Views Bangladesh Logo

বামপন্থিদের বিভাজন: আদর্শের সংঘাত ও নেতৃত্বের লোভ, না ক্ষমতার বাস্তবতা?

Habib Imon

হাবীব ইমন

কিছুদিন আগের কথা- বামপন্থিরা জাতীয় সম্পদ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দাবিতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ করে ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণ’-এর ব্যানারে। কর্মসূচির মূল স্লোগান ছিল- ‘মা মাটি মোহনা, বিদেশিদের দেব না’। অতীতেও বামপন্থিরা জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এসব আলোচনা করতে বিশদ লেখা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এককভাবে আওয়ামী লীগের হাতে ছিল- এ কথা অনেকবার বলা হয়েছে। এটিকে আপনি চাইলে ‘আওয়ামী বয়ান’ বলতে পারেন; কিন্তু এটা ইতিহাসের একমাত্র সত্য নয়। প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছিল মূলত আওয়ামী লীগের নেতাদের দিয়ে, তবে সেই সরকারের পাশাপাশি ছিল একটি উপদেষ্টা কমিটিও, যার প্রধান ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আরও ছিলেন কমরেড মণি সিংহ, মোজাফফর আহমেদ এবং কংগ্রেস নেতা মনোরঞ্জন ধর। একমাত্র মনোরঞ্জন ধর বাদে বাকি সবাই ছিলেন বামপন্থি। এ থেকেই স্পষ্ট হয়- বামপন্থিদের অবস্থানকে অবহেলা করা ইতিহাসের প্রতি অবিচার।

এই মহান মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানুষ নানা ভূমিকা পালন করেছেন। বামপন্থিদের কথা যেমন উল্লেখ করা দরকার, তেমনি মনে রাখা দরকার কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনী কিংবা ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগপন্থি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের কথা। এই বাহিনীগুলোর কার্যক্রম প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বিশেষত মুজিব বাহিনী- ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত- তাদের যুদ্ধের শেষ দিকে বামপন্থি ঘাঁটিগুলোর ওপর আঘাত হানার উদ্দেশ্যে মাঠে নামানো হয়। যদিও তারা সে কাজে তেমন সফল হয়নি। বরং যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর সংঘর্ষ চলেছে বহুদিন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও লেখা হয়নি। সময় যত গড়ায়, উপাত্ত সংগ্রহ ততই কঠিন হয়ে পড়ে। এইটুকু বলেই উপসংহার টানা যায়- এটি ছিল মূলত জনগণের যুদ্ধ। বামপন্থিদের অংশগ্রহণ ছিল গৌরবজনক, যদিও সামগ্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল আওয়ামী লীগের হাতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে থাকলেও তার স্পিরিট গোটা জাতিকে প্রেরণা জুগিয়েছিল, একথাও অস্বীকার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধকে একরৈখিকভাবে দেখা যাবে না- তার বৈচিত্র্যময় দিকগুলো অনুধাবন করলেই ইতিহাসকে সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব। এবং সেখানেই প্রশ্ন আসে- আজকের বামপন্থিদের নিয়ে আর ব্যঙ্গ করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, তারা নিজেরাই নিজেদের এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে সাধারণ মানুষ হতাশ হয়ে বলে- ‘এই লোকগুলো নিজেদেরই এক রাখতে পারে না, দেশ চালাবে কী করে?’

বাংলাদেশে বামপন্থি রাজনীতির বাস্তবতা যেন এক বেদনাদায়ক পরিহাস। সমাজতন্ত্র, শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি, বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা- এই আদর্শিক মূলমন্ত্রকে ধারণ করেও আজ বামপন্থিরা অগণন মত-পথে বিভক্ত। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বামপন্থার প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও দল ও ছাত্রসংগঠনগুলোর বিভ্রান্তিকর বহুত্বের কারণে তাদের কাছে এগুলো পরিচিত নাম নয়, বরং জটিল এক গিঁট। প্রশ্ন উঠবেই- যখন মূল আদর্শ একই, তখন এত শাখাপ্রশাখা কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হয় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দিকে। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে নিকিতা খ্রুশ্চেভের ‘ডি-স্তালিনাইজেশন’ বক্তব্যের পর বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভক্তির সূচনা ঘটে। চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আদর্শিক ও কৌশলগত দ্বন্দ্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে। ষাটের দশকের শুরুতে এর ফলস্বরূপ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিও ভাগ হয়ে পড়ে- একদিকে মস্কোপন্থি, অন্যদিকে বেইজিংপন্থি।

বাংলাদেশও এই বিভাজনের ধারাবাহিকতা থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে দেশের কমিউনিস্ট দলগুলো সোভিয়েত ও চীনা ঘরানায় বিভক্ত হয়। কেউ জোর দেয় পার্লামেন্টারিজমে, কেউ বিপ্লবী সংগ্রামে; কেউ বিশ্বাস করে সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরে পরিবর্তনে, কেউ চায় রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে নতুন সমাজ গড়তে। বাংলাদেশের অন্যতম পুরোনো ও পরীক্ষিত দুটি সংগঠন- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাসদের ভাঙন আবার সামনে এনেছে বামপন্থি রাজনীতির সেই দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি- বিভাজন। নব্বই দশকে সিপিবি একবার বিভাজনের মধ্যে পড়েছিল। তারা তখন কিছুটা ঐক্য ফিরিয়ে এনেছিল, সংগঠনের ভিত্তিকে মজবুত করেছিল; কিন্তু এবারও নতুন করে প্রশ্ন উঠছে- এই ভাঙন কি আদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে? নাকি নেতৃত্বের প্রতি লুকানো আকাঙ্ক্ষা? না কি আর্থ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আত্মসমর্পণের ফল?

বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে ষাটের দশকে আধুনিক সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে যে সংকট তৈরি হয়, বাংলাদেশও তার ছায়া এড়াতে পারেনি। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভাঙনের প্রকৃত সূত্রপাত আদর্শিক মতবিরোধের চেয়ে বরং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব থেকেই। সিপিবি তার দীর্ঘ যাত্রাপথে ভুল করেনি, তা নয়। অনেক অনেক বড় ভুল করেছে; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, পার্টির নীতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে অসত্য প্রচারণা ও ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টারও করা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে মনে করা হয়, পার্টির নেতৃত্বের মধ্যে এসব বিষয়ে উদ্যোগের অভাব ছিল। এদিকটা পার্টি নেতৃত্ব অবহেলা করেছে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মূলত সেই ঐতিহাসিক ধারার উত্তরসূরি, যার জন্ম পাকিস্তান আমলে এবং যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, কৃষক-শ্রমিকের অধিকার আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম- এসব ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক উত্তরণের সময় থেকে শুরু হয় নতুন এক চ্যালেঞ্জ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, বিশ্বায়নের আগ্রাসন এবং পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যিক পুনরুত্থান- এই প্রেক্ষাপটে বাম রাজনীতি বিশ্বের অনেক জায়গার মতো বাংলাদেশেও সংকুচিত হতে থাকে।

বাসদের সাম্প্রতিক ভাঙন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়- বরং বহুদিন ধরে জমে ওঠা চাপের একটি প্রাকৃতিক বিস্ফোরণ। নেতৃত্ব নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ ছিল বহুদিনের। সাংগঠনিক কেন্দ্রায়ন, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, প্রান্তিক কর্মীদের মত উপেক্ষা, এবং একই মুখ বারবার সামনে থাকার কারণে এক ধরনের চাপ ও আক্রোশ জন্ম নিয়েছে। ১৯৮০ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কিছু নেতা জাসদ ভেঙে বাসদ গঠন করেন। তখন থেকেই বাসদের আহ্বায়ক ছিলেন খালেকুজ্জামান। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মাহবুব), বাসদ (মার্কসবাদী) আর কিছু দল হয়েছে। অন্যদিকে জাসদও আজ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত; কিন্তু প্রশ্ন হলো, শুধু নেতৃত্বের প্রশ্নেই কি জাসদ-বাসদ ভেঙে গেল?

নিরপেক্ষভাবে দেখলে এখানে অর্থনৈতিক বাস্তবতাও ভূমিকা রেখেছে। বাম সংগঠনগুলো আজ চরম আর্থিক সংকটে। একসময় যেসব শ্রমিক ফান্ড বা এনজিও ছিল অর্থের উৎস, সেগুলো সংকুচিত বা ব্যক্তিনির্ভর হয়ে গেছে। বাসদের একটি অংশ সংগঠনের আর্থিক ও সাংগঠনিক স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল; কিন্তু পুরোনো নেতৃত্ব হয়ত এটিকে ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে দেখেছে। ফলে ভাঙন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া, আদর্শিক স্তরেও একটি বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বাসদের একটি বড় অংশ মনে করে- আধুনিক পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে রূপ পাল্টেছে, তাতে কেবল আগের মার্কসবাদী ভাষা ও কৌশল যথেষ্ট নয়। চাই নতুন ব্যাখ্যা, নতুন ভাষা, নতুন জোট এবং কিছু কৌশলগত স্থিতিস্থাপকতা। আদর্শের মৌলিক জায়গা থেকে সরে আরো মতাদর্শ প্রতিস্থাপনও এর জন্য দায়ী। ফলে সংগঠনের একাংশ একে সরাসরি ‘আদর্শচ্যুতি’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে সংঘাত তৈরি হয়েছে- তীব্র, অবিশ্বাসভিত্তিক, এবং বিভাজনমুখী।

আজকের বাংলাদেশে বাম রাজনীতির বিভাজনকে বুঝতে শুধু মতাদর্শের ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। অনেক সময় ‘আদর্শ’ নামেই চলে নেতৃত্ব রক্ষার লড়াই। কেউ নেতৃত্বে থাকলে ভাবেন- তিনি ছাড়া সংগঠন চলবে না। আর নতুন কেউ উঠে আসলে বলেন- নতুন পথ, নতুন নেতৃত্ব দরকার। যখন এই মতভেদ গণতান্ত্রিকভাবে সমাধান হয় না, তখনই জন্ম নেয় নতুন দল। স্লোগান এক, পতাকা এক- কেবল মুখ বদলায়। বাসদ কিংবা সিপিবি- উভয়ের ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা দৃশ্যমান। বিদ্রোহীরা বলেন ‘আমরা গণতন্ত্র চাই।’ নেতৃত্বধারীরা বলেন ‘ওরা আদর্শচ্যুত।’ এর বাইরেও চলে প্রচারণা: ‘ওরা বিলোপবাদী।’ এসব করে যেটা হয়েছে, তা হলো পার্টিকে ক্ষয়িষ্ণু করে তোলা হচ্ছে। এই পাল্টাপাল্টি বিবৃতি, অভিযোগ, সংবাদপত্র বা চায়ের দোকানের গল্পে বামপন্থিদের প্রতি মানুষের আস্থা ভেঙে পড়ে। সাধারণ মানুষ আর বুঝতেই পারে না- কে ঠিক? কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা জনসম্মুখে মুখ লুকিয়ে রাখে।

জাতীয় নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, বামপন্থিরা ততই পেছাচ্ছেন। কেউ চায় একক প্রার্থী দিতে, কেউ চায় ছোট জোটে থেকে আলোচনায় থাকতে। অথচ এই মুহূর্তে জনতার সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা একটি বিশ্বাসযোগ্য বাম বিকল্প। কিন্তু যখন রাজনৈতিক শক্তি নিজের ভেতরে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে, তখন তারা বাস্তব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রণকৌশল সাজাতে পারে না। না তারা শক্তভাবে রাজপথে নামতে পারে, না ভোটের মাঠে দাঁড়ানোর জনভিত্তি গড়তে পারে। বরং বিভাজনের কারণে তারা নিজেরাই নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলে। অনেকে বলেন- বামপন্থিরা আদর্শচ্যুত। আসলে তা নয়। এখনো বহু বিপ্লবী, নৈতিকতায় স্বচ্ছ ও জনগণের প্রতি নিবেদিত কর্মী-নেতা বেঁচে আছেন; কিন্তু সমস্যা হলো- এই আদর্শিক শক্তিগুলোর মধ্যে নেই পারস্পরিক শ্রদ্ধা, নেই নেতৃত্বের সংস্কৃতি। সবাই নিজেকে শীর্ষে দেখতে চায়। কেউ কারও নেতৃত্ব মানতে রাজি নয়। ফলে জনগণের কাছে বামপন্থিদের কথায় আগুন থাকে না, গলায় থাকে না বিশ্বাস, স্লোগানে থাকে না ভরসা।

বাংলাদেশের বাম রাজনীতি এখন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। হয় তারা নিজেদের শুদ্ধ করবে, নেতৃত্বের অহং ত্যাগ করবে, সংগঠনকে তৃণমূলে গড়ে তুলবে এবং নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্বে নিয়ে আসবে- নয়তো সময় তাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেবে। যদি সত্যিই সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইচ্ছা থাকে, তবে এখনই নিজেদের বিভাজন থামানোর সময়। জনতা আর বিভক্ত কণ্ঠ শুনতে চায় না- তারা চায় একতা, স্পষ্টতা ও পরিপক্ব নেতৃত্ব। নেতৃত্বের কাছে প্রশ্ন রাখা জরুরি- আপনাদের বিভাজনের কারণে কর্মীরা বিব্রত হয় কেন? এই প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে আপনাদের লজ্জা নয়, বরং গৌরব হয়- এটাই দুঃখজনক।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিভিন্ন সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বাম রাজনীতির সামনে একটি সুনির্ধারিত লক্ষ্য নির্ধারণের সুযোগ এনে দিয়েছে; কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সে সুযোগ বিসর্জন দিয়েছে তারা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার যে প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছিল, আজ তারা নিজেরাই শোষণের পথকে প্রশস্ত করেছে। ঐক্যের নাম ধরে যারা বিভক্তি ঘটিয়েছে, সুবিধাবাদী মহল তারাই সবচেয়ে বেশি ফায়দা লুটেছে। এদেশে বাম ঐক্যের প্রতিটি চেষ্টা ব্যক্তিপূজা, ষড়যন্ত্রবাদ ও হঠকারিতার কাছে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু ঐক্যের একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি রয়েছে- অনৈক্যের কারণ ও মূল সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা, বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ করা, এবং আত্মজিজ্ঞাসা, সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মাধ্যমে তার সমাধান খোঁজা। কিন্তু সেটা কি হচ্ছে? বরং দেখা যাচ্ছে- কিছু বাম নেতারা নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করছেন বুর্জোয়া রাজনৈতিক শক্তির ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে। এটা বাম রাজনীতির চূড়ান্ত বিপরীতমুখিতা।

বিভাজনের মূল কারণগুলো নিচের মতো করে শনাক্ত করা যায়:
১. আদর্শগত পার্থক্য: কেউ মাওবাদী, কেউ লেনিনপন্থি, কেউ গ্রামশিয়ান ঘরানায় বিশ্বাসী। সশস্ত্র বিপ্লব, নির্বাচন, পার্লামেন্ট ইত্যাদি বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র ভিন্নতা রয়েছে।
২. কৌশলগত মতানৈক্য: কোন পথে বিপ্লব সম্ভব? গণআন্দোলন না সশস্ত্র সংগ্রাম? নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না? এমন প্রশ্নে দলগুলোর ভেতর বিরোধ রয়ে গেছে।
৩. নেতৃত্বকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব: অনেক ক্ষেত্রেই আদর্শ নয়, বিভাজনের মূলত চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে নেতৃত্বের লড়াই ও সংগঠন রক্ষা নয়, বরং 'নেতৃত্ব রক্ষা'র প্রতিযোগিতা।
৪. বাস্তবতাবোধ ও তাত্ত্বিক চর্বিতচর্বণ: সাধারণ মানুষের বাস্তব সংকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক বাম দল। ফলে জনগণের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে বাম রাজনীতি অনেকটা ‘ক্লাবপলিটিক্সে’ রূপ নিয়েছে।

এই বিভাজনের সবচেয়ে বড় পরিণতি হলো- বামপন্থিরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কার্যত প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন। জাতীয় নির্বাচনে বাম জোট বা দলগুলোর অবস্থান প্রায় নেই বললেই চলে। সংসদে কোনো বাম প্রতিনিধি নেই। জাতীয় রাজনীতিতে বাম মতাদর্শের প্রতিধ্বনি কমে এসেছে। শ্রমিক আন্দোলনে প্রভাব সীমিত, কৃষক আন্দোলনেও ধারাবাহিকতা নেই। বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যেও ঐক্য নেই। অথচ দেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী ক্রমেই রাজনৈতিক বিকল্প খুঁজছে। কিন্তু তারা পাচ্ছে না স্পষ্ট ভাষা, ভবিষ্যতের রূপরেখা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা। সামনে কী আছে?

প্রশ্ন উঠেছে- এই বিভাজনের অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে কি এখনো ঐক্যের সম্ভাবনা আছে?
উত্তর- হ্যাঁ, যদি চারটি কাজ করা যায়:
১. একটি স্পষ্ট, যুগোপযোগী, বাস্তবমুখী রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ
২. পুরোনো আদর্শিক মতভেদ সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের রূপরেখা তৈরি
৩. তরুণ প্রজন্মের ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি ও চাহিদা অনুধাবন করে নতুন রাজনৈতিক সংযোগ গড়ে তোলা
৪. সংগঠনের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, নেতৃত্বে ধারাবাহিকতা তৈরি
বার।

নাজিম হিকমত লিখেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ তাহলে একুশ শতাব্দীতে নিশ্চয়ই তার আয়ু আরও কম। বামপন্থিদের অনেক বর্ষীয়ান নেতা আজ প্রয়াত। নেতৃত্ব প্রায় শূন্য। প্রশ্ন হলো- কে হবেন বাম রাজনীতির নতুন নেতৃত্ব? তরুণ নেতৃত্ব বিকাশে কোনো প্রচেষ্টা দলের মধ্যে নেই। তবে ক্ষুদ্র পরিসরে কর্মী গড়ে তোলার একটা প্রয়াস দেখা যায়।
বাম নেতারা বলেন- ‘বৃত্ত বাড়াও’- অর্থাৎ পার্টির বাইরের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্রী মানুষদের নিয়ে বৃহৎ মঞ্চ তৈরি করো। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই মঞ্চ গড়তে কি তারা প্রস্তুত? নেতৃত্বের অহংকার কি তারা ছাড়তে পারবেন?

১৮৪৬ সালে মার্কস এবং এঙ্গেলস মিলে “The German Ideology” নামে একটা বইয়ে লিখেছেন, একটা সমাজে মানুষ যেভাবে সক্রিয় থাকে তার আলোকে, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিমূর্ত মানুষ হিসাবে মানুষকে বুঝলে তার কোন প্র্যাকটিক্যাল আউটকাম থাকবে না। অন্যদিকে, বাম মতাদর্শ না থাকলে একটি দেশের জন্য তা অকল্যাণকর- এই কথাটি বহু আগেই বলেছিলেন মওলানা ভাসানী। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন রাজপথের লড়াইয়ে। আর আজকের বামপন্থিরা সংসদীয় কাঠামোর মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছেন- সিস্টেমকে আঘাত করার ইচ্ছাও নেই, ক্ষমতাও নেই। সময় যেন প্রতিদিন বাম রাজনীতিকে আরও নিঃস্ব করে ফেলছে। সব রকম সীমাবদ্ধতা, মতপার্থক্য এবং সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠে সব বামদলকে ঐক্যবদ্ধ করার চিন্তা বহু দিনের।

সামনে কী করণীয়? এখনো সময় আছে। সময়ের দাবি হলো-
• মৌলিক আদর্শে ঐক্য গড়া,
• নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন,
• নতুন বাম রাজনীতির ভাষা গড়ে তোলা,
• অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এক ছাতার নিচে শক্তি সংহত করা।

ভোটের রাজনীতিতে সাফল্য আসুক বা না আসুক, যদি বামপন্থিরা শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব সংগ্রামের পাশে থাকতে পারেন, তবেই তারা সমাজ বদলের বাস্তব শক্তিতে রূপ নিতে পারবেন। বৃহত্তর ঐক্য গড়ে আমরা যদি এই প্রবণতাকে রুখতে না পারি তবে নয়া নয়া ফ্যাসিবাদ আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে। তার আন্দাজ তো পাওয়া যাচ্ছ। এই বিষয়ে আমাদের সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিকে এর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে চালাতে হবে মতাদর্শগত সংগ্রাম। কিন্তু সিপিবি'র স্বাধীন শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গেই বামপন্থিদের শক্তিশালী করতে হবে। সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ এখন দেশের নানা প্রান্তে জনভিত্তি পেয়েছে। এর বিরুদ্ধে মতাদর্শগত এবং রাস্তার লড়াই লড়তে গেলে বামপন্থিদের শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন।

মানব সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, প্রত্যেক যুগে নতুন নতুন ধরনের সংকট, বৈষম্য হাজির হয়। নতুন প্রজন্মের উন্নত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃৎকৌশল আবিষ্কার করে সেই সঙ্কটের মোকাবিলা করে উত্তরণ ঘটানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন হয় পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ, শতাব্দী সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, উন্নততর দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং তার প্রয়োগ। প্রথমত, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হিসাবে আমাদের পাথেয় উন্নততর মতাদর্শ। তাতে নিজেদের আরও শানিত করতে হবে। মতাদর্শের চর্চাই শেষ কথা নয়, শ্রেণি আন্দোলন-সংগ্রাম, সংগঠনের মধ্য দিয়ে সেই মতাদর্শকে প্রয়োগ করতে হয়। তা থেকে লব্ধ শিক্ষাকে আয়ত্ত করে, মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের সংগঠনকে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলা, পরিচালনার জন্য আরও যত্নশীল, পারদর্শী হয়ে উঠতে হবে। সংগঠন গড়ে তোলা এবং পরিচালনায় আরও নিষ্ঠা, সততা ও ত্যাগের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নীতিনিষ্ঠভাবে সাংগঠনিক কায়দা কানুন প্রয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশের এই মাটি শক্ত মাটি। শত শহীদের রক্তে-আত্মত্যাগে উর্বর প্রতিরোধের মাটি। আমরা হেরেছি ঠিকই। কিন্তু হারিয়ে যায়নি। আমরা নিশ্চিত, ঘুরে দাঁড়াবে এই দেশ। ঘুরে দাঁড়াবেই। পরাজয় মানে শেষ কথা নয়। সংগ্রামে পিছিয়ে পড়া মাত্র। প্রতিটি পরাজয়ই আসলে শ্রমিকশ্রেণি, মেহনতি মানুষের জন্য ভবিষ্যতের সংগ্রামকে শক্তিশালী করার একটা শিক্ষা। পশ্চিম এশিয়ার শহীদ মার্কসবাদী চিন্তক মাহদি আমেল যেমন বলেছেন, You are not defeated, As long as you are resisting! তুমি ততক্ষণ পরাজিত নও, যতক্ষণ তুমি প্রতিরোধে! Resurrection is now our Keyword! বাংলার পুনর্জাগরণের জন্য প্রয়োজন বামপন্থার পুনরুত্থান! বামপন্থার পুনরুত্থানেই নিহিত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ! আর সেকারণে সিপিবি’র ঐক্যবদ্ধ পুনরুত্থান অতীব জরুরি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ধারার বাইরে নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে বামপন্থিদের নেতৃত্বে প্রকৃত বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিই এখন সময়ের দাবি। দেশের রাজনীতির রুগ্ন হাল দূর করতে হলে এক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করতে পারাটি আজ খুবই জরুরি।

কিছু দিন ধরে আবারো বামপন্থিদের একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার উদ্যোগ চলছে। সিপিবি ও বাসদের কয়েক বছরের ঐক্য এখন বামমোর্চা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এই অগ্রগতি বাম শক্তির ঐক্যের বিষয়ে নতুন করে আশাবাদ সৃষ্টি করেছে। এই বাম ঐক্যের বাইরে আবার চলছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসা কয়েক নেতা ও তাদের দলের নির্বাচনমুখী জোট গঠনের টানাটানি। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ধারার বাইরে নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে বামপন্থিদের নেতৃত্বে প্রকৃত বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিই এখন সময়ের দাবি। দেশের রাজনীতির রুগ্ণ হাল দূর করতে হলে এক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করতে পারাটি আজ খুবই জরুরি। বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতির ইতিহাস গৌরবময়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা তা নয়। এই দ্বৈততার মধ্য থেকেই আমাদের ভবিষ্যতের পথ খুঁজতে হবে।

ইতিহাসে এমন বহু সময় এসেছে, যখন বামপন্থিরা একসঙ্গে দাঁড়িয়েছে- স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের সময়, বা শ্রমিকের মজুরি আন্দোলনে। আবারও তেমন সময় এসেছে। কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস অসম্পূর্ণ- এ কথা ঠিক; কিন্তু সেই ইতিহাসকে ভবিষ্যতের রূপান্তরের উপাদান করে তুলতে হলে, বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে ঐক্যের রাজনীতি গড়ে তুলতে হবে। সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন কেবল তত্ত্বে নয়, বাস্তব সংগ্রামে প্রাণ পায়। আর সেই সংগ্রাম সফল হতে পারে তখনই, যখন বিভাজনের রাজনীতিকে পরাজিত করে ঐক্যের ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক শক্তি নির্মাণ করা সম্ভব হয়। একুশ শতকের বাস্তবতায় বাংলাদেশে এক নতুন, যুগোপযোগী বাম ঐক্য- এটাই এখন সময়ের দাবি।

হাবীব ইমন: রাজনৈতিক বিশ্লেষক; প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ