এনইআইআর সিস্টেম
উদ্যোগটি ভাল, কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে
প্রথমেই বলব, উদ্যোগটি ভাল। দেশে এখন মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদিত হচ্ছে। অতএব সেই উৎপাদনকে উৎসাহিত করার জন্য কর ফাঁকি দিয়ে চোরাই পথে আসা হ্যান্ডসেটের বাজার বন্ধ করার উদ্যোগ প্রশংসার দৃষ্টিতেই দেখা উচিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বিটিআরসি কতবার এই উদ্যোগ নেবে, আর আমরা কতবার প্রশংসা করব এবং অতঃপর হতাশ হব?
২০১৬ সালে যখন বিশ্বখ্যাত গ্লোবাল ব্রান্ড স্যামসাং বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিল তখন থেকেই দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে চোরাই পথে আসা হ্যান্ডসেটের বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে লিখেছি। ২০১৮ সালে স্যামসাং এর কারখানা স্থাপন করা হল। একই সঙ্গে সিম্ফনি, ওয়ালটনের মত দেশীয় প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্থাপন করা কারখানায় পুরোদমে হ্যান্ডসেট উৎপাদন শুরু করল, তখন মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকেও স্থানীয় উৎপাদন এবং বিনিয়োগ ফেরত আসার সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি উঠল। সেই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েই ২০১৯ সালে বিটিআরসি প্রথমবারের মত এনইআইআর (ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার) সিস্টেম চালু করার সিদ্ধান্ত নিল।
প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা সেই এনইআইআর সার্ভারের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালুর ঘোষণা দেয়া হল ২০২১ সালের পহেলা জুলাই থেকে। সে সময়ে প্রথমে বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে বলা হল, যেসব হ্যান্ডসেট বর্তমানে নেটওয়ার্কে চালু আছে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সার্ভারে অ্যাকটিভ হবে, সেগুলো যেখান থেকে যেভাবেই কেনা হোক। পরে জানানো হল, দেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন কিংবা আমদানি উভয় ক্ষেত্রেই আগে থেকেই হ্যান্ডসেটের আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিফিকেশন) নম্বরগুলো বিটিআরসি’র কাছে জমা দিয়ে এনইআইর সার্ভারে তালিকাভুক্ত করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত কোন তারিখ থেকে কার্যকর হবে সেটাও জানিয়ে দেয়া হল। বিদেশ থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটি হ্যান্ডসেট আমদানি করা হবে এবং সেগুলো কিভাবে নিবন্ধন করা হবে তাও জানিয়ে দেয়া হল। একই সঙ্গে আরও জানানো হল, বিটিআরসি নির্ধারিত তারিখের পর থেকে এনইআইআর সার্ভারে পূর্ব থেকে নিবন্ধিত নয়, এমন হ্যান্ডসেট আর মোবাইল অপারেটরদের নেটওয়ার্কে সচল হবে না। নতুন হ্যান্ডসেট কেনার সময় হ্যান্ডসেটটির আইএমইআই নম্বর আগে থেকেই বিটিআরসি’র এনইআইআর সিস্টেমে তালিকাভুক্ত কিনা তা এসএমএস এর মাধ্যমে জানার জন্য একটি শর্টকোডও চালু হল।
খুবই প্রশংসনীয় এই উদ্যোগ তিন মাসের মধ্যেই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। দেখা গেল চোরাই পথে আসা হ্যান্ডসেট বেশ অবাধেই বিক্রি হচ্ছে এবং মোবাইল অপারেটরদের নেটওয়ার্কে এদের আইএমইআই নম্বর সক্রিয়ও হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, বহু ঢাকঢোল পেটানো এনইএআর সিস্টেমটি প্রকৃতপক্ষে তালিকাভুক্তির জন্য কার্যকর থাকলেও অ-তালিকাভুক্ত হ্যান্ডসেট নিয়ন্ত্রণে সক্ষম নয় কিংবা সক্ষমতা থাকলেও সেই ব্যবস্থাটুকু নিষ্ক্রিয় আছে। এরপর এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা উঠলে আবারও এনইআইআর সিস্টেম কার্যকর করার ঘোষণা আসে। এরপর আবার সব ব্যবস্থা শিথিল। সে সময়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রী সাংবাদিকদের জানালেন, এনইআইআর সিস্টেমের কারণে প্রবাসীরা দেশে এসে বিদেশে ব্যবহৃত হ্যান্ডসেটে দেশীয় সিমকার্ড ব্যবহার করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে কিংবা হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ কারণে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এনইআইআর সিস্টেম কিছু সময়ের জন্য শিথিল রাখা হচ্ছে। এরপর অবশ্য এনইআইআর সিস্টেম আর সক্রিয় হয়নি। ফলে দেশে চোরাই পথে আসা হ্যান্ডসেটের বাজার দ্রুত বিস্তৃত হতে শুরু করে। দেখা গেছে, অফিসিয়াল হ্যান্ডসেট বিক্রি করা স্মার্টফোনশপগুলো যখন ক্রেতাশূন্য তখন ‘আনঅফিসিয়াল’ হ্যান্ডসেট বিক্রির দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। কারণ একই মডেলের হ্যান্ডসেট, কিন্তু দাম অনেক কম।
বিটিআরসি গত ২৯ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে এনইআইআর সিস্টেম নতুন করে চালু করা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, বিদেশ থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে কিনে নিয়ে আসা কিংবা উপহারপ্রাপ্ত হ্যান্ডসেটগুলো বিশেষভাবে নিবন্ধন করার ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু একজন প্রবাসী কিংবা বিদেশী অন্য দেশে নিয়মিত ব্যবহার করা হ্যান্ডসেটটি নিয়ে বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের সিমকার্ড কিনলে সেটি তার সেই পূর্ব ব্যবহৃত হ্যান্ডসেটে কিভাবে ব্যবহার করবেন কিংবা সেক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি কী হবে, তা সংবাদ সম্মেলনে সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি। এটা সুস্পষ্ট না করলে পুরনো জটিলতা নতুন করে সামনে আসতে পারে। আমরা নিজেরাও যখন বিদেশ যাই, তখন সেদেশের এয়ারপোর্ট থেকে পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে সিমকার্ড কিনলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের ব্যবহৃত হ্যান্ডসেটেই সক্রিয় হয়। বাংলাদেশও কি ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে তাই হবে? সেক্ষেত্রে প্রবাসীদের সিমকার্ড কি তার ব্যবহৃত হ্যান্ডসেটে পাসপোর্ট না এনআইডি কোনটি দিয়ে সক্রিয় করবেন, নাকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরদের সিমকার্ড সচল হবে?
বিটিআরসি’র সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়েছে হ্যান্ডসেট হস্তান্তর করা হলে অর্থাৎ সিমকার্ড বদল করা হলে সেই ডিভাইসটি এনইআইআর সিস্টেম থেকে ডি-রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। বিদেশ গেলে আমাদের ব্যবহৃত হ্যান্ডসেটে সংশ্লিষ্ট দেশের সিমকার্ড সক্রিয় করা হয়। দেশে এলে আবার পূর্বে ব্যবহৃত দেশীয় অপারেটরের সিমকার্ড সক্রিয় করা হয়। এখন কি আমাদের প্রতিবার বিদেশ থেকে আসার পর এই ডি-রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় যেতে হবে? সে বিষয়টিও পরিষ্কার করা হয়নি। আমরা নিজেরা অনেক সময়ই নিজেদের ব্যবহৃত পুরনো হ্যান্ডসটটি নিকটস্থ কোন আত্মীয়-স্বজনকে ব্যবহারের জন্য দেই। এক্ষেত্রে ডি-রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া জটিলতা এবং বিরক্তি দু’টোরই সৃষ্টি করবে।
প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে এই ডি-রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া হ্যান্ডসেট চুরি এবং ছিনতাইরোধে সহায়ক হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আরও আগেই দেশে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাছে আইএমইআই নম্বর ট্র্যাক করার যথেষ্ট উন্নত ব্যবস্থা আছে। এটা চোর ও ছিনতাইকারীরাও জানে। একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং হ্যান্ডসেটগুলোর অপারেটিং সিস্টেমের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথাও চোর ও ছিনতাইকারীরা জানে। এ কারণে চুরি হওয়া কিংবা ছিনতাই হওয়া হ্যান্ডসেট সাধারণত দেশের নেটওয়ার্কে সচল করা হয় না। এ সংক্রান্ত একাধিক রিপোর্ট করতে গিয়ে পুলিশের তদন্ত কর্তকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা যায়, এখন চুরি কিংবা ছিনতাই হওয়া হ্যান্ডসেট সাধারণত দেশের নেটওয়ার্কে সচল হতে দেখা যায় না। এগুলো অন্য কোন দেশে চলে যায় কিংবা যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করা হয়। এমনও কথা শোনা যায়, চুরি হওয়া হ্যান্ডসেট কোন কোন কারখানায় চলে যায়। সেখানে উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহার করে আইএমইআই নম্বর বদলে নতুন করে বাজারে আসে। আর যে অপরাধীরা বার বার ডিভাইস কিংবা সিমকার্ড বদল করে অপরাধ করে, তারা প্রযুক্তিগতভাবে আরও একধাপ উপরে।
একজন তদন্ত কর্মকর্তা আরও প্রায় চার বছর আগে একটি রিপোর্টের প্রয়োজনে কথা বলার সময় জানিয়েছিলেন, এখনকার অপরাধীরা বেশ স্মার্ট। সিমকার্ডের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের পর থেকে অপরাধীরা দেশের নেটওয়ার্কের সিমকার্ড আর বার বার বদল করে না, কারণ সেক্ষেত্রে ধরা পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ কারণে তারা অন্য কোন দেশের সিমকার্ড রোমিং করে দেশে এসে ব্যবহার করে। আবার বিদেশের মোবাইল অপারেটরদের নম্বর দিয়ে অ্যাকটিভ করা হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম কিংবা এ ধরনের ওটিটি অ্যাপ ব্যবহার করেও সহজেই কথা বলতে পারে। আর ভিপিএন প্রযুক্তির ব্যবহার তো আছেই। ফলে এদের ট্র্যাক করতেও অনেক ক্ষেত্রেই বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। ফলে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে এই ডি-রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চোর ও ছিনতাইকারী কিংবা স্মার্ট অপরাধী ধরতে আদৌ কার্যকর না হলেও সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য নতুন ভোগান্তির কারণ হওয়ার আশংকা খুবই বেশি।
আরও একটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ১৬ ডিসেম্বর থেকে বিটিআরসি একই সঙ্গে ডিভাইস ও সিমকার্ড ট্র্যাকিং করতে পারবে। সেটা কি লোকেশন ট্র্যাকিংসহ? তাহলে কি এখন থেকে বিটিআরসিও প্রতিটি নাগরিকের গতিবিধি নজর রাখবে? যদিও তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই যুগে লোকেশন ট্র্যাকিং এখন ডাল-ভাত। ফেসবুক, গুগল, উবার কিংবা এ ধরনের অসংখ্য অ্যাপ আপনার শুধু লোকেশন ট্র্যাকিং নয়, আপনি প্রতি মুহূর্তে কোন শব্দ উচ্চারণ করছেন এমনকি মনে মনে কি ভাবেছেন সেটাও তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিনিয়তই পড়ে ফেলছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোন সংস্থার ক্ষেত্রে নাগরিকদের গতিবিধির উপর নজর রাখার ক্ষেত্রে কিছু আইনগত ভিত্তি আছে। বিটিআরসি যদি ট্র্যাকিং ক্ষমতা নেয় কিংবা যে কোন সময় যে কোন ডিভাইস কিংবা সিমকার্ড বন্ধ করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে তাহলে সেটার আইনগত ভিত্তি এবং সীমারেখাও নাগরিকদের কাছে পরিষ্কার করা উচিত।
একটা কথা মনে রাখতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র বার বার সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই দেশে চোরাই পথে আসা ‘আনঅফিসিয়াল’ হ্যান্ডসেটের বাজার বিস্তৃত হয়েছে। যারা ‘আনঅফিসিয়াল’ হ্যান্ডসেট বাজারে এনেছে তারা বৈধ ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে বড় শপিং মলসহ বিভিন্ন স্থানে আউটলেট খুলে বিক্রি করেছে। ফলে নাগরিকরা যখন এসব বৈধ আউটলেট থেকে বিক্রয় রশিদসহ কোন পণ্য কিনেছে, তখন সেটা অবশ্যই বৈধ। এগুলোকে এক ঘোষণায় অবৈধ বলার সুযোগ নেই। আবার যারা সরকারের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে এই বাজারে হ্যান্ডসেট নিয়মিতভাবে নিয়ে আসছে তাদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টিও সরকার কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থার উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কারণ তাদের ব্যবসার বিস্তৃত হওয়ার দায়ও সরকারের। সেটা আজকের অন্তর্বর্তী সরকারই হোক কিংবা বিগত বা পতিত সরকারই হোক। ফলে ১৬ ডিসেম্বর থেকে এনইআইআর সিস্টেম কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যে সব হ্যান্ডসেট ব্যবহৃত হয়ে আসছে সেগুলোকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিস্টেমে তালিকাভুক্ত করাটাই হবে নাগরিকদের প্রতি সুবিচার। আর এখনে থেকেই চোরাই পথে আসা হ্যান্ডসেট বাজারজাত করার সুযোগ বন্ধ করে এরই মধ্যে যেসব ‘আনঅফিসিয়াল’ হ্যান্ডসেট বাজারে এসেছে সেগুলোকে আগামী ১৬ ডিসেম্বরের আগেই কিভাবে বৈধ করা যায়, সেটাও এখনও বিবেচনা করাটাই সহজতর সমাধানের পথ হতে পারে।
রাশেদ মেহেদী, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিশ্লেষক, সম্পাদক, ভিউজ বাংলাদেশ
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে