ফিফা বিশ্বকাপের ড্র, কঠিন গ্রুপে কারা, সহজ প্রতিপক্ষ পেল যারা
ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ও বিশাল পরিসরে অনুষ্ঠিত হলো ফিফা ২০২৬ বিশ্বকাপের ড্র। শুক্রবার মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের কেনেডি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় এই ড্র। যেখানে চূড়ান্ত হয়েছে ২০২৬ ফুটবল বিশ্বকাপের চূড়ান্ত লাইনআপ।
বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে একটি দেশের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই নির্ভর করে এই ড্রয়ের ওপর। কোন দল কোন গ্রুপে পড়ল, কোন দলের পথ কতটা সহজ বা কঠিন হলো—সবকিছুর ফয়সালা তো এখানেই। আগামী বছরের ১১ জুন শুরু হবে এই ফুটবল মহাযজ্ঞ। উদ্বোধনী ম্যাচের ঠিক ১৮৮ দিন আগে ওয়াশিংটনে বসে এই ভাগ্য নির্ধারণী মিলনমেলা। বিশেষ কায়দায় পটের মাধ্যমে দলগুলোকে র্যাংকিং-এর শক্তিমত্তা, আগের আসর ও আয়োজক দেশের হিসাব করে আলাদা করে এই লটারি করা হয়েছে, যাতে শিরোপা প্রত্যাশী ফ্রান্স, স্পেন, ইংল্যান্ড, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার যদি দেখা হয়েও যায়, তা সেমিফাইনালের আগে হবে না।
কোন দেশ খেলবে কোন গ্রুপে:
এবারের বিশ্বকাপে ১২টি গ্রুপ। এখান থেকে প্রতিটি গ্রুপের শীর্ষ ও রানারআপ দল অর্থাৎ ১২ গ্রুপ থেকে ২৪টি দল সরাসরি দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে। আর ১২ গ্রুপ থেকে সেরা তৃতীয় ৮টি দল নিয়ে মোট ৩২ দল খেলবে দ্বিতীয় রাউন্ড। সেখানে নকআউট পদ্ধতিতে তৃতীয় রাউন্ডে যাবে ১৬ দল। এরপর তৃতীয় রাউন্ডে বিজয়ী দল খেলেবে কোয়ার্টার ফাইনাল। এরপর চার দলের সেমি ফাইনাল থেকে বিজয়ী দুই দলের বহু আকাঙ্ক্ষিত ফাইনাল ম্যাচ আগামী ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে।
প্রতিটি গ্রুপে রয়েছে চারটি দল। গ্রুপ 'এ'- মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, উয়েফা প্লে-অফ 'ডি': ডেনমার্ক/চেক প্রজাতন্ত্র/আয়ারল্যান্ড/উত্তর মেসিডোনিয়া-এর মধ্যে একটি দেশ। গ্রুপ 'বি'- কানাডা, সুইজারল্যান্ড, কাতার, উয়েফা প্লে-অফ 'এ': ইতালি/ওয়েলস/বসনিয়া-হার্জেগোভিনা/নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এর মধ্যে একটি দেশ। গ্রুপ 'সি'- ব্রাজিল, মরক্কো, স্কটল্যান্ড, হাইতি। গ্রুপ 'ডি'- যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, প্যারাগুয়ে, উয়েফা প্লে-অফ 'সি': তুরস্ক/স্লোভাকিয়া/কসোভো/রোমানিয়া এর মধ্যে একটি দেশ। গ্রুপ 'ই'- জার্মানি, ইকুয়েডর, আইভরিকোস্ট, কুরাসাও। গ্রুপ 'এফ'- নেদারল্যান্ডস, জাপান, তিউনিসিয়া, উয়েফা প্লে-অফ 'বি’: ইউক্রেন/পোল্যান্ড/আলবেনিয়া/সুইডেন এর মধ্যে একটি দেশ। গ্রুপ 'জি'- বেলজিয়াম, ইরান, মিশর, নিউজিল্যান্ড। গ্রুপ 'এইচ'- স্পেন, উরুগুয়ে, সৌদি আরব, কেপ ভার্দে। গ্রুপ 'আই'- ফ্রান্স, সেনেগাল, নরওয়ে, ফিফা প্লে-অফ ২: ইরাক/ বলিভিয়া/ সুরিনাম এর মধ্যে একটি দেশ। গ্রুপ 'জে'- আর্জেন্টিনা, অস্ট্রিয়া, আলজেরিয়া, জর্ডান। গ্রুপ 'কে'- পর্তুগাল, কলম্বিয়া, উজবেকিস্তান, ফিফা প্লে-অফ ১: গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো/জ্যামাইকা/নিউ ক্যালেডোনিয়া এর মধ্যে একটি দেশ। এবং গ্রুপ 'এল'- ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, পানামা ও ঘানা।
৪৮ দলের অংশগ্রহণে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই টুর্নামেন্টে কোন গ্রুপ সবচেয়ে কঠিন— এ নিয়ে ক্রীড়া বিশ্লেষকদের জোর আলোচনা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। আর সেই আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে গ্রুপ–এল, গ্রুপ–আই ও গ্রুপ–সি, যেখানে অংশ নেওয়া প্রতিটি দলই এবারের বিশ্বকাপে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। ড্রয়ের পরেই এই গ্রুপগুলোকে বলছেন ‘গ্রুপ অব ডেথ’। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হয়ে উঠেছে গ্রুপ–এল,যেখানে রয়েছে ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, ঘানা ও পানামা। ইংল্যান্ড ইউরোপের শীর্ষ শক্তি। ১৯৬৬ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এবং দুইবারের রানার্স–আপ তারা। এবার গ্যারেথ সাউথগেট–পরবর্তী নতুন যুগে প্রবেশ করা ইংল্যান্ড শক্তি, অভিজ্ঞতা ও গভীর স্কোয়াড নিয়ে আসরে নামবে শিরোপার অন্যতম দাবিদার হিসেবে। দলে রয়েছে জুড বেলিংহাম, হ্যারি কেন, ডেক্লান রাইস ও বুকায়ো সাকার মতো তারকা খেলোয়াড়। শক্তিমত্তায় ক্রোয়েশিয়া ফিফা বিশ্বকাপের ধারাবাহিকতার প্রতীক। ২০১৮ সালে রানার্স–আপ এবং ২০২২ সালে সেমিফাইনালিস্ট—বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়া মানেই ভয়ংকর প্রতিপক্ষ। অভিজ্ঞতা ও টেকনিক্যাল ফুটবলে তারা এখনো বিশ্বের অন্যতম সেরা। লুকা মদরিচ, মাতেও কোভাসিচ ও জোস্কো গভার্দিওল এই আসরে দলকে নেতৃত্ব দেবেন। ঘানা আফ্রিকার অন্যতম শক্তিশালী দল। শারীরিক সক্ষমতা, গতি ও টেকনিক্যাল ফুটবলে তারা বড় দলের জন্য সবসময়ই কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
সামগ্রিক শক্তি, অভিজ্ঞতা, গতি এবং ব্যালান্সড স্কোয়াড—সব দিক বিবেচনায় ডেথ গ্রুপের আলোচনায় উঠে এসেছে গ্রুপ–সি, যেখানে রয়েছে ব্রাজিল, মরক্কো, স্কটল্যান্ড ও হাইতি। ব্রাজিল,পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ও বড় মঞ্চের রাজা। যে কোনো আসরে তারা ফেভারিট। নতুন প্রজন্মের তারকারা গতি, টেকনিক ও আক্রমণে দুর্দান্ত। নেইমার ও ভিনিসিয়ুস জুনিয়র এ দলকে নেতৃত্ব দেবেন। মরক্কো ২০২২ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্ট। সেই আসরে ইতিহাস গড়ে সেমিফাইনালে ওঠা মরক্কো এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা সংগঠিত দল। আশরাফ হাকিমির নেতৃত্বে তাদের রক্ষণ, কাউন্টার অ্যাটাক এবং দলীয় শৃঙ্খলা বড় বড় দলগুলোকেও চাপে ফেলে দিতে পারে। ব্রাজিলের বিপক্ষেও তাদের দেখা যেতে পারে সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা। স্কটল্যান্ড ইউরোপের কঠিন প্রতিপক্ষ। ইউরোপীয় বাছাইপর্বে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে তারা প্রমাণ করেছে যে তারা আর ছোট দল নয়। শক্তিশালী রক্ষণ, শারীরিক ফুটবল ও সেট–পিসে দক্ষতা স্কটল্যান্ডকে যেকোনো সময় ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা দেয়।
ডেথ গ্রুপের আলোচনায় রয়েছে আরো রয়েছে গ্রুপ–আই, যেখানে আছে ফ্রান্স, সেনেগাল ও নরওয়ে। সঙ্গে থাকতে পারে ইরাক কিংবা বলিভিয়া।
২০২২ সালের রানার্স–আপ ফ্রান্স এবারের আসরেও শিরোপার অন্যতম দাবিদার। কিলিয়ান এমবাপ্পেকে নিয়ে তারকায় ঠাসা ফরাসি দল ফুটবল বিশ্বকে আবারও চমকে দিতে পারে। তাদের গ্রুপে থাকা আফ্রিকার ‘টারাঙ্গা লায়ন’ সেনেগাল এবং ইউরোপের উদীয়মান শক্তি নরওয়েও শক্তিমত্তার বিচারে পিছিয়ে নেই। প্লে-অফ খেলে এই গ্রুপে আসতে চলা ইরাক কিংবা বলিভিয়াও দারুণ গতিশীল ফুটবল খেলে প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলার সক্ষমতা রাখে ।
গ্রুপ 'এইচ'- এ আছে স্পেন, উরুগুয়ে, সৌদি আরব ও কেপ ভার্দে। বর্তমানে বিশ্বে অন্যতম শক্তিশলি দল স্পেন। শিরোপার দাবিদার এই দলের গতিশীল ও ছন্দময় ফুটবলের সামনে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা খুব কম দলেরই আছে। তাই এইচ গ্রুপে যারা আছে তাদের সঙ্গে খেলে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া স্পেনের জন্য কঠিন হবে না বলেই মত বিশ্লেষকদের।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে