Views Bangladesh Logo

৮ ডিসেম্বর: বিজয়ের অপেক্ষায় এক ঐতিহাসিক দিন

Shimul  Zabaly

শিমুল জাবালি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ডিসেম্বর মাস যেমন গৌরবের, তেমনি বেদনাহত স্মৃতিতে ভরা। বিজয়ের মুহূর্ত যত ঘনিয়ে এসেছে, ততই দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী দুর্বল হতে শুরু করেছে, আর মুক্তিযোদ্ধারা নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত হয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় ৮ ডিসেম্বর ছিল এমন এক ঐতিহাসিক দিন—যেদিন দেশের নানা প্রান্তে শত্রুর পতন দ্রুততর হয়েছে, বিজয়ের চিত্র আরও পরিষ্কার হয়েছে এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন স্পর্শের মতো কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।

তাজউদ্দীন আহমদের ঐতিহাসিক ভাষণ
৮ ডিসেম্বর ছিল শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের নয়, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মঞ্চেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিন মুজিবনগর থেকে দেওয়া এক বেতার ভাষণে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন— ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। পাকিস্তানি হানাদাররা প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে; তাদের পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষা।’

তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুর ওপর শেষ আঘাত হানার আহ্বান জানান এবং বলেন, ‘আগামীকাল যেন কেউ অপবাদ দিতে না পারে যে আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করিনি।’

একই ভাষণে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান, এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। তার বক্তব্যে স্পষ্ট ছিল—বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও তখন বড় ভূমিকা রাখছে।

ভারতের সেনাপ্রধান মানেকশ’র আত্মসমর্পণের আহ্বান
এই একই দিনে ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস.এইচ.এফ.জে. মানেকশ পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে আকাশবাণী রেডিও থেকে হিন্দি, উর্দু ও পশতুতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন— ‘তোমাদের চারদিক ঘিরে ফেলা হয়েছে। বিমানবাহিনী অকেজো, সাহায্যের কোনো পথ খোলা নেই। তোমাদের বাঁচার একটাই উপায়—আত্মসমর্পণ।’

এই ঘোষণার পর পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল আরও ভেঙে পড়ে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান দ্রুতগতিতে এগোতে শুরু করে।

কলকাতায় প্রবাসী সরকারের ঘোষণা
৮ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র জানান— বাংলাদেশের সব পাটকল, চা-বাগান, ব্যাংক, বীমা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান সরকারি করা হবে এবং খুব দ্রুত সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হবে। জেলা প্রশাসক নিয়োগ, মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণসহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রূপরেখা তখন স্পষ্ট হতে শুরু করে। জাতীয় পতাকা ও রাষ্ট্রগঠনের প্রস্তুতি—সবকিছুই যেন বিজয়ের আগমনী বার্তা দিচ্ছিল।

পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হতাশা
৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন ও পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হন। ইয়াহিয়া খান দেশবাসীর কাছে যুদ্ধ তহবিলে অর্থ চেয়ে বিবৃতি দেন—যা প্রমাণ করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তখন ভীষণ চাপের মুখে। সারা দেশে তারা ‘যুদ্ধ তহবিল’ গঠনের আহ্বান জানাতে বাধ্য হয়।

আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
এদিন জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন— ‘বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য। পাকিস্তানের উচিত এ সত্য মেনে নেওয়া।’

এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট ঢাকায় অবস্থানরত কর্মকর্তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ভারত–পাকিস্তানের কাছে একটি নিরপেক্ষ নিরাপদ এলাকা চেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিসরেও তখন যুদ্ধের চিত্র স্পষ্ট—বাংলাদেশের জন্ম আর আটকে রাখা যাবে না।

জাতিসংঘে ভোটাভুটি নিয়ে দুটি বার্তা সংস্থার বরাত দিয়ে ইত্তেফাক লিখে, প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ১০৪টি। আর বিপক্ষে ভোট দেয় ১১ সদস্য রাষ্ট্র। প্রস্তাবটির একটি শর্তে বলা হয়, বাঙালি শরণার্থীরা যাতে স্বেচ্ছায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারে, পাকিস্তানকে সে রকম অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তবে এই অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা নিয়ে আপত্তি ছিল পাকিস্তানের।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অধিবেশনে দেওয়া ভাষণেই ইসলামাবাদের প্রতিনিধি আগা শাহি জানান, তার সরকার ‘বাংলার বিদ্রোহীদের’ সঙ্গে আলোচনায় রাজি নয়।

টর্চলাইট কেনার হিড়িক
জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ে লিখেছেন, ৮ ডিসেম্বর বুধবার রেডিওতে আবার ঘোষণা দেওয়া হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ ও ব্ল্যাকআউট (সন্ধ্যা থেকে ভোর ৫টা) বলবৎ থাকবে।

ডিসেম্বরের শুরুর দিক থেকেই ঢাকায় কারফিউ ও ব্ল্যাকআউট জারি হয়। ৮ ডিসেম্বর নতুন করে ঘোষণা দেওয়ার পর এর প্রভাব পড়ে টর্চলাইটের বাজারে। এ নিয়ে পরদিন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় লেখা হয়, ঢাকাসহ আশপাশে নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর জনসাধারণের মধ্যে টর্চলাইট ও টর্চের ব্যাটারি কেনার হিড়িক পড়েছে। শহরের বিভিন্ন মণিহারি দোকানে টর্চের যে মজুত ছিল, তা শেষের দিকে। পেনসিল ব্যাটারির যে টর্চ কিছুদিন আগে ছয় টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেগুলো পৌনে আট থেকে সাড়ে আট টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ ও শত্রুমুক্তি
৮ ডিসেম্বর ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সর্বাধিক ঘটনাবহুল দিন। দেশের বহু জেলা এদিন শত্রুমুক্ত হয়।

কুমিল্লা হানাদারমুক্ত
ভারতীয় মিত্রবাহিনীর শিখ জাট ব্যাটালিয়ন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত অভিযানে দুপুরের দিকে কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করা হয়। এতে হানাদাররা পালাতে বাধ্য হয়। পরে টাউন হলে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিনের শেষে জেনারেল অরোরা কুমিল্লা বিমানবন্দরে অবতরণ করলে শহরবাসী করতালিতে তাকে স্বাগত জানায়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত
ভারতীয় সেনারা উজানিসার ও রেললাইন দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়ে বিনা বাধায় শহরটি মুক্ত করে। একইদিন মুক্তিযোদ্ধারা আশুগঞ্জমুখী অভিযান চালান, যা ঢাকার পথ আরও উন্মুক্ত করে দেয়।

বরিশাল হানাদারমুক্ত
দুপুরে ভারতীয় বাহিনীর বিমান হামলার পর পাকিস্তানি সেনারা নৌপথে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।

চাঁদপুর বিজয়
৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর নদী বন্দরের কাছে বিমান থেকে বোমা হামলা চালায় ভারতীয় বাহিনী। বোমা হামলায় হানাদার বাহিনীর বহু নৌযান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদিনই চাঁদপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।

পিরোজপুর মুক্ত
৭ ডিসেম্বর রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা পিরোজপুরের দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছান, এবং ৮ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানি সেনারা কচা নদী দিয়ে বরিশালের দিকে পালিয়ে যায়। এভাবে পুরো জেলা শত্রুমুক্ত হয়।

ময়মনসিংহ–ঢাকা ফ্রন্টে অগ্রযাত্রা
জেনারেল অরোরার নেতৃত্বে তিনটি কলাম ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। হালুয়াঘাট থেকে একটি ব্রিগেড ময়মনসিংহমুখী অভিযান চালায়—যা ঢাকার পতনকে আরও ত্বরান্বিত করে।

মুক্তিযুদ্ধের ৮ ডিসেম্বর তাই শুধু একটি তারিখ নয়—এটি স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একটি জাতির অদম্য লড়াই, সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক। এই দিনের সামরিক সাফল্য, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন—সব মিলিয়ে ৮ ডিসেম্বরকে ‘বিজয়ের প্রাক্কাল’ বললে ভুল হবে না।

এই দিনের প্রতিটি ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—স্বাধীনতা কোনো সহজ অর্জন নয়; লাখো মানুষের রক্ত, ত্যাগ, স্বপ্ন আর দৃঢ়চেতা বিশ্বাসের সমষ্টিই আজকের বাংলাদেশ। ৮ ডিসেম্বর সেই গৌরবের পথকে সুদৃঢ় করেছে, আমাদের নিয়ে গেছে ১৬ ডিসেম্বরের মহাবিজয়ের ঠিক মুখোমুখি।



মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ