ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণা সোমবার
হাসিনার মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে সময় লাগবে কত?
শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা জুলাই গণআন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রায় ঘোষণা ১৭ নভেম্বর সোমবার ঘোষণা করবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাব্যুনাল। রায়ে আসামিদের দণ্ড কিংবা খালাস যাই হোক তা সঙ্গে সঙ্গেই চূড়ান্ত রায় বলে বিবেচিত হবে না। বিচারের বিভিন্ন ধাপ পার করে সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো অনেক সময়। এমনটাই জানিয়েছেন আইনজ্ঞরা।
বিধি মোতাবেক ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর তা কার্যকর করতে বা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আপিল করতে হবে না। কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাব্যুনাল বিচারিক আদালতের মতো ট্রায়াল করলেও এটা হাইকোর্টের ক্ষমতা সম্পন্ন একটি আদালত। তাই এখানকার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে তা করতে হবে সরাসরি সর্বোচ্চ আদালতে (আপিল বিভাগ)। তবে ট্রাইব্যুনাল’স আইন অনুযায়ি ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর করতেও আপিল বিভাগে আবেদন করতে হবে, হাইকোর্টে নয়। যদিও হাইকোর্টের রায় কার্যকর করতে আপিল বিভাগে আপিল করা বাধ্যতামূলক নয়। এক্ষেত্রে আবার ট্রাব্যুনাল বিচারিক আদালতের ভূমিকায় থাকে। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের যে রায়ই হোক তার বিরুদ্ধে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ উভয়কেই আপিল বিভাগে আপিল করতে হয়।
আইনজ্ঞরা জানান, ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ তিন জনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধর রায় ১৭ নভেম্বর দেওয়া হলেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত রায়ের জন্য আরো অনেকগুলো ধাপ পার করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ২১ ধারায় বলা আছে, রায় ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে আপিলের নোটিশ দিতে হবে এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগকে তা নিষ্পত্তি করা হবে। যেখানে আসামিপক্ষ ও প্রসিকিউশন উভয়ই আপিল করতে পারে। অর্থাৎ আইন অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে আপিলের নোটিশ দিতে হয়, আপিল প্রক্রিয়াটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং এর নিষ্পত্তি সময়সাপেক্ষ হতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার পর্যালোচনা করে দেখা যায়- ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২৩ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেন নিজামী। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেনি রাষ্ট্রপক্ষ। এই আপিলের ওপর ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শুনানি শুরু হয়। ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে তার ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। ওই বছরের ১৫ মার্চ আপিল মামলাটির ১৫৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়টি রাতেই বিচারিক আদালতে গেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল-১। এরপর মৃত্যু পরোয়ানাসহ পূর্ণাঙ্গ রায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়, ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরদিন ১৬ মার্চ সকালে কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ এর কনডেম সেলে থাকা নিজামীকে মৃত্যু পরোয়ানা ও পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ে শোনানো হয়। এরপর ওই বছরের ২৯ মার্চ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন নিজামী। শুনানি শেষে গত ০৫ মে রিভিউ খারিজ ও ফাঁসি বহালের সর্বশেষ রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। ০৯ মে এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ওই রাতেই ট্রাইব্যুনাল হয়ে রায় কারাগারে গেলে কনডেম সেলে থাকা নিজামীকে তা পড়ে শোনানো হয়। পরের দিন ১০ মে দিবাগত রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিলো। অর্থাৎ ওই মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর প্রায় একক বছর ৭ মাস পরে তা কার্যকর হয়। এটি ছিলো ট্রাইব্যুনালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মামলা এবং এটি সবচেয়ে কম সময়ে চূড়ান্ত রায়ের পর কার্যকর করা হয়েছিলো।
নিজামীর মামলার রেফারেন্সে শেখ হাসিনার মামলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আগামী ১৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের দিন ধার্য আছে। আশা করছি ওই দিনই রায় ঘোষণা করা হবে। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ২১ ধারা অনুযায়ি ৬০ দিনের মধ্যে আপিলের নোটিশ দিতে হবে সর্বোচ্চ আদালতে। আপিল বিভাগে আসামিপক্ষ ও প্রসিকিউশন উভয়ই আপিল করতে পারবে। এরপর আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হবে পেনডিং মামলার সিরিয়াল অনুসারে। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তা আপিল বিভাগ দ্রুত শুনানির জন্য আনতে পারেন। যেমনটা আপনি বললেন মতিউর রহমান নিজামির মামলায় হয়েছে। এতেও প্রায় এক বছর লেগে যেতে পারে। এরপর এই শুনানি কতদিন চলবে তাও বলা যায়না। হতে পারে ২ থেকে ৩ মাস। এরপর আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করবেন। রায়ে খালাস পেলে বা শাস্তি হলে এ বিষয়ে রিভিউ আবেদন করা হবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে রায় প্রকাশের পর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে মামলার বিচারিক আদালতে অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালে পাঠাতে তা পাঠানো হবে এবং ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন। আসামি কারাগারে থাকলে তা সেই কারাগারে পাঠানো হবে। তবে পলাতক থাকলে এখানেই বিচারের সব প্রক্রিয়া শেষ হবে। অর্থাৎ আসামিকে যখন গ্রেফতার করা হবে তখন সরাসরি দণ্ড কার্যকর করা হবে। তবে তখন আসামি শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন।
এ ব্যপারে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে একই প্রক্রিয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে রায় দেওয়ার পর নির্ধারিত সময়ে আপিল বিভাগে আপিল করা, আপিল কজলিস্টে এনে তার শুনানি, চূড়ান্ত রায়, রিভিউ আবেদন, এর শুনানি ও রায় ঘোষণা- সব মিলিয়ে ট্রাইব্যুনালে বিগত দিনে হওয়া অন্যান্য মামলা মতো শেখ হাসিনার এ মামলাটিকেও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আপিল বিভাগে এর চূড়ান্ত রায় রিভিউ নিষ্পত্তি পর্যন্ত কতো দিন সময় লাগবে তা বলা যায় না। অন্যান্য মামলার রেফারেন্স অনুসারে তা হতে পারে দেড় থেকে দুই বছর অথবা আরো বেশি কিংবা কম।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে