চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-২১
করোনা মহামারি থেকে ভূ-রাজনীতির চ্যালেঞ্জ
২০২১ সালের শুরুর দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে এক বিশেষ জুম মিটিং ডাকলেন। বিশ্বের বৃহত্তম প্রযুক্তি ও উৎপাদন কোম্পানির উনিশজন সিইওকে উদ্দেশ্য করে তিনি হাতে তুলে নিলেন বারো ইঞ্চি লম্বা এক সিলিকন ওয়েফার। তিনি বললেন, আমেরিকা ‘বড় ও সাহসী’ বিনিয়োগ না করলে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। তাই ‘আমাদের খেলাটা আরও শক্তভাবে খেলতে হবে’।
প্রথাগতভাবে প্রযুক্তি কোম্পানির এই বৈঠকে ফোর্ড বা জিএম-এর মতো গাড়ি কোম্পানির থাকার কথা ছিল না। কিন্তু করোনা মহামারির অভিঘাতে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন এমনভাবে নড়বড়ে হয়েছিল যে, গাড়ি উৎপাদকরাও সেমিকন্ডাক্টর রাজনীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। ২০২১ সালজুড়ে কোটি কোটি মানুষ বুঝল, আমাদের দৈনন্দিন জীবন এই ছোট চিপগুলোর ওপর কতটা নির্ভরশীল।
এই সংকটে আঘাত এসেছিল দুই দিক থেকে: ভূ-রাজনৈতিক চাপ এবং মহামারির ধাক্কা। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আমেরিকান চিপ প্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করে। হুয়াওয়ের মতো চীনা কোম্পানিগুলো ২০১৯ সাল থেকেই চিপ মজুত করছিল এবং চীনা কারখানাগুলো ভবিষ্যতের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় দ্রুত যন্ত্রপাতি কিনে ফেলছিল। ঠিক তখনই মহামারি বৈশ্বিক চিপ সরবরাহে অস্থিরতা সৃষ্টি করল। বিশেষ করে গাড়িতে ব্যবহৃত সাধারণ লজিক চিপগুলোর ভয়াবহ ঘাটতি দেখা দিল।
সংকটের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বিভিন্ন শিল্প, বিশেষ করে গাড়ি কোম্পানিগুলোর চাহিদা ভুল হিসাব করা। ২০২০ সালে লকডাউনের কারণে পিসির বিক্রি অনেক বেড়ে গেল এবং ডেটা সেন্টার দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটল। এদিকে গাড়ি কোম্পানিগুলো ধরে নিল বিক্রি কমে যাবে, তাই তারা চিপ অর্ডার বাতিল করল। কিন্তু গাড়ির বাজার দ্রুত ঘুরে এলে দেখা গেল, চিপ কারখানাগুলো ইতোমধ্যে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা পিসি ও ডেটা সেন্টার গ্রাহকদের জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছে। গাড়ি কোম্পানিগুলোর জন্য এটি ছিল এক চরম বিপর্যয়। একেকটি আধুনিক গাড়িতে এক হাজারেরও বেশি চিপ লাগে। একটি চিপ না হলেও গাড়ি শিপমেন্ট হয় না। এর ফলে, ২০২১ সালে বিশ্বে ৭.৭ মিলিয়ন গাড়ি কম উৎপাদিত হলো।
বাইডেন প্রশাসন এই ঘটনাকে ‘সাপ্লাই চেইন সংকট’ বললেও সমস্যা ছিল ভিন্ন। ২০২১ সালে বিশ্বে রেকর্ড ১.১ ট্রিলিয়ন চিপ উৎপাদিত হয়েছে, যা ২০২০ সালের তুলনায় ১৩% বেশি। কারণ, চিপের চাহিদা খুব দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল, বিশেষত পিসি, ডেটা সেন্টার, ৫জি ফোন এবং এআই প্রযুক্তির বিস্তারের কারণে। আসলে, এই ব্যর্থতা ছিল মূলত গাড়ি কোম্পানিগুলোর, যারা ঝুঁকিপূর্ণ ‘জাস্ট-ইন-টাইম’ পদ্ধতিতে কাজ করত এবং অর্ডার বাতিল করে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেখিয়েছে, বিশ্ব রাজনীতিতে ‘চোক পয়েন্ট’ বা নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রগুলো কতটা শক্তিশালী। এই নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রগুলো বর্তমানে কয়েকটি দেশের হাতে কেন্দ্রীভূত। তাই মিত্র দেশগুলোর মধ্যেও প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে, সবাই চাইছে এই ট্রিলিয়ন-ডলারের শিল্পে বড় অংশীদার হতে।
প্রতিটি দেশই এখন চিপ শিল্পে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে:
• যুক্তরাষ্ট্র চায় নকশা ও যন্ত্রপাতিতে আধিপত্য বজায় রেখে নিজের উৎপাদন ক্ষমতা পুনর্গঠন করতে।
• ইউরোপ, জাপান, সিঙ্গাপুরও নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে।
• দক্ষিণ কোরিয়া ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে, মেমোরি চিপে নেতৃত্ব ধরে রেখে লজিক চিপে সম্প্রসারণ চাইছে।
• তাইওয়ান তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ টিএসএমসিকে কঠোরভাবে সুরক্ষা দেয়। তাদের পরিকল্পনা হলো, সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি কেবল তাইওয়ানেই থাকবে। নানজিং বা অ্যারিজোনার নতুন কারখানাগুলোতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দেওয়া হবে না।
• জাপান নিজেদের যন্ত্রপাতি ও উপাদান খাতকে শক্ত রাখতে টিএসএমসিকে কারখানা স্থাপনে ভর্তুকি দিচ্ছে।
চিপ ডিজাইন সফটওয়্যার, বিশেষায়িত যন্ত্রপাতি ও আর্কিটেকচারে আমেরিকার আধিপত্য এখনো টিকে আছে। কিন্তু তাদের দুর্বলতা হলো উৎপাদনশীলতা।
২০২১ সালে ইন্টেলের তৎকালীন সিইও প্যাট গেলসিঞ্জার টিএসএমসি ও স্যামসাংকে টেক্কা দিয়ে ইন্টেলকে আবার চিপ শিল্পের শীর্ষে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বড় বড় কারখানা তৈরি করেও তাঁর পরিকল্পনা কাজ করেনি। বর্তমানে নতুন সিইও লিপ-বু ট্যান এসেছেন ভিন্ন কৌশল নিয়ে। তিনি চাইছেন কোম্পানিকে আরও কম আমলাতান্ত্রিক, সাশ্রয়ী ও দক্ষ করে তুলতে। এই নতুন পরিবর্তনের মূলনীতি হলো, ইন্টেল শুধু নিজেদের চিপ তৈরি না করে এখন থেকে বাইরের গ্রাহকদের (যেমন এআই এবং ডেটা-সেন্টার কোম্পানি) জন্য ফাউন্ড্রি সার্ভিস বা চিপ তৈরির সেবা দেবে।
আমেরিকা তাইওয়ানের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে, কিন্তু টিএসএমসি ও স্যামসাং যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা বানালেও সেখানে সবচেয়ে অ্যাডভান্সড চিপ তৈরি হবে না। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি তারা নিজ দেশে রাখবে। এর ফলস্বরূপ, আপাতত বিশ্ব আরও বেশি তাইওয়ানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
(ক্রিস মিলারের সাড়াজাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ৫৩তম অধ্যায় “শর্টেজেজ অ্যান্ড সাপ্লাই চেইনস” থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)
লেখক পরিচিতি:
মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসি’র কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে