Views Bangladesh Logo

চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-১৭

ইনটেল কীভাবে উদ্ভাবন ভুলে গেল?

Mahmud  Hossain

মাহমুদ হোসেন

য়েক দশ ধরে সেমিকন্ডাক্টর জগতে ইনটেল ছিল নিরঙ্কুশ সম্রাট, মার্কিন প্রযুক্তি শক্তির প্রতীক। তাদের আবিষ্কার করা মাইক্রোপ্রসেসর ও বিখ্যাত x86 আর্কিটেকচার ছিল পিসি থেকে ডেটা সেন্টার - সবকিছুর প্রাণ।

২০১০ সাল নাগাদ পিসি বাজারের প্রবৃদ্ধি কমলেও ইনটেলের জন্য ব্যবসা ছিল এক অফুরন্ত স্বর্ণখনি। কোম্পানিটি প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার মুনাফা করত। গবেষণা বাবদ তারা বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করত, যা টিএসএমসির চার গুণ।

এই সময়েই সেমিকন্ডাক্টর শিল্প EUV (এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট) প্রযুক্তির নতুন যুগে প্রবেশ করে। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯০-এর দশকেই ইনটেলের প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্ডি গ্রোভ EUV-তে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়নের বড় অংশের বিনিয়োগ ইনটেল থেকেই এসেছিল। কিন্তু চরম দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ইনটেল সেই প্রযুক্তিগত সুবিধা কাজে লাগাতে পারল না।

ইনটেলের পতনের পেছনে তিনটি প্রধান কারণ কাজ করছে: প্রথমত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবকে তারা সময়মতো চিহ্নিত করতে ও সেই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে; দ্বিতীয়ত, নতুন চিপ আর্কিটেকচারের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে পারেনি; এবং তৃতীয়ত, তাদের নিজস্ব উৎপাদন প্রক্রিয়ায় একের পর এক বিপর্যয়।

আজও ইনটেল আমেরিকার অন্যতম আধুনিক ও লাভজনক চিপ নির্মাতা। তবে তাদের ভবিষ্যৎ যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি অনিশ্চিত। এই অস্থিরতা কেবল একটি কোম্পানির নয়, আমেরিকার প্রযুক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নও বটে।

২০১০-এর দশকে প্রতিদ্বন্দ্বী এএমডি-সহ অন্যেরা যখন নিজেদের ফ্যাক্টরি বিক্রি করে কেবল চিপ ডিজাইনে মনোযোগ দিচ্ছিল, ইনটেল তখন তার পুরোনো 'ইন্টিগ্রেটেড মডেল' আঁকড়ে ধরে রইল, যেখানে ডিজাইন ও উৎপাদন একই কোম্পানি করে। ইনটেল দাবি করত, এর ফলে ডিজাইনের সঙ্গে উৎপাদনের নিখুঁত সামঞ্জস্য তৈরি হয়।

তবে এই মডেলের বড় দুর্বলতাও ছিল। টিএসএমসি বহু কোম্পানির চিপ তৈরি করায় তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ইনটেলের প্রায় তিন গুণ ছিল। বেশি উৎপাদন মানেই বেশি অভিজ্ঞতা, দ্রুত শেখার সুযোগ এবং আরও নিখুঁত প্রযুক্তি। ইনটেল নতুন স্টার্টআপদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবলেও, টিএসএমসি তাদের দেখত সম্ভাব্য গ্রাহক হিসেবে। টিএসএমসির লক্ষ্য ছিল, 'সবচেয়ে কম খরচে পৃথিবীর সেরা চিপ বানানো'। অন্যদিকে, ডিজাইন ও উৎপাদন - এই দুটি কঠিন কাজ একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে ইনটেল দুই দিক থেকেই পিছিয়ে পড়ল।

ইনটেলের সবচেয়ে বড় কৌশলগত ভুল ছিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) যে কম্পিউটিংয়ের জগৎটাই পুরোপুরি পাল্টে দেবে, তা সময়মতো বুঝতে না পারা। ২০১০ সালের শুরুতে ডেটা সেন্টারের সার্ভার বাজারে ইনটেলের একচ্ছত্র দাপট ছিল। অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফটের মতো টেক-জায়ান্টদের ক্লাউড ছিল ইনটেলের সিপিইউ-নির্ভর।

কিন্তু যখন ইনটেল এই বাজার দখলে খুশি, ঠিক তখনই কম্পিউটিংয়ের চাহিদা বাড়তে শুরু করল। AI-এর ক্ষেত্রে প্রচুর ডেটা এবং একই গণনা বারবার করতে হয়। কিন্তু ইনটেলের মূল পণ্য সিপিইউ এই কাজের জন্য মোটেও উপযুক্ত ছিল না। সিপিইউ কাজ করে ‘সিরিয়াল প্রসেসিং’ পদ্ধতিতে, যা AI মডেল ট্রেইন করানোর জন্য ধীর এবং ব্যয়বহুল।

অন্যদিকে, এনভিডিয়ার জিপিইউ, যা ভিডিও গ্রাফিক্সের জন্য বানানো, স্ট্যানফোর্ডের গবেষকরা AI ট্রেনিংয়ে ব্যবহার করা শুরু করলেন। জিপিইউ একই সময়ে প্যারালাল প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে অনেক গণনা করতে পারায়, AI-এর কাজের গতি নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেল। এনভিডিয়া দ্রুত AI-কেন্দ্রিক কোম্পানিতে রূপান্তরিত হলো। তারা টিএসএমসিকে দিয়ে চিপ তৈরি করিয়ে নিজেরা শুধু ডিজাইন ও সফটওয়্যার উন্নয়নে মনযোগ দেয় এবং খুব দ্রুতই আমেরিকার সবচেয়ে মূল্যবান চিপ কোম্পানিতে পরিণত হয়।

ওদিকে গুগল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট - সবাই ইনটেলকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের কাস্টম AI চিপ (যেমন গুগলের টিপিইউ) বানাতে শুরু করল। এই পরিবর্তন ইনটেলের ডেটা-সেন্টার আধিপত্যের অবসান ঘটাল।

২০১০-এর মাঝামাঝি ইনটেলও টিএসএমসিকে অনুকরণ করে ফাউন্ড্রি (অন্য কোম্পানির জন্য চিপ তৈরি) ব্যবসায় নামার চেষ্টা করে। কিন্তু ইনটেলের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। টিএসএমসি ছিল উন্মুক্ত ও গ্রাহক-বান্ধব; আর ইনটেল গ্রাহককে নিজের নিয়ম মানতে বাধ্য করতে চাইত। টিএসএমসি গ্রাহকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করত না; আর ইনটেল প্রায় সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করত। স্বাভাবিকভাবেই, ইনটেলের ফাউন্ড্রি ব্যবসা গ্রাহকের আস্থা পেতে ব্যর্থ হলো। ফলে, কয়েক বছরের মধ্যেই এই উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেল।

ইনটেল যখন ২০১৮ সালে ৫০ বছর পূর্ণ করল, তখন কোম্পানি ভেতরে ভেতরে অনেক দুর্বল - উদ্ভাবন কমে গেছে, আমলাতান্ত্রিকতা বেড়েছে, আর বাজারে শেয়ারের দাম কমছে। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল তাদের উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি আনতে ধারাবাহিক দেরি। যে EUV প্রযুক্তিতে ইনটেল দশক ধরে অর্থায়ন করেছে, সেই প্রযুক্তিই ইনটেল সবচেয়ে দেরিতে ব্যবহার করল। ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বের অর্ধেক EUV মেশিন ছিল টিএসএমসির হাতে, আর ইনটেল তখনো সেভাবে EUV চালু করতে পারেনি।

দশকের শেষে দেখা গেল, পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক চিপ তৈরি করার ক্ষমতা এখন কেবল তাইওয়ান (টিএসএমসি) এবং দক্ষিণ কোরিয়া (স্যামসাং)-এর হাতে, যারা ভৌগলিকভাব চীনের একেবারে কাছাকাছি। এর ফল হলো, যুক্তরাষ্ট্র তার সবচেয়ে উন্নত চিপ উৎপাদনের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল, যা দেশটির প্রযুক্তিগত নিরাপত্তার জন্য এক বিশাল ঝুঁকি।

(ক্রিস মিলারের সাড়াজাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ৪১তম অধ্যায় “হাউ ইনটেল ফরগট ইনোভেশন” থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)

লেখক পরিচিতি:
মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসি’র কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ