আশা থেকে অনিশ্চয়তার পথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
১৪ মাস আগে, একটি গণঅভ্যুত্থান আমাদের সবাইকে একরকম আশা দেখিয়েছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসে যেন নতুন দিনের স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছিল, সবাই ভেবেছিল- এবার হয়তো বদলাবে সবকিছু। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এই সরকারকে কেউ কেউ বলেছিল ‘নৈতিকতার সরকার’, কেউ বলেছিল ‘পরিবর্তনের সেতুবন্ধন’। স্বপ্নটা খুব বড় ছিল, সেটা নিয়ে কারও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু আজ, ১৪ মাস পেরিয়ে গিয়ে, কেউ জিজ্ঞেস করলে উত্তর মেলে না- এই সরকার আসলে আমাদের জন্য কী করল? এত মৃত্যু, এত রক্ত, এত ত্যাগ- সব মিলিয়ে মানুষ কী পেল? সুন্দর সুন্দর কথা আর বারবার বিদেশ সফর ছাড়া জাতির সামনে ইউনূস সাহেবের কিছুই দেখানোর মতো নেই।
প্রধান উপদেষ্টা ১৩টা দেশে ১৪ বার ঘুরেছেন- শুনলেই মনে হয়, দারুণ কিছু ঘটেছে। কিন্তু এসব সফরের আসল ফল কোথায়? বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো বাণিজ্য, বড় বিনিয়োগ, কিংবা উল্লেখযোগ্য চুক্তি- কিছুই চোখে পড়ে না। সংখ্যার দিকে তাকালে ব্যাপারটা পরিষ্কার- শুধু কথার ফুলঝুরি, বাস্তবে কিছু আসেনি। স্বপ্নটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে, হতাশা যেন সবকিছু ঢেকে ফেলেছে। রোম সফরের পর প্রোটোকল নিয়ে যত ঝামেলা হলো, এটা শুধু একটা ছোট ভুল না। বরং, এখান থেকেই বোঝা যায়- আমাদের সরকারের কূটনীতির অভিজ্ঞতা এখনো বেশ অপরিপক্ব।
এরপর যত বিদেশ সফরই হোক, মানুষ খুব একটা আশাবাদী হতে পারছে না। বড় কোনো সাফল্য নেই, না অর্থনীতিতে, না কৌশলগত দিক থেকে। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো, যখনই প্রধান উপদেষ্টা ইউরোপের কোনো সম্মেলনে যান, তখনই দেখা যায় বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীরা ভারত, ইউএই, কাতার, মালয়েশিয়া বা জাপানের মতো দেশে গিয়ে ভিসা পাচ্ছেন না।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতি আস্তে আস্তে একঘরে হয়ে পড়ছে। বাইরের দুনিয়াও আমাদের দেখে সংকটে পড়া দেশ হিসেবে, সংকট সামলানো দেশ হিসেবে নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের বড় প্রতিশ্রুতি ছিল স্বচ্ছতা আর দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন। ক্ষমতায় এসেই প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, উপদেষ্টারা খুব দ্রুত নিজেদের সম্পদের হিসাব দেবেন। সেই কথা আজও কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। এই চিত্র আসলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাস্তব চেহারা- ক্ষমতায় এলেই স্বচ্ছতার কথা ভুলে যাওয়া। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিজ্ঞা এখন খালি বুলি হয়ে গেছে। যখন শাসকদের কথা আর কাজে এত ফারাক, তখন সাধারণ মানুষের ভরসা কমতেই থাকে- এটাই স্বাভাবিক।
আইনশৃঙ্খলা এমন জায়গায় এসে ঠেকেছে, মনে হয় গলায় ছুরি ঠেকানো। আগেও বিশৃঙ্খলা দেখেছি; কিন্তু এমনটা কেউ কল্পনাও করেনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এতটা অরাজকতা, তাও আবার এতদিন ধরে- ঠিক মনে পড়ে না। ‘মবসন্ত্রাস’, ‘মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়া’, ‘পুলিশের ওপর হামলা’- এসব এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো প্রতিদিনের খবর। রাজবাড়িতে নুরাল পাগলার কবরে যা হলো, সেটা শুধু ধর্মীয় উন্মাদনা নয়, বরং কেমন যেন রাষ্ট্রের অসহায়ত্ব স্পষ্ট করে দিল। রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা আছে, তবু কাজে লাগাতে পারছে না। প্রধান উপদেষ্টা ফেসবুকে পুলিশের তথ্য তুলে ধরে বলেন- অপরাধের হার ‘স্থিতিশীল’। এই ‘স্থিতিশীল’ মানে কি অপরাধের সঙ্গে আপস করে নেওয়া? এখন তো অপরাধই আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
এ বছর খুনের সংখ্যা নতুন রেকর্ড গড়েছে। বছরের প্রথম ৯ মাসেই গড়ে প্রতিদিন ১১টা হত্যা মামলা হয়েছে। সোজা কথা, দেশটা যেন এক মরণকূপ। নদীতে অচেনা লাশ ভেসে উঠছে। গত ২২ মাসে শুধু খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা আর পিরোজপুরের নদী-খাল থেকে ৭৩টার বেশি লাশ পাওয়া গেছে- এর মধ্যে ২৭ জন কে, কেউ জানে না। এভাবে চলতে থাকলে ভয়টা শুধু বাড়তেই থাকে। অপরাধীরা আরও সাহস পায়, মানুষ আরও একা হয়ে পড়ে। এখন সবাই দেখছে- রাস্তায় বিচার করছে মব, পুলিশের হাতেও নিরাপত্তা নেই, আর রাষ্ট্র যেন অসহায় দর্শক। একটা দেশে যতক্ষণ সবাই সবার কাছে নিরাপদ না, ততক্ষণ আসলে কেউই নিরাপদ না।
বিচার বিভাগ নিয়েও কথা উঠছে। এখানেও স্বাধীনতা নেই। আগের মতোই নির্দেশের অপেক্ষা, ন্যায়বিচার কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। পুরো বিভাগটা হাঁসফাঁস করছে। সুপ্রিম কোর্টের অভিজ্ঞ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছিলেন, ‘আইন আছে, আইনের শাসন নেই’- এটাই এখন বাস্তবতা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যখন জনসমক্ষে বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতদের জামিন দেওয়া হবে না’, তখন এটা ব্যক্তিগত মত নয়, বরং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মৃত্যু ঘোষণা। এখন বিচার বিভাগকে দেখে মনে হয়, তারা নির্বাহী শাখার ছায়া হয়ে গেছে। যেখানে আদালতের স্বাধীনতা নেই, সেখানে মানুষও দ্রুত নৈতিক শক্তি হারায়- এটাই সত্যি।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর অনেকে বলেছিল, পুরোনোদের দিয়ে আর নতুন কিছু হবে না; নতুন নেতৃত্ব ছাড়া বদল আসবে না। কিছু তরুণকে উপদেষ্টা বানানো হয়েছে বটে, কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত হতাশ করেছে। কিছুদিন আগেও তরুণ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে দেখলে মনে হতো, এই ছেলেটা বুঝি সত্যিই কিছু বদলাতে পারবে। এখন তিনি আলোচনার মূল চরিত্র, কিন্তু সেটা মোটেও গর্বের কিছু নয়। অডিও ফাঁস, প্রশাসনিক দুর্নীতি, বিসিবিতে নাটকীয় নির্বাচন- সব মিলে তার নেতৃত্ব এখন ‘নতুন প্রজন্মের পুরোনো ভুল’-এর এক দৃষ্টান্ত।
তামিম ইকবাল আর কয়েকজন ক্লাব কর্মকর্তাকে বিসিবি নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া শুধু ক্রিকেটের জন্য ক্ষতিকর না, এটা আসলে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের জন্যও বড় ধাক্কা। খেলার মাঠে যেখানে ন্যায়ের বালাই নেই, সেখানে দেশের বড় ছবিতেও তো ন্যায়ের আশা করা যায় না। আরেকদিকে, এনজিওর পরিচিত মুখদের দিয়ে গড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিবেশ নিয়ে যত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলো বাস্তবতার ধুলায় মিশে গেছে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তো পলিথিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন- কিন্তু সেই যুদ্ধের ফলাফল? পলিথিন আগের মতোই আছে। আর ঢাকা এখনো বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটা, সেটাও কোনোভাবেই বদলায়নি।
কারওয়ান বাজারের পান্থকুঞ্জ পার্ক শেষ পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের নিচে চলে যাচ্ছে- এটা দেখে মনে হয়, দেশের পরিবেশ নীতিটা আসলে নিজের বিপক্ষেই কাজ করছে। এটাকে উন্নতি বলা যায় না, বরং এটা পশ্চাৎপদতা। আর সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা যদি জানেন কারা পলিথিন বানায়, কিন্তু তবুও সেখানে না যান, তাহলে এই ‘যুদ্ধ’ আসলে শুধু খবরের কাগজে ভালো শিরোনাম হয়।
বাজার-দর, বিনিয়োগ, অর্থনীতি- কিছুতেই স্বস্তির খবর নেই। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে বাড়তে সাধারণ মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসছে। চাল, তেল, ডাল- সবকিছুরই দাম লাফাচ্ছে, অথচ মানুষের আয় বাড়ছে না। গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ও ডেনিম এক্সপোর্ট লিমিটেডের পরিচালক মহিউদ্দিন রুলেন বলে দিয়েছেন, ‘বিদেশি ক্রেতারা অপেক্ষায় আছেন, কখন একটা নির্বাচিত সরকার আসবে।’ মানে, কেউই ভরসা পাচ্ছে না। বিনিয়োগ নেই, চাকরি নেই, মানুষ বেকার হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। শত শত গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকারত্বের চাপ দেশকে এক অচেনা সংকটে ফেলেছে। মনে হয়, পুরো অর্থনীতি এখন টলমল হাতে ধরে রাখছে রাষ্ট্র।
গণমাধ্যমে স্বাধীনতার নামে যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ২৬৬ জন সাংবাদিকের নামে খুন আর সহিংসতার মামলা- এটা একেবারে নজিরবিহীন দমন। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম ঠিকই বলেছেন, ‘এটা আমাদের জন্য অসম্মানের।’ একসময় সাংবাদিকদের বলা হতো ‘শেখ হাসিনার অনুগামী’, আর এখন দেখা যায়, অনেকে আবার বিএনপি বা জামায়াতের ছায়ায় চলে গেছেন। শুধু ক্ষমতা বদলেছে, স্বাধীনতার অবস্থা বদলায়নি। মিডিয়া এখন দুই মেরুর মাঝে আটকা- একদিকে রাজনৈতিক আনুগত্য, আরেকদিকে মবের ভয়। মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো অবশেষে মুখ খুলছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, সিপিজে, সিভিকাস- এই ছয়টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের চিঠি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সতর্ক সংকেত। সরকারের জবাব কী?- ‘আমরা কিছু বলবো না।’ এই নীরবতাই এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা- একটা নির্বাক কূটনীতি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসলে বদলের সরকার না- এরা যেন কেবল ‘স্থগিত উন্নয়নের পাহারাদার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জন্মটা হয়েছিল একদম বিপ্লবী পরিস্থিতিতে, সবাই ভেবেছিল বড় কিছু হবে। কিন্তু ১৪ মাস পেরিয়ে গেল, এখন পুরো ব্যাপারটাই প্রশাসনিক নিয়ম কানুনের ভেতর আটকে গেছে। নৈতিকতার প্রতীক হওয়ার কথা ছিল যারা, তারা এখন কেবল নিজেরা কীভাবে টিকে থাকবে, সেই হিসাবেই ব্যস্ত। যারা রাস্তায় নেমেছিল নতুন দিনের আশায়, তারা এখন ক্লান্ত হয়ে ছায়ায় চলে গেছে। একসময় অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবো।’ বাস্তবে দেখা গেল, বিশ্বাস গড়ে তোলা কত কঠিন, আর সেটা হারিয়ে যাওয়া কত সহজ!
এই ১৪ মাসে দেশের গল্পটা যেন আয়নায় তাকিয়ে থাকা- প্রত্যাশা আর বাস্তবতার মাঝখানে একটা বড় ফাঁক, যেটার নাম অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, ব্যর্থ নেতৃত্ব, আর ক্রমেই ম্লান হয়ে যাওয়া গণবিশ্বাস। বাংলাদেশ আবার জেগে উঠবে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এবার জাগরণ হবে শুধু প্রতিশ্রুতির জন্য না- এবার মানুষ নিজের পাওনার দাবি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে