চলচ্চিত্র
চলচ্চিত্র উৎসব: ইতিহাস ও তত্ত্ব
১.
আদিমযুগে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ কোনো বড় শিকার ধরে যখন রাতে গোল হয়ে আগুন জ্বালিয়ে ভূরিভোজ করত, তখন সেটা ছিল তাদের খাদ্য উৎসব। চলচ্চিত্র উৎসব আধুনিক যুগের আনন্দ সম্মিলন। এখানে মনের ক্ষুধা মেটায় চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র উৎসবের ধারণাটি ইউরোপকেন্দ্রিক হলেও এর ব্যাপ্তি এখন দুনিয়ার কোণায় কোণায় ঘটেছে। মানুষ গল্প দেখার বাসনায় উৎসবে শামিল হলেও, তলে তলে এসব উৎসবের রয়েছে ক্ষমতাচর্চা, কোমল কূটনীতি, রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ের মতো বিষয়াদি।
চলচ্চিত্র উৎসবের উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিত ও লেখক মারিজকে ডে ভালকের লেখায় পাওয়া যায়, ১৮৯৮ সালে মোনাকোতে নববর্ষের দিন প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করা হয়েছিল। এরপর একে একে টরিনো, মিলান, পালেরমো, হামবুর্গ, প্রাগে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের রং। উৎসবে প্রথম পুরস্কার প্রদান শুরু হয় ইতালির এক চলচ্চিত্র উৎসবে, লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের উদ্যোগে ১৯০৭ সালে। এরপর ত্রিশের দশকে ইতালিতে ‘লা মোস্ত্রা ইন্তারনাৎজিওনাল দা’র্ত সিনেমাতো গ্রাফিকো’, ওরফে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবই প্রথম, যা নিয়মিত আসর বসাতে শুরু করে। ১৯৩২ সালে ভেনিস বিয়েনালের তত্ত্বাবধানে এই উৎসবের যাত্রা শুরু। সত্যের খাতিরে বলে রাখা ভালো, চলচ্চিত্রের শক্তিমত্তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছিলেন তৎকালের ইতালীয় নেতা বেনিতো মুসোলিনি। তিনি ভেবেছিলেন, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভালো প্রোপাগান্ডা চালানো সম্ভব। তাই ভেনিস বিয়েনালে তিনি প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অন্তর্ভুক্ত করেন। এবং ফ্যাসিবাদ প্রচারে নেমে পড়েন। ইতালির ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবটি শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে ভালো সাড়া জাগাচ্ছিল। এই সাফল্য দেখে ফ্রান্সও সিদ্ধান্ত নেয় চলচ্চিত্র উৎসব করার। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি কান চলচ্চিত্র উৎসবকে। কানের যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপজুড়ে যেন চলচ্চিত্র উৎসবের জোয়ার দেখা যায়। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব ততদিনে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত। বার্লিন তো উৎসব শুরু করে ১৯৫১ সাল থেকে। তো ভেনিস, কান, বার্লিন তথা পশ্চিমা অভিজ্ঞতাসারকে কাজে লাগিয়ে অনেক দেশই ধীরে ধীরে উৎসবকে নিয়মিত করে ফেলে। আর এতে করে রাষ্ট্রের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির সমীকরণও পাল্টাতে থাকে।
হংকং, সাংহাই, বুসানসহ পূর্ব এশিয়ার বহু শহরে বর্তমানে চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয় জাঁকজমক করে। দক্ষিণ এশিয়ার ভেতর ভারতেই কয়েকটি আন্তর্জাতিকমানের চলচ্চিত্র উৎসব হয় প্রতি বছর। কলকাতা, কেরালা ও গোয়ার কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। আর বাংলাদেশে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের কথা তো সকলেরই জানা। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া যে মহাদেশের কথাই বলি না কেন, সারা দুনিয়ায় বর্তমানে ৬ হাজারেরও বেশি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এসব উৎসবের ভেতর প্রতিযোগিতা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে নিজস্ব বর্তনী। যে বর্তনীর ভেতর দিয়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা নিজেদের যোগাযোগ রক্ষা করেন। সংশ্লিষ্ট বলতে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি এবং চলচ্চিত্র সমালোচক, সংগঠক সকলেই আছেন। অনেকে অবশ্য একে বর্তনী বা সার্কিট বলতে নারাজ। তারা একে নেটওয়ার্ক বলে থাকেন। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সারা দুনিয়ায় বছরব্যাপী যে কর্মযজ্ঞ হয়, সেখানে মূলত দুটি জিনিসের প্রবাহ হয় নিশ্চিত: সংস্কৃতি ও অর্থনীতি। আর এতে বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র কারখানা বা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যে প্রভাবিত হয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রথম দিকে উৎসব ছিল রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত, ভেনিস বা কান, মানে ত্রিশের দশক থেকে ষাটের দশকের শেষ অব্দি। সত্তরের দশক থেকে কিন্তু স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র উৎসব পালনের একটা রেওয়াজ চোখে পড়ে। বর্তমানে চলচ্চিত্র উৎসব স্বয়ং একটি ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। কারণ একে ঘিরে বিনিয়োগ হয়, নানাবিধ বাণিজ্য হয়। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের আলাপ ভিন্ন। কারণ এখানে চলচ্চিত্রকেই বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় না, আর চলচ্চিত্র উৎসব তো অনেক দূরের বাতচিত। চলচ্চিত্রকে যদি আমরা সাংস্কৃতিক কূটনীতির অংশ হিসেবে দেখতাম, তাহলে এখানে চলচ্চিত্র ও উৎসব দুটিই সমান গুরুত্ব পেত রাষ্ট্রীয়ভাবে।
২.
ইউরোপে চলচ্চিত্র উৎসব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতা পাওয়ার একটি বড় কারণ সেখানকার শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল চলচ্চিত্রের শক্তি ও সক্ষমতার জায়গাটি। যে কারণে দেখা যায় ইতালির মুসোলিনি ও তার স্বৈরশাসন ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবকে আত্মীকরণ করে ফেলেছিল। অবস্থাদৃষ্টে ফ্রান্সের মতো গণতান্ত্রিক শক্তি নিজের দেশেই শুরু করল কান চলচ্চিত্র উৎসব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষাংশে কানের মতো আরও অনেক দেশই তখন উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা শুরু করে। ভূরাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে মাথায় রেখে ঠান্ডাযুদ্ধের কালে বার্লিনও উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে কোমল শক্তির চর্চা শুরু করতে চাইল। ভুলে গেলে চলবে না, তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত শক্তি। কাজেই ইউরোপে ভেনিস ও কানের পাশাপাশি তাদের জায়গা পেতে একটু বেগ পেতে হয়েছে বৈকি।
ভূরাজনৈতিক পাশাখেলার বাইরে গিয়েও চলচ্চিত্রপ্রেমীরা উৎসবের আয়োজন করতে চাইল। এর ভেতর দুটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো লোকার্নো (১৯৪৬) ও এডিনবরা (১৯৪৭)। দেখা যায় চল্লিশের দশকের শেষভাগ থেকেই দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়ে যায়। সার্কিট বা বর্তনী নিয়ে যে কথাটি হচ্ছিল, কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, উৎসবগুলোর ভেতর একটি বর্তনী কাজ করে। আর বর্তণী আছে মানে এটি কারো না কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শুরুর দিকে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনস (ঋওঅচঋ - ফিয়াপফ) ইউরোপীয় উৎসব নিয়ন্ত্রণ করত। ভেনিস ও কান উৎসবকে তারা ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রেখে, এই দুই উৎসবেই চলচ্চিত্রের ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার ও বাজারকেন্দ্রিক বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। ১৯৫০ সালে তো বার্লিন আবেদন করেও এ-ক্যাটাগরি উৎসবের মর্যাদা পায়নি। অর্থাৎ ফিয়াপফ তাদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার প্রদানের অনুমতি দেয়নি। এই নিয়ন্ত্রণের ভেতর স্থান ও কালও অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ কোথায় কখন কোন উৎসব অনুষ্ঠিত হবে সেটি নির্ধারণ করে দিত ফিয়াপফ। স্পষ্টতই তারা ভেনিস ও কানকে সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেছে, যেন নতুন নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার এই দুটি উৎসব নির্বিঘ্নে পায়। কিন্তু এই কৌলিন্য পঞ্চাশের দশকেই ভেঙে যায়, যখন বার্লিন (১৯৫১), কার্লোভি ভেরি (১৯৫৬), স্যান সেবাস্টিয়ান (১৯৫৭) ও লোকার্নো (১৯৫৮) আন্তর্জাতিকভাবে চলচ্চিত্রকে আমন্ত্রণ ও পুরস্কৃত করা শুরু করে। পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার কারণে উৎসবগুলোর ওপর ফিয়াপফের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কমে এসেছে। তবে সেলস এজেন্টদের একটা দাপট কিন্তু উৎসবগুলোতে এখনো লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে ইউরোপ ও নর্থ আমেরিকায়।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জন্ম নেয়া উৎসবগুলোর ভেতর আন্তর্জাতিকতার ভেতর দিয়ে জাতীয়তাবাদকে উদযাপনের একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে এসবের বাইরে গিয়ে দুনিয়ার বহু উৎসব একেবারেই আঞ্চলিক চলচ্চিত্রকে উৎসাহ প্রদানের জন্য কিংবা বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যের বা জনরার ছবিকে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছে। যেমন বহু জায়গাতে স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র, এনিমেশন নির্ভর ছবির উৎসব হয়। ষাটের দশক থেকে এই প্রবণতা শুরু হলেও, আশির দশক থেকে এই ধরনের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের চলচ্চিত্র উৎসবের সংখ্যা বেড়ে যায়। আর এর ভেতর দিয়ে, মূলধারার চলচ্চিত্রের সমান্তরালে, নির্দিষ্ট চরিত্রের ছবিগুলো তৈরি করে নিতে থাকে নিজস্ব প্রযোজনা ও প্রদর্শন ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে এই চলচ্চিত্র উৎসবের সমান্তরাল বর্তনী তৈরি হয়। তৈরি হয় ভিন্নধরনের দর্শক। এসব উৎসব, উৎসবের ছবি ও উৎসবের দর্শক সবই এ-ক্যাটগারি উৎসবের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। যত দিন যাচ্ছে বিচিত্র ধরনের চলচ্চিত্র উৎসবের আবির্ভাব ঘটছে। উৎসবের নানাবিধ বৈশিষ্ট্য আখেরে চলচ্চিত্র চর্চাকেই সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
৩.
ষাটের দশক থেকে ছড়িয়ে পড়া বিচিত্র ধরনের চলচ্চিত্র উৎসবের প্রসার ও তাদের বৈশিষ্ট্য মূলত নির্ধারিত হয়েছে সময়ের প্রয়োজন অনুসারে অর্থাৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনের খাতিরে নানা রঙের উৎসব পাখা মেলেছে দুনিয়াব্যাপী। বড় উৎসবগুলোর সীমাবদ্ধতা ও তাদের রীতিনীতি মেনে চলার প্রবণতা থেকে মুক্তি পেতেও নতুন নতুন উৎসবের জন্ম হয়েছে। একেকটি উৎসব ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে উদযাপিত হয়। তেহরান ও কিউবাতে যেমন জাতীয় চলচ্চিত্রকে গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক উৎসব করা হয়। লাতিন আমেরিকা তো ইউরোপীয় চলচ্চিত্রের বিপরীতে ভিন্ন বয়ান দাঁড়া করানোর জন্য তৃতীয় চলচ্চিত্রের ধারণাকে তত্ত্ব আকারে হাজির করে। পুঁজিবাদবিরোধী রাজনৈতিক ছবির প্রাধান্য দেখা যায় পেসারো ও রটারডাম চলচ্চিত্র উৎসবে। এ-লিস্ট উৎসবে থাকা চলচ্চিত্র থেকে চোখ ফিরিয়ে, বিশ্বের অন্যান্য উৎসবে দেখানো ছবিগুলো থেকে সেরা বাছাই করা ছবিগুলো গুরুত্ব পায় লন্ডন ও ভিয়েনা উৎসবে।
মাঝারি ও ছোট আকারের উৎসবগুলো নিজেরা যেমন বিবর্তনের ভেতর দিয়ে সমাজের চাহিদাকে স্বীকৃতি দেয়ার চেষ্টা করেছে, সেরকম বড় উৎসবগুলোও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে, এখনো যাচ্ছে। ১৯৬৮ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের বাধাগ্রস্ত হওয়ার ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। ফ্রান্সে সে সময়ে ঘটে যাওয়া বিখ্যাত ছাত্র-জনতার আন্দোলন পাল্টে দেয় কান উৎসবকে। তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চলচ্চিত্র সমালোচকদের আকাক্সক্ষার মুখে পরবর্তী সময়ে কান উৎসবে যুক্ত হয় দুটি শাখা: ১৯৬৮ সালে ‘সোমেইন দো লা ক্রিতিক’ (ক্রিটিকস উইক) ও ১৯৬৯ সালে ‘কেইনজেইন দে রেয়ালিজেতর’ (ডিরেক্টর্স ফোর্টনাইট)। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে একটি শাখায় চলচ্চিত্র সমালোচকদের বাছাই করা ছবি দেখানো হয়, আরেকটিতে প্রাধান্য পায় তরুণ নির্মাতাদের কাজ। এগুলোকে বলা হয় কান উৎসবের প্যারালাল সেকশন।
বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ওরফে বার্লিনালও একইরকম পরিবর্তন ও সংযোজনের ভেতর দিয়ে গেছে। যেমন ১৯৭০ সালে স্বাধীনভাবে কিউরেটেড সেকশন হিসেবে যুক্ত হয় ‘ফোরাম দেস ইয়ুঙ্গেন ফিল্মস’ শাখাটি, সংক্ষেপে ফোরাম। তরুণ নির্মাতাদের কাজের সমাহার ঘটে এখানে। এর এক দশক পর, ১৯৮০ সালে, বার্লিনাল আরও একটি বিভাগ খোলে: ‘ইনফো-শাও’। পরবর্তী সময়ে এর নামকরণ হয় ‘প্যানোরামা’। বার্লিন উৎসবের মূল প্রতিযোগিতায় থাকে আর্টহাউজ বা কমার্শিয়াল হাউজের বড় প্রযোজনার ছবি। আর ফোরামে থাকে আভাগার্দ ঘরানার চলচ্চিত্র। আর প্যানোরামাতে স্থান পায় মূল প্রতিযোগিতা ও ফোরামের মাঝামাঝি চলচ্চিত্রগুলো। অর্থাৎ যেগুলো পুরোপুরি বাণিজ্যিক বা বড় প্রযোজনা নয়, আবার পুরোপুরি নিরীক্ষাধর্মী কাজও নয়। এদের বলা যেতে পারে মিডল সিনেমা। ২০২৫ সালে তারা যুক্ত করে নতুন পার্সপেক্টিভস সেকশন, যেখানে শুধুমাত্র পরিচালকের প্রথম চলচ্চিত্রগুলো স্থান পায়।
কান ও বার্লিনালের উদাহরণ থেকে বোঝা যায় সময় ও সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, চলচ্চিত্র কারখানার সঙ্গে যুক্ত মানুষ, চলচ্চিত্র সমালোচক ও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করতে বড় বড় উৎসবগুলো ক্রমশ নিজেদের পরিবর্তন করেছে। কিছু কিছু উৎসব আবার হয়ে উঠেছে ‘ফেস্টিভালস অব ফেস্টিভালস’। এরা প্রধান উৎসবগুলোর সঙ্গে কোনো রকম দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতায় না গিয়ে, ওসব উৎসবে দেখানো ভালো ছবিগুলো নিয়ে সাজিয়েছে নিজেদের পসরা। ১৯৫৬ সালে লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসব এই মডেল চালু করে। আর তাকে ১৯৭৬ সালে অনুসরণ করে টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসব।
৪.
চাকচিক্যময়, জৌলুসে ভরপুর সিনেমার জগৎ থেকে বেরিয়ে যেমন বিকল্প সিনেমার দুনিয়া তৈরি হয়েছিল একসময়, ঠিক তেমনি চলচ্চিত্র উৎসবের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। কান আর ভেনিসের ধাক্কায় টিকতে না পেরে তো বার্লিনাল জুন থেকে সরে ফেব্রুয়ারিতে ঠাঁই নিয়েছে ১৯৭৮ সাল থেকে। কারণ মে মাসের কান, আর সেপ্টেম্বরের ভেনিস এই দুইয়ের ভেতর স্যান্ডুইচ হতে চায়নি বার্লিনাল। আর এতে উপকার হয়েছে ইউরোপীয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিরও। কারণ বড় বড় উৎসবগুলো একটি নিয়মিত বিরতিতে হলে তাদেরও উৎসবে মহরত, প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি ও পরিবেশনে সুবিধা হয়। এই অগ্রজ ত্রয়ী উৎসবের বাইরে, ফিয়াপফের আধিপত্যকে কাটিয়ে, সত্তরের দশকে যে সানড্যান্স ও রটেরডাম চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে স্বাধীন ও শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র নিয়ে ডালা সাজাতে। বলে রাখা অপ্রয়োজনীয় নয়, ১৯৭৮ সালে শুরু হওয়া ইউনাইটেড স্টেটস ফিল্ম ফেস্টিভাল যখন ১৯৮৫ সালে মার্কিন অভিনেতা ও নির্মাতা রবার্ট রেডফোর্ডের সানডেন্স ইনস্টিটিউটের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখনই উৎসবের নাম পাল্টে রাখা হয় সানডেন্স ফিল্ম ফেস্টিভাল। সেসময় থেকে হলিউডের সঙ্গে উৎসবটি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ শুরু করে এবং ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর স্বাধীন চলচ্চিত্রের বেশ প্রভাবশালী কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
নির্মাণের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র যতটা স্বাধীন হয়েছে, উৎসবও ততটা স্বাধীন ও বিচিত্র হয়েছে দিনকেদিন। সেজন্য ষাট ও সত্তরের দশকে, নানাবিধ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটের ভেতর দিয়ে, আমরা দেখতে পাই বিবিধ পরিচয়ভিত্তিক আয়োজন সামনে উঠে আসতে শুরু করে, যেমন: নারী, শিশু, সমকামী, কৃষ্ণাঙ্গ ইতি ও আদি বিষয়ভিত্তিক চলচ্চিত্র উৎসব। সমাজতাত্ত্বিক বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’র তত্ত্বের প্রতিফলন দেখা যায় জাতিভিত্তিক বা নৃ-গোষ্ঠীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে। লিঙ্গ, বর্ণ, জাতিকে ছাড়িয়ে উৎসব এখন আবর্তিত হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা, মানবাধিকার ও পরিবেশকে কেন্দ্র করেও।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে যেভাবে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বিচিত্র বিষয়কে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্র উৎসব করার হিড়িক পড়ে যায়, তাতে উৎসব-সাহিত্যে নতুন কিছু শব্দের উদ্ভব ঘটে। চলচ্চিত্র সমালোচকরাই এসব শব্দের ব্যবহারকারী। যেমন: ইভেনটাইজেশন, ফেস্টিভালোম্যানিয়া, ফেস্টিভালাইজেশন, ফেস্টিভাল এপিডেমিক ইত্যাদি। এসব শব্দ উদ্ভবের পেছনের কারণটি হলো উৎসবের প্রারম্ভিক বর্তনী ভেঙেচুরে নতুন দিকে, নতুন নতুন মাত্রা নিয়ে, যাত্রা শুরু করেছে উৎসব, ভালো হোক কিংবা মন্দ। উৎসব তখন হয়ে উঠেছে অধ্যয়নের বিষয়, বিশেষ করে একবিংশ শতকের গোড়ায়। তখন থেকেই চলচ্চিত্র উৎসবের তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। প্রথম যুগে চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ন্ত্রিত হয়েছে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি দিয়ে। দ্বিতীয় ধারায় দেখা গেছে উৎসব প্রভাবিত হয়েছে রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনের দ্বারা। আর তৃতীয় পর্বে উৎসব অনেকটাই প্রভাবিত নয়াউদারনৈতিক অর্থনীতি, করপোরেট সংস্কৃতি ও জটিল সামাজিক মনোস্তত্ত্ব দ্বারা। এই শেষ পর্বে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটি হলো আঞ্চলিক বাজারভিত্তিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্ভব, যেমন রেড সি ফিল্ম ফেস্টিভাল। লোহিত সাগরের চারপাশের রাষ্ট্রসমূহকে বিবেচনায় রেখে সৌদি আরব আয়োজিত এই উৎসব কেবল উৎসব নয়, নিজেদের আরবি ভাষাভাষি অঞ্চলের পাশাপাশি পশ্চিমা বাজারে নিজেদের সাংস্কৃতিক পণ্য সম্প্রসারণের অভীপ্সা বা এজেন্ডা রয়েছে এই উৎসবের।
মজার বিষয়, এই তিন ধারার উৎসবই এখন আয়োজিত হয় বছরব্যাপী, বিভিন্ন শহরে। একশ বছরের অধিক সময় ধরে চলা এই উৎসবচর্চা যত দিন যাচ্ছে ততই আরও বিচিত্র ও বিষয়ভিত্তিক হয়ে উঠছে। উৎসবের আধেয়, অংশগ্রহণকারী, বিনিয়োগকারী সব মিলিয়ে ফেস্টিভাল ইকোসিস্টেম তাই এখন যথেষ্ট জটিল। আর জটিল হয়ে উঠেছে বলেই, তাত্ত্বিক আলোচনার জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে উৎসব তথা উৎসবের বাস্তুতন্ত্র।
৫.
আমরা এমন এক সময়ে এখন আছি, যখন দলবদ্ধভাবে চলচ্চিত্র দেখার সংস্কৃতি কমে এসেছে। অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রেক্ষাগৃহ কমে এসেছে। যদিও মাল্টিস্ক্রিনের সিনেপ্লেক্স বেড়েছে, তবে সেখানে শুধুমাত্র সিনেমা দেখার ব্যাপারটা থাকে না চলচ্চিত্র সেখানে খাওয়াদাওয়া, শপিং, ডেটিং ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে এক জটিল অবস্থা তৈরি করে। এমন এক পরিস্থিতির ভেতর যখন কেউ উৎসবে চলচ্চিত্র দেখতে যায়, তখন সে আসলে প্রেক্ষাগৃহ, আপনগৃহ ইত্যাদির জায়গায় উৎসবের অন্ধকার ঘরটিকে প্রতিস্থাপিত করে। উল্টো করে দেখলে চলচ্চিত্র উৎসবও দর্শককে অনেক কিছু দেয়। শুধু দর্শকের ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরেও তার অবদান অনস্বীকার্য।
চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক জ্যানেট হারবোর্ড মনে করেন, চলচ্চিত্র উৎসব আমাদের যে চলচ্চিত্র চর্চার সংস্কৃতি উপহার দেয়, উৎসব না থাকলে এই সংস্কৃতি বড় বাজেটের তারকাখচিত চলচ্চিত্রের ডামাডোলে হারিয়ে যেত। অর্থাৎ চিন্তাশীল চলচ্চিত্র নিয়ে চিন্তাশীল দর্শকের মিথষ্ক্রিয়া অনেকাংশেই কমে যেত। আমরা জানি উৎসবে কেবলমাত্র বড় প্রযোজনা সংস্থার ছবিই দেখান হয় না, বরং ভিন্ন কণ্ঠস্বরের, ভিন্ন ভাবনার ছবিগুলো স্থান পায়, যেসব ‘ভিন্নধারা’র ছবি হয় তো কোনোদিনই প্রেক্ষাগৃহে দেখতে পেত না দর্শক। এ-লিস্টের উৎসবগুলো ছাড়া বাকি উৎসবগুলোর অধিকাংশ ছবিই আসলে স্বাধীনধারার, যেখানে বাণিজ্যিক উপাদান মাখিয়ে ফর্মূলা হাজির করা হয় না। দ্বিতীয়ত, সম্মিলিতভাবে উৎসব একটি চলচ্চিত্রের পরিবেশনের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে স্বাধীন চলচ্চিত্রের জন্য, তা আসলে অন্য আয়োজনে অসম্ভব। ধরুন টিভি এই ছবি চালাবে না, কারণ তারা বিজ্ঞাপন পাবে না। বড় প্রেক্ষাগৃহ চালাবে না, কারণ এতে তারা লোকসানের মুখে পড়বে। এই কম বাজেটের ছবির জায়গায় তারা বড় তারকার ছবি চালিয়ে ব্যবসা করবে। তারচেয়েও বড় কথা, সাধারণত যেসব ভাষা চলচ্চিত্রে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে, যেমন সারা বিশ্বে ইংরেজি, উৎসব এই আধিপত্যকে খর্ব করে দেয়। এর কারণ উৎসবে প্রচুর অ-ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় এবং কিছু সময়ের জন্য হলেও মানুষ সেসব ছবি দেখে, আলাপ করে। এর পাশাপাশি ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে। উৎসবে প্রশংসিত হলে সেসব ছবির বাণিজ্যিক দিকটাও প্রসারিত হয়।
তৃতীয় যে ঘটনা চলচ্চিত্র উৎসব ঘটায়, তা হলো, একটি খোলামেলা পরিবেশে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাবনার আদানপ্রদানের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়। শুধু তাই নয়, চতুর্থত, চলচ্চিত্র নির্মাতাকেও তারা সরাসরি পান প্রশ্ন করার জন্য, ছবিটি নিয়ে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এটি এক অনন্য জানালা খুলে দেয় দর্শকের সামনে। আর পঞ্চমত, উৎসব যেহেতু একটি নির্দিষ্ট শহরে, নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হয় সেই জায়গার ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া ও স্থানীয় মানুষের মানসিক গড়নকে মাথায় রেখেই তাই আয়োজনটি করতে হয়, ধারাবাহিকভাবে একটি উৎসব হতে থাকলে, তা একটি জাতি বা গোষ্ঠীর সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। এই অংশের ভেতর পর্যটনও রয়েছে। যেমন ধরুন, ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব জানুয়ারি মাসে হয়। এ মাসটিতে বাংলাদেশে বৃষ্টি হয় না। মানুষ উৎসবমুখর থাকে। তাছাড়া উৎসবে আসা বিদেশি অতিথিরাও একটি চমৎকার আবহাওয়া পান। কান চলচ্চিত্র উৎসবেও কিন্তু একই ব্যাপার ঘটে, মে মাসে হওয়ার কারণে সেখানে আবহাওয়া থাকে অনুকূলে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে শুধু উৎসবকে উপভোগ করে না, সেই স্থানের স্থানিকতাকেও উপভোগ করে। তারা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ রিভেরার সৌন্দর্যের তারিফও করতে পারে। ব্যতিক্রম বার্লিনালে, ফেব্রুয়ারিতে আসলে জার্মানির আবহাওয়া বরফ জমাট থাকে; কিন্তু এই সময়ে তারা কেন স্থানান্তরিত হয়েছে সেটা আগেই বলেছি: কান ও ভেনিসের রাজনীতির শিকার বলা যায় কিছুটা।
৬.
চলচ্চিত্র দেখার হাজারো বিকল্প থাকা সত্ত্বেও মানুষ যে চলচ্চিত্র উৎসবে যায়, এর কারণ তারা জনপরিসরের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। একথা কেউ অস্বীকার করবে না যে চলচ্চিত্র উৎসব জনপরিসর ছাড়া উদযাপিত হওয়া অসম্ভব প্রায়, যদি সেটি অনলাইনভিত্তিক হয় তাহলে ভিন্ন কথা অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানের সভ্যদের জন্যই কেবল আয়োজন করা হয়, সেটাকেও পুরোপুরি জনপরিসর বলা যাবে না। অর্থাৎ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি কেবলমাত্র তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে থাকে, সেটিকে হয় তো ব্যাপক অর্থে জনপরিসর বলা যাবে না, তবে তারও একটি জনপরিসরের মতো চরিত্র রয়েছে।
জার্মান দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক ইয়াগান হাবামাস ‘দ্য স্ট্রাকচারাল ট্রান্সফরমেশন অব দ্য পাবলিক স্ফেয়ার’ বইতে নয়া বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থানের সঙ্গে উন্মুক্ত জায়গার চরিত্র পরিবর্তনের একটি তুলনারেখা টেনে দেখিয়েছিলেন, বিশেষ করে সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত, ব্যক্তিগত পরিসর ধীরে ধীরে জনপরিসরে রূপ নিয়েছে যা ধারণাগত ও বলয়কেন্দ্রিক (ডিসকার্সিভ) ফোরাম বৈ কিছু নয়। এখানে জনগণ সম্পর্কিত ব্যক্তিগত মতামত নিয়ে যৌক্তিক বাহাস উপস্থাপিত হয়, যে বাহাস কোনো না কোনোভাবে সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। পুরো ব্যাপারটাই ইউরোপীয় আলোকায়ন বা এনলাইটেনমেন্টের একটা প্রকল্প বলে মনে করেন হাবামাস। শুধু তাই নয়, উনবিংশ শতাব্দীতে জাতিরাষ্ট্রের ভেতর ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদের সঙ্গে জনপরিসরের সম্পর্ক নির্ণয়েরও প্রয়াস পান হাবামাস। যদিও জনপরিসরকে হাবামাস বুর্জোয়া সংস্কৃতি ও পুঁজিবাদের ভেতর কাঠামোবন্দি করে ভেবেছেন, তারপরও এই গণসংস্কৃতির যুগে হাবামাসের চিন্তা আমাদের চলচ্চিত্র উৎসবের ধারণার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
গণমাধ্যম ও যোগাযোগের শিক্ষক সিন্ডি হিং-ইয়ুক ওং দেখিয়েছেন অনেক তাত্ত্বিক হাবামাসের চিন্তার বাইরে গিয়ে জনপরিসর তথা চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে ভিন্নভাবে ভেবেছেন। অস্কার নেগট ও আলেক্সান্দার ক্লুগ যেমন মনে করেন, জনপরিসর মানেই সেটি শুধু বুর্জোয়া সম্পর্কিত নয়, সর্বহারাদেরও জনপরিসর থাকতে পারে। ন্যান্সি ফ্রেজারও প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন, তিনি মনে করেন সাব-অলটার্ন পাবলিক স্ফেয়ারের যে গুরুত্ব রয়েছে সেটি হাবামাস অবহেলা করেছেন। প্রান্তজনের জনপরিসরের পাশাপাশি ন্যান্সি ফ্রেজার পরবর্তী সময়ে ট্রান্সন্যাশনাল বা জাত্যান্তর জনপরিসরের ধারণা নিয়েও আলাপ করেছেন। জাত্যান্তর জনপরিসরের সঙ্গে আমাদের চলচ্চিত্র উৎসবের ধারণার বেশ মিল পাওয়া যায়। চলচ্চিত্র উৎসবকে তাত্ত্বিক পাঠের ক্ষেত্রে মার্কিন তাত্ত্বিক মাইকেল ওয়ার্নারের ‘জনগণ ও প্রতিজনগণ’ (পাবলিকস ও কাউন্টার পাবলিকস) সংক্রান্ত ধারণার প্রয়োগিক গুরুত্ব রয়েছে।
ওয়ার্নারের মতে জনগণ হলো যারা একটি অভিন্ন ভাষাবলয়ের ভেতর স্বেচ্ছায় একটি অভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে পরস্পর মিথষ্ক্রিয়া করে। এখন এই জনগণ ও তাদের পরিসর যদি কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে, বা এদের থেকে যদি নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ করে আরেকদল মানুষ ভিন্ন একটি জায়গায় অভিন্ন ভাষাবলয় বা ডিসকোর্স তৈরি করে, নিজেদের ভেতর ভাবনার আদানপ্রদান ঘটায়, সেখানে বিকল্প জনপরিসর গড়ে ওঠে, তখন বিকল্প জনগণের একটা চেহারা নির্মিত হয়, এটিকেই ওয়ার্নার কাউন্টার পাবলিকস বলছেন; যেমন- এলজিবিটি কমিউনিটি। প্রতিজনগণ বৈশিষ্ট্যগতভাবেই জনগণের আধিপত্য বা হেজিমনিকে অস্বস্তিতে ফেলে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, বর্তমানে নয়া উদারবাদী বুর্জোয়াদের দ্বারা আয়োজিত এ-লিস্টে থাকা চলচ্চিত্র উৎসব তথা মূলধারার জনপরিসরকে সবসময়ই খানিকটা হলেও অস্বস্তিতে ফেলে দেয় প্রান্তে থাকা মানুষদের নিয়ে, বিকল্প জনপরিসরে আয়োজিত চলচ্চিত্র উৎসবগুলো।
৭.
বর্ণে গন্ধে ছন্দে জনরাতে ভিন্ন ভিন্ন হলেও একটা জিনিস কিন্তু সকল উৎসবে ঠিকঠিক মজুত থাকে, সেটা হলো সিনেমা প্রদর্শন। এখন এই একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে চরিত্রের দিক থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর অনটোলজি বা অস্তিত্বের প্রকৃতি বোঝার ক্ষেত্রে উৎসবগুলোর দিকে জুম করে, কয়েকটি প্রশ্ন সামনে রাখা জরুরি বলে মনে করেন চলচ্চিত্র উৎসব বিশেষজ্ঞ মারিজকে ডে ভাল্ক। উৎসবের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সঙ্গে প্রেক্ষাগৃহের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পার্থক্য কোথায়? উৎসবে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হলে মানুষ যে তারিফ করে, সেটি কি অন্য কোথাও প্রদর্শিত হলে ভিন্ন হয়? প্রদর্শনীর বর্তনী বা সার্কিট হিসেবে উৎসবের অস্তিত্ব কীভাবে নির্মাতাদের প্রভাবিত করে?
এসব প্রশ্নের উত্তর ভাল্ক খোঁজার চেষ্টা করেছেন ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বরদু’র সিম্বলিক ক্যাপিটাল’ বা প্রতীকি পুঁজি ধারণার ওপর ভিত্তি করে। প্রতীকী পুঁজি বলতে বোঝায় সমাজে যখন কোনো কাজ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি ও মানমর্যাদা এনে দেয় এবং এর ফলস্বরূপ যখন সামাজিক মূল্য তৈরি হয়। বৈষয়িক সম্পত্তি, ধনদৌলত না থাকার পরও বা বলপ্রয়োগ ছাড়াও কেমন করে ব্যক্তি সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, কীভাবে সমাজের ভেতর ক্ষমতার বলয়ে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বরে পরিণত হতে পারে তা বুঝতে সহায়তা করে বরদু’র ‘প্রতীকী পুঁজি’। এটি তার সমগ্র কাজের কেন্দ্রীয় ধারণা। এই ধারণা প্রায়ই চলচ্চিত্র উৎসবকে বোঝার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সামাজিক স্বীকৃতি, গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতা প্রদানে এই প্রতীকী পুঁজি বেশ কার্যকর। আর উল্লিখিত সকল কিছুই এনে দিতে পারে একটি চলচ্চিত্র উৎসব; খোদ উৎসবকে এবং উৎসবে অংশগ্রহণকারী ও পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ও কলাকুশলীদের।
বরদুর ধারণাকে ব্যবহার করে ভাল্ক তিনটি ভাগে ভাগ করে চলচ্চিত্র উৎসবের সত্ত্বা অনুসন্ধান করেন। প্রথম ভাগের নাম তিনি দেন ‘ফিল্ড’ বা ক্ষেত্র। এটিকেই বরদু বলেন ‘ফিল্ড অব কালচারাল প্রডাকশন’। বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি ও বক্স অফিসের বাইরে গিয়ে কেমন করে চলচ্চিত্র উৎসব একটি আলাদা ক্ষেত্র তৈরি করেছে, সেটিই আলোচনা করেন ভাল্ক। ‘সাংস্কৃতিক ফল উৎপাদনের ক্ষেত্র’ বলতে বরদু বোঝাতে চেয়েছেন সমাজ নির্ণীতি পরিসরে বা ক্ষেত্রে কেমন করে শিল্পসাহিত্য ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক পণ্য তৈরি হয়, বিতরণ হয়, মূল্য তৈরি হয় এবং ভোক্তারা সেগুলোকে কীভাবে গ্রহণ করে। এই ক্ষেত্রের ভেতরেই শিল্পমূল্য নির্ধারণের বেলায় শিল্পী, সাহিত্যিক, সমালোচক প্রমুখরা নিজেদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, আবার পরস্পরকে সহযোগিতাও করে। বরদু বলেন, সমাজে রাজনৈতিক, বিচারিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ক্ষেত্রের মতো সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, রয়েছে তাদের নিজস্ব মূল্য ও নীতি।
চলচ্চিত্র উৎসবের ক্ষেত্রেও দেখা যায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও নীতি নিয়ে তারা হাজির হয়েছে। তারা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আবার বর্তনীতে যেন ঝামেলা না হয়, সেই সহযোগিতাও করে। ইউরোপে হলিউডি ছবির বাণিজ্যিক প্রভাবকে খর্ব করার অভিপ্রায়ে ইউরোপীয় চলচ্চিত্র উৎসবগুলো শুরু হলো। তারা দর্শকদের বোঝাতে সক্ষম হলো উৎসবের ছবি বাণিজ্যিক ধ্যানধারণার চেয়ে আলাদা। এখানে শিল্পসম্মত ছবির প্রাধান্য বেশি। এভাবে তারা ইউরোপীয় ছবির আলাদা বাজার তৈরি করতে সক্ষম হয়। উৎসবের ছবি কোনোভাবেই মুনাফা লাভের জন্য নয়। স্রেফ সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্যেই তারা ছবি প্রদর্শন করে, তাও আবার গোটা উৎসবে মাত্র দুই থেকে তিনবার। প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাকেন্দ্রিক নানাবিধ ব্যবসা থাকে, যেমন খাবারদাবার, টি-শার্ট, স্মৃতিস্মারক ইত্যাদি, উৎসবে সেটি থাকে না। উৎসব থেকে অনেকসময় বড় প্রযোজনার ছবিকে কিছু অর্থ দিতে হলেও সেটিকে ঠিক বাণিজ্যিক লেনদেন বলা যাবে না, কারণ অর্থের পরিমাণ এতটাই কম হয়। কাজেই চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মূলধারার বাইরে গিয়ে শিল্পের জন্য, সংস্কৃতির জন্য আলাদা যে ক্ষেত্র উৎসব তৈরি করেছে, সেটি প্রণিধানযোগ্য। পাশাপাশি এক উৎসব আরেক উৎসবের সঙ্গে সময়ের ফারাক রেখে অনুষ্ঠিত হয়, যাতে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা মুক্তি ও প্রচারণার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারে। উৎসব বর্তনীকে এভাবে সচল রাখা পরস্পরকে সহায়তা করার একটি নমুনা মাত্র। এভাবে তারা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উৎসব বর্তনীর জন্য আলাদা স্থান, মানমর্যাদা, যাকে বলে প্রতীকী পুঁজি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়।
৮.
কলাকৈবল্যবাদের পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ, নিজস্ব সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরার ভেতর দিয়ে দুনিয়ার বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে শুরু থেকে; কিন্তু এসবের বাইরে গিয়ে ভিন্ন ধরনের উৎসবে আয়োজকদের উদ্দেশ্য থাকে বুর্জোয়া শ্রেণির মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ জানানো। পিয়ের বরদু যেটাকে বলেন ‘সিম্বলিক রেভুল্যুশন’ বা প্রতীকী বিপ্লব। এই বিপ্লবে শিল্পীরা বুর্জোয়া চাহিদা ও প্রভুত্বকে অস্বীকার করে পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থাকে মুছে দিতে চায়। বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে তারা পুরোপুরি পরাজিত করতে পারে কি না, সেটি স্বতন্ত্র আলাপ; কিন্তু তাদের ভেতর একটা বিকল্প পথে হাঁটার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এই প্রচেষ্টাই বৈচিত্র্য এনে দেয় চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে।
এসব উৎসবের প্রাণভ্রমরার স্বরূপ সন্ধানে মারিজকে ডে ভাল্ক দ্বিতীয় যে চাবির আশ্রয় নেন, তার নাম ক্যাপিটাল বা পুঁজি। এটিও তিনি নেন বরদুর কাছ থেকে। বরদু পুঁজি ভাগ করেন অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রতীকী এই চার প্রকারে। মানব সন্তান নিজ নিজ ক্ষেত্রে এমন এক ক্রীড়ায় মত্ত, যেখানে নিয়ম অনুসারে সকলেই নানা ধরনের পুঁজির সঞ্চয়ন করে সমাজের বিভিন্ন জায়গায় সবচেয়ে ভালো জায়গাটি দখলের চেষ্টায় রত। একটা প্রতিযোগিতা রয়েছে সেখানে। বৈষয়িক ধনদৌলত সঞ্চয়ের মাধ্যমে মানুষ অর্থনৈতিক পুঁজি সংগ্রহ করতে চায়। সামাজিক সযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য সে সমাজের অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে সামাজিক পুঁজি সঞ্চয় করতে চায়। পড়ালেখা, জ্ঞানার্জন ও সাংস্কৃতিক দক্ষতা অর্জন তথা সাংস্কৃতিক পুঁজি সঞ্চয়নের ভেতর দিয়ে মানুষ বিশেষ ক্ষেত্রে শ্রদ্ধা আদায় করতে চায়। আর সম্মান, স্বীকৃতি ও গৌরব অর্জনের মাধ্যমে মানুষ প্রতীকী পুঁজি সঞ্চয় করে। এই পুঁজি সঞ্চয় করে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে চায় স্ব-স্ব ক্ষেত্রে।
বরদু’র প্রতীকী পুঁজির ধারণাকে প্রয়োগ করে খুব সহজেই বোঝা যায় কেন একদল মানুষ বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র তৈরি করেন আর কেন আরেকদল লোক আভা-গার্দ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছবি বানান। কারো প্রয়োজন অর্থনৈতিক পুঁজি, কারো বা প্রতীকী পুঁজি। উৎসবগুলো যারা পরিকল্পনা করেন, বিন্যাস করেন, তাদের ভেতরেও এই দুই ধরনের ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। ব্যবসায়িক সাফল্য পাওয়া ছবির পেছনে না ছুটে অনেক উৎসব নান্দনিক, শিল্পসম্মত ও চিন্তাশীল চলচ্চিত্রকে মূল্য দেয়। এই মূল্য অবশ্য বাজারি মূল্য নয়, প্রতীকী মূল্য। এই মূল্য প্রদানের মাধ্যমে সেসব ছবিকে উৎসবগুলো যেমন সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি দেন, তেমনি সাংস্কৃতিক বৈধতাও দেন। এই স্বীকৃতি ও বৈধতার জোরে চলচ্চিত্র ও সংশ্লিষ্টরা সমাজের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে মানমর্যাদা নিয়ে চলতে পারে।
তথাকথিত মূলধারা ও বিকল্প চলচ্চিত্র উৎসবগুলো বেশিরভাগ সময়েই প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে এমন চলচ্চিত্র নির্বাচিত করে, যেসব কাজ প্রেক্ষাগৃহে বেশিদিন টিকতে পারবে না, তরুণদের নিরীক্ষা থাকে, বড় তারকা থাকে না, বাজার চলতি চলচ্চিত্রের চেনাজানা বয়ান বা বাঁধাধরা সূত্র থাকে না। তো এসব ছবিকে উৎসবে প্রদর্শনের সুযোগ ও স্বীকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক ছবির বাইরেও যারা ছবি বানাচ্ছেন তাদের জন্য বড় ধরনের প্রতীকী পুঁজি সঞ্চয়ের সুযোগ করে দেয় উৎসবগুলো। ভুলে গেলে চলবে না, প্রতীকী মূল্যকে কাজে লাগিয়ে অনেক চলচ্চিত্র উৎসব অর্থনৈতিক পুঁজিও সঞ্চয় করতে পারে। তবে এই সঞ্চয়ের সঙ্গে বাণিজ্যিক ছবির অর্থনৈতিক পুঁজি সঞ্চয়ের তুলনা চলে না। উৎসব কখনোই বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে না। তারা অর্থনৈতিক পুঁজি সঞ্চয় করে পরবর্তী উৎসব আয়োজনকে মসৃণ করতে।
৯.
পুঁজির রূপান্তর নিয়ে পিয়ের বরদু যে আলাপ করেছেন তা চলচ্চিত্র উৎসব ও প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। ইউরোপে আর্ট সিনেমা বলতে যা বোঝায়, সেসব ছবি কানের মতো উৎসবে প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হলে প্রতীকী পুঁজি তাদের রূপান্তরিত হয় অর্থনৈতিক পুঁজিতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আব্দেলাতিফ কেশিশের ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার’ (২০১৩) ছবিটির কথা। ২০১৩ সালে এই ছবিটি কানে পাম ডি’অর পুরস্কার জেতার পর সারা দুনিয়ায় প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির জন্য অনেক পরিবেশক পেয়ে যায়। আর বিভিন্ন উৎসব বর্তনীতে ঘোরার সুবাদে বক্স অফিসেও তারা সাফল্য পায়। অবশ্য আব্দেলাতিফের ছবিটি ব্যবসা সফল হওয়ার পেছনে আরও একটি বড় কারণ ছিল ছবিটির বিষয় ও দৃশ্য। নারী সমকামিতা ও ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের দীর্ঘ দৃশ্য ছবিটিকে ব্যবসার ক্ষেত্রে সহায়তা করে।
কোনো চলচ্চিত্র বড় কোনো উৎসবে পুরস্কার পেলে তো কথাই নেই, তবে কোনো ছবি যদি কেবল অফিশিয়াল সিলেকশনেও যায়, তখনও একটি ছবির ব্যবসা করার বিভিন্ন পথ তৈরি হয়ে যায়। স্টিফেন মেজিয়াস নামের একজন তার সহযোগীদের নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে ইউরোপের বড় বড় উৎসবে পুরস্কার জেতা ছবিগুলো কীভাবে ভালো ব্যবসা করে। শুধু তাই নয়, পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পাওয়া ছবিগুলোও দর্শকের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমরা দেখেছি, কোনো চলচ্চিত্র যে কোনো উৎসবে প্রদর্শন ও পুরস্কৃত হলে, সেই উৎসবের লোগো পোস্টারে ব্যবহার করে। প্রচারের ক্ষেত্রে উৎসবের লরেল ব্যবহার দর্শককে যে কিছুটা হলেও আগ্রহী করে তোলে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পুরস্কার জিতলে তো কথাই নেই। কাজেই আর্ট সিনেমার ক্ষেত্রে বলা যায়, তারা যদি অর্থনৈতিক পুঁজি সঞ্চয় করতে চায়, তবে পূর্বশর্ত হিসেবে উৎসবে অংশ নেওয়ার বিকল্প খুব একটা নেই।
উল্টো দিকে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিও কিন্তু নিজেদের অর্থনৈতিক পুঁজি সঞ্চয়ের পথ থাকলেও প্রতীকী পুঁজির জন্য দ্বারস্থ হয় উৎসবগুলোর। উৎসবও এসব ছবির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার করে। এতে করে দ্বিপাক্ষিক লাভ হয়। বাণিজ্যিক ছবি উৎসবের বর্তনীতে সম্মানজনক পরিবেশে নিজেদের যুক্ত করে পেরে একধরনের সাংস্কৃতিক বৈধতা আদায় করে। যেমন হলিউডের অনেক বড় বাজেটের ছবি প্রথম প্রদর্শিত হয় কানের মতো উৎসবে। যেমন: দ্য গ্রেট গেটসবি (২০১৩), ম্যাড ম্যাক্স: ফিউরি রোড (২০১৫), টপ গান: মেভেরিক (২০২২) ইত্যাদি। এসব ছবি দেখিয়ে উৎসবও কিন্তু লাভবান হয়। সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয় উৎসব। নিজেদের ছবির প্রচারের জন্য মহাতারকারা উৎসবে আসেন, এতে করে উৎসবের লালগালিচা হয়ে ওঠে তারকাখচিত। আর এই জৌলুস যুক্ত হওয়ার কারণে উৎসব অনেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। যে উৎসবের যত অর্থ উৎসব বর্তনীতে সে তত বড় খেলোয়ার হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। শুধু প্রয়োজন একটু সময়ের। অর্থ ঠিকঠাকভাবে ঢালার পাশাপাশি কয়েকটা বছর নিয়মিত উৎসব আয়োজন করে যেতে পারলে সেই উৎসব ধীরে ধীরে খ্যাতি ও সম্মান লাভ করতে শুরু করে। এই প্রতীকী পুঁজিকেই উৎসব সম্বল করে চলতে পারে আগামীর পথে। বরদু’র ক্ষেত্র তত্ত্বানুসারে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রত্যেকে তাদের পুঁজি নিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়ের লিপ্ত। চলচ্চিত্র উৎসবও তার ব্যতিক্রম নয়।
বিধান রিবেরু: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে