দূষণের নতুন আতঙ্ক প্রাণঘাতী ‘পিফাস’
দেশে নতুন প্রাণঘাতী এক দূষণের নাম ‘পিফাস’। বিভিন্ন শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ফ্লোরিন ও কার্বন (যৌগ) মিলে সৃষ্টি হয় এই মারাত্মক দূষণ। বেশ কয়েকটি জরিপে বলা হয়েছে- ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকায় পিফাস ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ আকারে। ধীরে ধীরে তা আরও বিস্তৃত এলাকায় ছড়াতে পারে। গবেষকরা বলছেন, প্রাণঘাতী এই দূষণ দ্রুত বন্ধ না করা গেলে ক্যান্সার, চর্মরোগ, লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, থাইরয়েডসহ বড় ধরনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়বে মানুষ।
কী এই পিফাস?
ফ্লোরিন ও কার্বন (যৌগ) মিলে সৃষ্টি হয় পিফাস। এই রাসায়নিক পদার্থটির পুরো নাম পলি অ্যান্ড পারফ্লোরোয়ালকিল সাবট্যান্স বা পিএফএএস যাকে সংক্ষেপে বলা হয় পিফাস। এর অন্যতম উপাদান ফ্লোরিন সর্বাধিক বিক্রিয়াশীল রাসায়নিক মৌল যা (হিলিয়াম ও নিয়ন ব্যতীত) প্রায় সমস্ত পদার্থকে দ্রুত আক্রমণ করে ক্ষয় করা শুরু করে। কক্ষ তাপমাত্রায় এটি যে কোনো জৈব পদার্থ ও বহু ধাতুর সঙ্গে দহন প্রক্রিয়া শুরু করে। ফ্লোরিন ইট, কাচ ও ইস্পাতের সঙ্গে বিক্রিয়া করে এগুলো জ্বালিয়ে ফুটো করে বেরিয়ে যায়। বিশুদ্ধ ফ্লোরিন অত্যন্ত বিষাক্ত একটি গ্যাস। বাতাসে অতিস্বল্প পরিমাণে ফ্লোরিন থাকলেই মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ফ্লোরিন গ্যাস জীবিত কলাকোষকে অতিদ্রুত জারিত করে ধ্বংস করে ফেলে, জীবকোষের পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে অতিবিষাক্ত হাইড্রোফ্লোরিক অ্যাসিড তৈরি করে এবং এসব বিক্রিয়াতে অত্যধিক তাপ উৎপাদিত হয়। ফলে ফ্লোরিনের সংস্পর্শে এলে জীবদেহের রাসায়নিক বিক্রিয়া, বিষ ও উত্তাপজনিত যে তিন ধরনের ক্ষতি হয় তার থেকে নিরাময় অত্যন্ত দুরূহ। অন্যদিকে কার্বন মনোক্সাইড (কার্বন যৌগ) একটি বিপজ্জনক গ্যাস। এটি অত্যধিক মাত্রায় কেউ নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে সে দ্রুত অজ্ঞান হয়ে পড়বে এবং সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করা না হলে রোগীর মৃত্যু ঘটে।
পিফাসের ক্ষতিকারক দিক
পিফাস খুব সহজে ধ্বংস হয় না বলে এটি দীর্ঘ সময় পরিবেশে থেকে যেতে পারে। এজন্য এটিকে ‘চিরস্থায়ী কেমিক্যাল’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। বিশেষজ্ঞরা জানান, একটি নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়েও বেশি পরিমাণে এই রাসায়নিকের সংস্পর্শে এলে ক্যান্সারসহ নবজাতকের জন্মগত ত্রুটিও দেখা দিতে পারে। পিফাসের কারণে লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, থাইরয়েড, কিডনি জটিলতা, চর্মরোগ, বন্ধ্যাত্ব ও অনেক ক্ষেত্রে স্ট্রোকের সম্ভাবনা থাকে।
দেশে পিফাসের সর্বাধিক উপস্থিতি
ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার কিছু এলাকায় পিফাসের ব্যাপক উপস্থিতি পেয়েছেন গবেষকরা। এসব এলাকার টেক্সটাইল কারখানার আশপাশের ৮৭ শতাংশ পৃষ্ঠজল এবং ৭৫ শতাংশ কলের পানিতে পিফাস পাওয়া গেছে। সাভারের কর্ণতলী নদী ও টঙ্গীর তুরাগ নদে পিফাসের মাত্রা সীমার চেয়ে বহু গুণ বেশি। এ ছাড়া ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার অসংখ্য নদনদীতে ভয়ংকর পিফাসের উপস্থিতি পেয়েছেন গবেষকরা। যার কারণে এ ধরনের এলাকায় বসবাসরত মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসছে। আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন জটিল রোগে।
যা বলছে গবেষণা ও বিশেষজ্ঞরা
বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত বৃহত্তম মাল্টিডিসিপ্লিনারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) ২০২৪ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা ও তার আশপাশের গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার কিছু এলাকার শিল্প এলাকা থেকে সংগৃহীত পৃষ্ঠ ও কলের পানির নমুনায় উচ্চমাত্রার বিষাক্ত পিফাস রাসায়নিক পাওয়া গেছে। অনেক নমুনায় পিফাসের পরিমাণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডসের নির্ধারিত মাত্রার অনেক উপরে ছিল। এসব এলাকার সিরামিক, ট্যানারি, পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা থেকে বেড় হওয়া বর্জ্য আশপাশের নদনদী ও খাবার পানিতে মিশেছে। যেখানে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পিফাসের (পার-পলিফ্লুরোঅ্যালকিল) উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এই ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের প্রয়োজন। জনগণের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত নিয়ন্ত্রণ সংস্থাসমূহকে পিফাস দূষণ নির্মূল ও হ্রাসের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশে নিউক্লিয়ার মেডিসিন কার্যক্রমের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসের (নিনমাস) পরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল বারী ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘পিফাস পরিবেশে সহজে ভাঙে না এবং প্রাণীর শরীরে স্থায়ীভাবে জমা হতে পারে। এর ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে এই রাসায়নিক পদার্থগুলো বিভিন্ন মাধ্যম থেকে খাল-বিল, নদী-নালাতে চলে আসছে এবং আমাদের খাবার পানিতে মিশে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পিফাসের বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে যার মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, ভ্রূণ বৃদ্ধি এবং থাইরয়েড হরমোন কার্যকারিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘমেয়াদি পিফাসের সংস্পর্শে থাকার ফলে ক্যান্সার, মারাত্মক চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ভারসাম্যহীনতা, নবজাতকের কম ওজনে জন্ম এবং টিকার কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া পিফাস লিভার ও কিডনিরও মারাত্মক ক্ষতি করে।
পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (এসডো) সিনিয়র পলিসি ও টেকনিক্যাল উপদেষ্টা ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘পোশাকশিল্প ও বিভিন্ন সিরামিক কারখানা থেকে বিষাক্ত পিফাস নির্গমন জনগণকে উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছে। আমাদের নদী-নালা ও কলের পানিতে এর দূষণ ঘটছে। এ কারণে রপ্তানি শিল্পকারখানাগুলোকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। পিফাস দ্বারা দূষিত পণ্যগুলোকে পুনঃব্যবহারযোগ্য নয় এবং অচক্রাকার হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। পিফাসযুক্ত ভোক্তা পণ্য যেমন টেক্সটাইল, টেক্সটাইল পণ্য এবং খেলনা, রান্নার সামগ্রী, খাদ্য প্যাকেজিং এবং অন্যান্য পণ্যের ব্যবহারসহ উৎপাদন ও আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। পিফাস বা টেক্সটাইল উৎপাদনে ব্যবহৃত জায়গার আশপাশের স্থানের মাটি এবং খাবার পানি বিশুদ্ধ করতে দ্রুত এবং দক্ষ পরিকল্পনা তৈরির বিকল্প নেই। একইসঙ্গে রাষ্ট্রের উচিত হবে দ্রুত স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর পিফাসের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘পিফাস দূষণে আমরা জর্জরিত। একসময় আর্সেনিক নিয়ে গবেষণা হয়েছে, আমরা আন্দোলন করেছি। এখনো দেশের মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে। এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উপস্থিত হয়েছে প্রাণঘাতী মারাত্মক দূষণ পিফাস। ভূপৃষ্ঠের পানি রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব ছিল; কিন্তু আমাদের নীতিগুলোর অকার্যকারিতা ও দূরদৃষ্টির অভাবের কারণে পানি ও মাটি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। আমরা যে কত সংকটের মধ্যে রয়েছি তা বুঝতেই পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘দ্রুত শিল্পায়ন উচ্চপর্যায়ে পিফাস দূষণে ভূমিকা রাখছে। এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বৈশ্বিক সমস্যাও। তাই রাষ্ট্রকে অবশ্যই এ দূষণ বন্ধে কাজ করতে হবে। কেমিক্যাল আমদানির রেজিস্ট্রেশন মনিটরিং করতে হবে। পিফাস দূষণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। অথচ পিফাস ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছালেও বাংলাদেশে এখনো আন্তর্জাতিক পিফাস নিষিদ্ধকরণ নীতিমালা গ্রহণ করেনি এবং জাতীয় পর্যায়ে নেই কোনো আইনও!
হিরা তালুকদার: সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে