Views Bangladesh Logo

অবসান হচ্ছে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ আর ভোগান্তির

ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে বিরোধের ঘটনা দেশে বহু পুরোনো। ভূমি মালিকানা সংক্রান্ত বিষয়ে দেশের দেওয়ানি আদালতগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য মামলা দায়ের হয়। অন্যদিকে জমির বিভিন্ন জরিপ ও দালিলিক ভুলের কারণে ভোগান্তিও নতুন কিছু নয়; কিন্তু এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যায়। এমন পরিস্থিতিতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিরোধ ও মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করেছে সরকার। এই সংশোধিত আইন আগামী ৭ সেপ্টেম্বর থেকেই কার্যকর হবে। আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।


মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে প্রথম আপস বণ্টননামা দলিল বাধ্যতামূলক করা হলেও এখন পর্যন্ত এর প্রয়োগ একেবারেই সীমিত। অনেকেই মৌখিকভাবে বা সাধারণ স্ট্যাম্পে চুক্তি করে জমি ভাগাভাগি করছেন যা পরবর্তীতে ভয়াবহ আইনি জটিলতা তৈরি করত। এই সমস্যা নিরসনে ও স্বচ্ছতা আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দেওয়ানি আইন সংশোধন করেছে। এতে বণ্টননামা দলিল বাধ্যতামূলক, মৌখিক বণ্টন বাতিল ও ওয়ারিশগণের সম্মতি ছাড়া নিজ অংশের সম্পত্তি এককভাবে বিক্রি বা দান নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।


নতুন সংশোধিত আইন অনুযায়ী- উত্তরাধিকার সম্পত্তি ভাগ করতে হলে এখন থেকে অবশ্যই রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে সব শরিকের উপস্থিতিতে ‘আপস বণ্টননামা দলিল’ রেজিস্ট্রি করতে হবে। কোনো ধরনের মৌখিক ভাগ-বণ্টন আইনত গ্রহণযোগ্য হবে না এবং এতে ভবিষ্যতে দলিল সংশোধনের সুযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রেজিস্ট্রিকৃত বণ্টননামা দলিল ছাড়া কোনো উত্তরাধিকারী তার অংশের জমি নিজের নামে নামজারি করতে বা অন্য কারও কাছে বিক্রি, দান বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করতে পারবেন না। কেউ এই আইন অমান্য করে দলিল ছাড়া জমি ক্রয় বা বিক্রি করলে তা ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩’ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সংশোধিত এই আইনে অপরাধীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। এছাড়া জমির খাজনা, নামজারি এবং দখল নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি ও প্রতারণা এড়াতে সরকার জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।


অন্যদিকে দেশে ভূমি মালিকদের অন্যতম দীর্ঘদিনের সমস্যা ছিল রেকর্ড খতিয়ানের ভুল। এই ভুলের কারণে অনেক ভূমি মালিক নিজেদের সম্পূর্ণ মালিকানা পুনরায় প্রমাণ করতে পারছেন না। কখনো কখনো পরিবার বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির ভাগও ঠিকভাবে সংরক্ষিত হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বছরের পর বছর আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। আইন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের ফলে খতিয়ানের ভুল সংশোধনের জন্য আর কোনো ভূমি মালিককে দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে হবে না। সংশোধন প্রক্রিয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট সহকারী কমিশনার ভূমি (এসএলআর) এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের।


অন্যদিকে বিভিন্ন জরিপ যেমন সিএস, এসএ, আরএস, বিএস, বিআরএস এবং সিটি সার্ভে এবং অন্যান্য এনালগ রেকর্ডে বহু ভুল দেখা গেলে বা নামের বানান, অংশের ঘর, দাগ নম্বর ও জমির পরিমাণে ত্রুটি থাকলে মালিকানা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। নতুন সংশোধিত আইনের ফলে এখন থেকে ভূমি মালিকরা সরাসরি সংশ্লিষ্ট এসএলআরের কাছে আবেদন করে সংশ্লিষ্ট ভুল সংশোধন করতে পারবেন। এছাড়া যাদের মালিকানা স্বত্ব বিলুপ্ত হয়ে অন্য কারো নামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তারাও প্রয়োজন হলে আদালতে মামলার মাধ্যমে তাদের মালিকানা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। সরকারের এই উদ্যোগের মাধ্যমে ভূমি মালিকদের দীর্ঘদিনের সমস্যা দূর হবে এবং অতিরিক্ত খরচ ও আদালতে বছরের পর বছর দৌড়াদৌড়ি করার ঝামেলা দূর হবে। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর থেকে পুরোপুরি কার্যকর হবে এই সংশোধিত আইনটি।


এ ব্যাপারে দেওয়ানি আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘নতুন সংশোধিত আইনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে সেইসব পরিবারের ওপর যাদের পূর্বপুরুষদের জমি এখনো শরিকদের মধ্যে আইনসম্মতভাবে ভাগ বা বণ্টন করা হয়নি। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এসব অবিভক্ত সম্পত্তি বিক্রি বা দান করার আগে অবশ্যই সব শরিককে একত্রে বসে রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে আপস বণ্টননামা দলিল সম্পন্ন করতে হবে। এটি একদিকে যেমন স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিরোধের পথ বন্ধ করবে।’


সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান খান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সংশোধিত উত্তরাধিকার আইনটি অত্যন্ত সময়োপযোগী। এতে বণ্টননামা দলিল বাধ্যতামূলক ও মৌখিক বণ্টন বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া সিএস, এসএ, আরএস, বিএস, বিআরএস ও সিটি সার্ভেসহ অন্যান্য এনালগ রেকর্ডে বহু ভুল দেখা গেলে বা নামের বানান, অংশের ঘর, দাগ নম্বর ও জমির পরিমাণে ত্রুটি থাকলে তা সরাসরি সহকারী কমিশনার ভূমির (এসএলআর) কাছে আবেদন করে সংশোধন করতে পারবে। করতে হবে না দেওয়ানি মামলা। সমাধানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না বছরের পর বছর।’


অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘জমি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে চলা পারিবারিক বিরোধ ও মামলাজট কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে সংশোধিত এই আইন। এখন থেকে দলিলের মাধ্যমে বণ্টন হলে কার কতটুকু অংশ আছে তা আইনিভাবে স্পষ্ট হবে এবং ভবিষ্যতে জাল দলিল বা প্রতারণার সুযোগ থাকবে না। তবে যারা এখনো আপস বণ্টননামা দলিল না করে সম্পত্তি ভোগ করছেন তাদের দ্রুত আইনগত প্রক্রিয়ায় আসতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের জটিলতায় পড়লে দীর্ঘ আইনি জটিলতা ছাড়া রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে না।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ