আল-জাজিরার প্রতিবেদন অবলম্বনে
স্বদেশের মুসলিম নাগরিকদের ‘বিদেশি’ বলে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাচ্ছে ভারত
[স্বদেশের মুসলিম নাগরিকদের ‘বিদেশি’ বলে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাচ্ছে ভারত। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকার বরাবর চিঠিও পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ চাচ্ছে বিষয়টির কূটনৈতিক সমাধান; কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বরং দিন দিন তাদের ‘পুশ-ইন’ বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে গত ২৪ জুন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ভিউজ বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটির সংক্ষিপ্তরূপ প্রকাশ করা হলো।]
আলীর বয়স ৫৬ বছর। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে তিনি সাইকেল সাড়ানোর কাজ করেন। হঠাৎ করেই তিনি চার দিন অনুপস্থিত। বাড়ির মানুষ চিন্তায় অস্থির হয়ে যায় তার জন্য। কোথাও কোনো খোঁজ মিলে না। চার দিন পর তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। পরিবারের মানুষকে তিনি জানান, এই চার দিন তিনি কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। তাকে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছিল। জন্মের পর থেকে জীবনভর প্রতিবেশী যে দেশটির নাম কেবল তিনি ‘গালি হিসেবে’ শুনেছেন বলে দাবি করেন সেই দেশে তাকে ঠেলে পাঠানোর কারণ স্বদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে বাংলাদেশি বলেই মনে করেছিল।
আলীর জীবনে এই দুর্ভোগ শুরু হয় গত ২৩ মে। ওই দিন রাজ্যের মোরিগাঁও জেলার কুইয়াদল নামের গ্রামের ভাড়া বাসা থেকে আসামের পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। ‘বিদেশি নাগরিকদের’ ধড়পাকড়ের ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকেই কেবল আসামে ‘বিদেশি নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর এই বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষরা হচ্ছেন- মুসলিম।
কেন হঠাৎ ভারত সরকার আসামের মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই অপবাদ জারি করল? এর পেছনের ইতিহাসটি অনেক দীর্ঘ। চা উৎপাদনের জন্য আসাম বিখ্যাত। সেই ইংরেজ আমলে চা উৎপাদনের জন্য আশপাশের বহু মানুষ আসামে ভিড় করেন। ফলে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে বাংলাভাষী মানুষের আগমন ঘটেছে আসামে। তখনো দেশভাগ হয়নি। তাই আসাম আর বাংলাদেশ একই দেশের অন্তর্ভুক্ত। আগত শ্রমিকরা তাই নিজ দেশ ভেবেই তখন থেকে আসামে বসবাস করছেন; কিন্তু এক সময় স্থানীয় আদিবাসীদের (যারা মূলত অসমিয়া ভাষায় কথা বলেন) সঙ্গে বাঙালিদের জাতিগত বৈরিতা তৈরি হয়।
এই উত্তেজনার শুরু ২০১৬ সাল থেকে। সেবার প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আসামের ক্ষমতায় আসে; কিন্তু আসাম রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মুসলিম যার সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ১০ লাখ। ভারতের যে কোনো রাজ্যের চেয়ে আসামেই মুসলিমদের সংখ্যা বেশি।
মে মাস থেকে আসামের ৩০০-এর বেশি মুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়। আলী সেই ৩০০-এর বেশি মুসলিমদের একজন। এমন তথ্য দিয়েছেন খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি বলেছেন, ‘এ ধরনের ঠেলে পাঠানো আরও জোরদার করা হবে। আমাদের রাজ্যকে বাঁচাতে আরও সক্রিয় ও উদ্যোগী হতে হবে।’
পুলিশ আলীকে আটক করে ২৩ মে। তারপর তাকে নিয়ে যায় তার গ্রাম থেকে ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে, গোয়ালপাড়া জেলার মাতিয়ায়। আসামের কথিত ‘অবৈধ’ অভিবাসীদের জন্য রাজ্যের সবচেয়ে বড় বন্দিশিবির নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে। তিন দিন পর, ২৭ মে আলীকে আরও কজনের সঙ্গে জড়ো করা হয়। আলী দেখেন পাঁচ নারীসহ তারা মোট ১৩ জন। ২৭ মে ভোরবেলায় ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) আলীসহ অন্যদের একটি ভ্যানে তোলে। ভ্যানটি তাদের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যায়।
আল-জাজিরাকে আলী বলেন, ‘আমাদের জোর করে ওপারে ঠেলে দিতে চাইছিল বিএসএফ; কিন্তু বিজিবি (বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) এবং স্থানীয় বাংলাদেশিরা প্রতিবাদ জানায়, তারা আমাদের নেবে না। কারণ, আমরা ভারতীয়।’
এর পরের ঘটনা বড় মর্মান্তিক। ভারত ও বাংলাদেশের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ নামে পরিচিত একটি খোলা মাঠে আলীসহ অন্যদের পরবর্তী ১২ ঘণ্টা হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। সারাদিন তাদের কিছু খাওয়া হয়নি। প্রতি মুহূর্তেই ভয়, আতঙ্ক।
চোখেমুখে গভীর আতঙ্ক নিয়ে আলী ও অন্যরা জলাভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে- এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। দৃশ্যটি একবার চিন্তা করুন- দুপাশে দুই সীমান্তে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে সীমান্তরক্ষীরা- মাঝখানে ১৩ জন মানুষ, তারা জানেন না তাদের কী অপরাধ! দেশ থেকেও তাদের দেশ নেই! এক দেশের সীমান্তরক্ষীরা তাদের ঠেলে পাঠাচ্ছে অন্য দেশে, সেই দেশের সীমান্তরক্ষীরা তাদের প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। না খেয়ে তারা বসে-দাঁড়িয়ে আছেন ১২ ঘণ্টা!
আল-জাজিরাকে আলী বলেন, ‘নীল আসমানের নিচে যেন জাহান্নাম দেখলাম। মনে হইতেছিল জীবন যেন আমাদের ছাইড়া যাইতেছিল।’
বাংলাদেশি গ্রামবাসী ও বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপের পর বিজিবি আলীকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে তিনি জঙ্গল পেরিয়ে ১০ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রা শেষে বাড়ি ফেরেন।
বাংলাদেশে ঠেলে পাঠনো হয়েছিল, ভারতের এমন মুসলিম নাগরিকরা আল-জাজিরাকে বলেন, বিজিবি তাদের আন্তর্জাতিক সীমান্তে রেখে যায়। সেখান থেকে অন্তত ১০০ জন নিজেরাই বাড়ি ফিরে যান। এসব দাবির সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে অনেকেই জানান, সীমান্তে ‘সাদাপোশাকে থাকা লোকজন’ তাদের গ্রহণ করেন এবং পরে হাইওয়েতে ফেলে রেখে চলে যান।
গত ২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গুলি করে ২৬ জনকে হত্যা করে সশস্ত্র গোষ্ঠী। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পাকিস্তান-সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ তোলে ভারত। ওই ঘটনার পরই ভারতে মুসলিমবিরোধী মনোভাব আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এর পর থেকেই তথাকথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বিতাড়নের প্রচার-প্রচারণা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে