Views Bangladesh Logo

১০ ডিসেম্বর: বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সূচনা ও বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের আত্মত্যাগ

Shimul  Zabaly

শিমুল জাবালি

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১০ ডিসেম্বর একটি অত্যন্ত ঘটনাবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ দিন। একাত্তরের এই দিনে একদিকে যেমন রণাঙ্গনে যৌথ বাহিনীর দুর্বার গতিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল, অন্যদিকে কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও চলছিল চরম উত্তেজনা। একই দিনে জাতি হারায় তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ মো. রুহুল আমিনকে, এবং সূচনা হয় নারকীয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের।

বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের শাহাদাতবরণ ১০ ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে। যৌথ বাহিনীর গানবোটগুলো মোংলা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি পৌঁছায়। এ সময় আকাশে তিনটি জঙ্গি বিমান দেখা দিলে মো. রুহুল আমিন সেগুলোকে শত্রুবিমান ভেবে প্রতিরোধের নির্দেশ দেন। যদিও মিত্রপক্ষের একটি ভারতীয় গানবোট থেকে জানানো হয় যে ওগুলো ভারতীয় বিমান। কিন্তু বিভ্রান্তিবশত বিমানগুলো হঠাৎ নিচে নেমে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ঘুরে এসে বোমাবর্ষণ শুরু করে।

এই অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর গানবোটে আগুন ধরে যায়। অনেকে পানিতে ঝাঁপ দিলেও রুহুল আমিন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গানবোটেই অবস্থান করেন। বোমার স্প্লিন্টারের আঘাতে তার বাঁ হাত ভেঙে যায় এবং প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আহত অবস্থায় এক সহযোদ্ধার সহায়তায় তিনি কোনোমতে সাঁতরে রূপসা নদীর পূর্ব পাড়ে ওঠেন। কিন্তু সেখানে ওঁত পেতে থাকা পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা আহত রুহুল আমিনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে স্থানীয় গ্রামবাসীরা নদীতীরেই তাকে সমাহিত করেন।

রণাঙ্গনের চিত্র ও জেলা মুক্তকরণ ১০ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। এদিন ময়মনসিংহ, ভোলা, মাদারীপুর, নড়াইল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ মুক্ত করার লড়াইটি ছিল ভয়াবহ। ভোরের দিকে যৌথ বাহিনীর ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ভুলবশত পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাব্যূহে ঢুকে ফাঁদে পড়ে যায়। পরে ভারতের ১০ বিহার রেজিমেন্ট এবং এস ফোর্সের ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি দুর্গাপুর দিক থেকে আক্রমণ করে তাদের উদ্ধার করে। তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী ভৈরব পালিয়ে যায় এবং সেতুটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।

জামালপুরেও ঘটে এক বীরত্বগাঁথা। ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কমান্ডার পাকিস্তানি দুর্গে আত্মসমর্পণের চিঠি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক মুন্সীকে পাঠান। চিঠি পেয়ে পাকিস্তানি ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের সিও লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ ক্ষিপ্ত হয়ে বাহকের ওপর নির্যাতন চালান এবং একটি বুলেটে কাগজ মুড়ে ফেরত পাঠিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এর পরপরই মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বিমান বাহিনী জামালপুরে তীব্র আক্রমণ শুরু করে।

এছাড়া এদিন যৌথ বাহিনী নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয় এবং খুলনার পালানোর পথ রুদ্ধ করে দেয়। ভারতীয় নৌ ও বিমান বাহিনীর আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে এবং বঙ্গোপসাগরে পলায়নপর পাকিস্তানি জাহাজগুলো আটক হয়।

আন্তর্জাতিক অঙ্গন ও কূটনৈতিক চাপ ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ছিল টানটান উত্তেজনা। এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে এক ভাষণে বলেন, 'সব ধর্মের মানুষই সমানভাবে আমাদের ভাই। এই মহান আদর্শ রক্ষার জন্য আপনারা এবং আমরা সংগ্রাম করছি।' তিনি স্পষ্ট করেন যে, বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা এবং শরণার্থীদের সসম্মানে ফেরা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বিজয় সম্ভব নয়।

অন্যদিকে, জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহী ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। চীন ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে, এবং মার্কিন সপ্তম নৌবহর মালাক্কা প্রণালীর দিকে অগ্রসর হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া নিয়ে ভারত ও জাতিসংঘের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপড়েন সৃষ্টি হয়, যেখানে ভারত নিরাপত্তার স্বার্থে বিদেশি বিমানগুলোকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় প্রবেশের শর্ত জুড়ে দেয়।

পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পাকিস্তান ও বুদ্ধিজীবী হত্যা পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক তার সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলীর মাধ্যমে জাতিসংঘের কাছে একটি আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পেশ করেন। এতে পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক ও সামরিক জনবলকে নিরাপদে ফিরে যাওয়ার সুযোগ এবং আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা হয়।

কিন্তু এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই পাকিস্তানিরা ১০ ডিসেম্বর থেকে ঢাকায় পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করে। এদিনই রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনায় আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে শান্তিনগরের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, যা ছিল বাঙালি জাতির মেধাশূন্য করার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের সূচনা।

১০ ডিসেম্বর ছিল মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিন। একদিকে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের মতো বীরদের আত্মত্যাগ, অন্যদিকে যৌথ বাহিনীর প্রবল আক্রমণে দিগভ্রান্ত পাকিস্তানি বাহিনীর পলায়ন—সব মিলিয়ে এদিনই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ