিন্তু ব্যবস্থাপনা চেয়েছিল মুনাফা। এটাই হলো সেই ইনোভেটর্স ডাইলেমা- যখন সাফল্য এত বড় হয়ে দেখা দেয় যে, ঝুঁকি নেয়ার আর সাহস থাকে না। ইন্টেলের দুর্গ তখনো অটুট ছিল; কিন্তু দুনিয়া ততক্ষণে অন্য পথে এগিয়ে গেছে।

(ক্রিস মিলারের সাড়া জাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ৩৩তম অধ্যায় “দ্য ইনোভেটর্স ডাইলেমা” থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)

লেখক পরিচিতি: মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ