চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-১৩
লিথোগ্রাফি নিয়ে ঐতিহাসিক লড়াই
সালটা ছিল ১৯৯২। একদিন ইন্টেলের প্রযুক্তি গবেষক জন ক্যারাদারস এক অদ্ভুত অনুরোধ নিয়ে হাজির হলেন কোম্পানির সিইও অ্যান্ডি গ্রোভের কাছে। তিনি এমন একটি প্রযুক্তির গবেষণার জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলার তহবিল চাইলেন, যা তখনো কাজ করবে কি না কেউ নিশ্চিত ছিল না। সেই প্রযুক্তির নাম এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট (EUV) লিথোগ্রাফি। এই লিথোগ্রাফি হলো সিলিকনের ওপর ইলেকট্রনিক সার্কিট বসানোর এক অতি সূক্ষ্ম নির্মাণ প্রক্রিয়া। তখন ইন্টেল ছিল বিশ্বের শীর্ষ চিপ নির্মাতা, আর গ্রোভের হাতে ছিল নগদ অর্থের বিশাল ভান্ডার। তবুও তিনি বেশ সন্দিহান ছিলেন। কারণ, EUV প্রযুক্তিতে ১৩ দশমিক ৫ ন্যানোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করা হতো, যা তখনকার প্রযুক্তির চেয়ে বহু গুণ অগ্রসর।
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই মনে করতেন, এত সূক্ষ্ম আলো ব্যবহার করে চিপের গণউৎপাদন করা অসম্ভব। গ্রোভ স্বভাবতই প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এমন কিছুর জন্য টাকা চাও, যা কাজ করবে কি না আমরা তা জানি না?’ ক্যারাদারস সহজ করে উত্তর দিলেন: ‘একেই বলে গবেষণা।’ এরপর ইন্টেলের প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুর এসে গ্রোভকে মনে করিয়ে দিলেন সেই বিখ্যাত সতর্কবার্তা: যদি চিপ শিল্প আরও ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করতে না পারে, তাহলে চিপের ক্ষমতা প্রতি দুই বছরে দ্বিগুণ হওয়ার সেই ‘মুরস ল’ চিরতরে থমকে যাবে।
শেষমেশ গ্রোভ রাজি হলেন। ইন্টেল এই পরীক্ষামূলক EUV গবেষণায় বিপুল বিনিয়োগ শুরু করল। পরবর্তী বছরগুলোতে তারা এই প্রকল্পে কয়েক বিলিয়ন ডলার ঢালল, তবে নিজেরা মেশিন বানানোর জন্য নয়, বরং যাতে বিশ্বে কেউ একজন সেটা বানাতে পারে। লিথোগ্রাফি মেশিনের গবেষণা ও উন্নয়নে শত শত মিলিয়ন ডলার খরচ হতো, যা শুধু হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির পক্ষেই সম্ভব ছিল। সেই সময় লিথোগ্রাফির রাজ্যে জাপানের ক্যানন ও নাইকন-এর ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। অন্যদিকে, মার্কিন কোম্পানিগুলো ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছিল। এই কঠিন পরিস্থিতিতে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে টিকে থাকে ১৯৮৪ সালে ফিলিপস থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া ASML নামের একটা ডাচ কোম্পানি।
শুরুর দিকে ASML-এর পর্যাপ্ত অর্থ, জনবল বা পরিকাঠামো কিছুই ছিল না। টিকে থাকার জন্য তারা এক নতুন মডেল গ্রহণ করল - নিজেরা সব বানানোর বদলে তারা বিশ্বের সেরা উপাদান ও প্রযুক্তি সংগ্রহ করে একটি মেশিন তৈরি করল। তাদের এই কৌশল চমৎকারভাবে কাজ করল। জাপানি কোম্পানিগুলো যখন কেবল দেশীয় সরবরাহকারীর ওপর নির্ভর করত, তখন ASML বিশ্বজুড়ে সেরা প্রযুক্তি একত্র করত। ডাচ কোম্পানি হওয়ায় তারা যুক্তরাষ্ট্র-জাপান বাণিজ্য যুদ্ধে সময় নিরপেক্ষতা ধরে রাখে। ফলে আমেরিকান কোম্পানিগুলো সংঘর্ষ এড়াতে জাপানি যন্ত্রের বদলে ASML-এর মেশিন বেছে নিতে শুরু করে। একই সঙ্গে, ফিলিপসের হাত ধরে টিএসএমসি-এর সঙ্গে তাদের গভীর অংশীদারত্ব তৈরি হয়।
১৯৯৬ সালে ইন্টেল আমেরিকার জাতীয় গবেষণাগারগুলোর সঙ্গে EUV উন্নয়নে যুক্ত হলো। এই ল্যাবগুলোর গবেষণার দক্ষতা ছিল ঠিকই; কিন্তু বাণিজ্যিক পণ্য তৈরির সক্ষমতা ছিল না। এদিকে, কোনো আমেরিকান কোম্পানিরই EUV মেশিন বানানোর ক্ষমতা ছিল না। এক্ষেত্রে একমাত্র উপযুক্ত বিকল্প ছিল ASML, কারণ ক্যানন-নাইকন ছিল জাপানি। বিদেশি কোম্পানিকে মার্কিন জাতীয় গবেষণাগারে প্রবেশাধিকার দেওয়া নিয়ে ওয়াশিংটনে গভীর উদ্বেগ দেখা দেয়। নীতিনির্ধারকরা প্রশ্ন তোলেন: যুক্তরাষ্ট্র কি ভবিষ্যতের কম্পিউটিংয়ের জন্য অপরিহার্য এই প্রযুক্তিতে বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে? কিন্তু সেসময় বিশ্বায়নকে সবাই মেনে নিয়েছিল। মার্কিন সরকার এই শর্ত দিলো যে ASML যুক্তরাষ্ট্রে একটি কারখানা খুলবে, তবে মূল গবেষণা নেদারল্যান্ডসেই থাকবে।
২০০১ সালে ASML যুক্তরাষ্ট্রের শেষ লিথোগ্রাফি কোম্পানি SVG-কেউ কিনে নিল। আমেরিকার EUV প্রযুক্তি ASML-এর হাতে চলে যাচ্ছে জেনে কংগ্রেস ও পেন্টাগনে তীব্র উদ্বেগ সৃষ্টি হলো। তবুও বেশিরভাগ কর্মকর্তা এটাকে ‘কোল্ড ওয়ার’ যুগের ভয় বলে উড়িয়ে দিলেন। ইন্টেলসহ বড় চিপ নির্মাতারা এই চুক্তিকে সমর্থন করল। ইন্টেলের সিইও ক্রেইগ ব্যারেট তো বলেই ফেললেন, ‘এটি ছাড়া আমেরিকাতে নতুন যন্ত্রপাতির তৈরি বিলম্বিত হবে।’ তৎকালীন বুশ প্রশাসনও একমত হলো যে, তারা শুধু সামরিক বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগুলোই রক্ষা করবে; আর তাতে EUV অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
ফলস্বরূপ ASML হয়ে উঠল EUV লিথোগ্রাফির একমাত্র নির্মাতা। তাদের বিশাল ও জটিল যন্ত্রগুলো মূলত ইউরোপে তৈরি হতো, যার কিছু অংশ আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। EUV লিথোগ্রাফির ক্ষেত্রে সবাই যখন বিশ্বায়নের প্রশংসা করছিলেন, তখন বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। EUV গবেষণা আন্তর্জাতিক হলেও, এর উৎপাদন ছিল একচেটিয়া। ‘লিথোগ্রাফি যুদ্ধ’ শেষ হয়েছিল; তবে অনেক বিজয়ীর বদলে, মাত্র একজনের (ASML) জয়ের মাধ্যমে।
(ক্রিস মিলারের সাড়া জাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ৩২তম অধ্যায় ‘লিথোগ্রাফি ওয়ারস’ থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)
লেখক পরিচিতি: মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে