Views Bangladesh Logo

মাদকের অন্ধকার জগৎ এবং একটি অর্ধগলিত লাশ

Masum   Hossain

মাসুম হোসেন

মাস পাঁচেক ধরে আত্মগোপনে থাকার পর অবশেষে সুমাইয়া ফেরেন। তবে নিথর দেহে, গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায়। স্বজনরা অনেক খুঁজেছেন, মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাননি তার। স্বামী ও মায়ের পরিবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঢুকে পড়েন অন্ধকার জগতে, যেখানে ছিল মাদক আর রহস্যেঘেরা জীবন।

ঘটনাটি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার। ৩২ বছর বয়সী সুমাইয়া আক্তার উপজেলার পারতেখুর মধ্যপাড়া গ্রামের মৃত জহুরুল ইসলামের মেয়ে। প্রায় আট বছর আগে তার বিয়ে হয় একই গ্রামে। তার স্বামীর নাম বাপ্পি।

সুমাইয়ার স্বজনরা জানান, সুমাইয়ার সঙ্গে তার স্বামীর সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। তিনি (সুমাইয়া) বাবার বাড়িতে এসেই বেশি সময় থাকতেন। এর মধ্যে একই উপজেলার খরনা ধাওয়াপাড়া গ্রামের রাজু ও রাকিবুল ইসলাম নামে দুই যুবকের সঙ্গে সুমাইয়ার সখ্য গড়ে ওঠে। তাদের মধ্য রাজু সুমাইয়াকে মাদক ব্যবসায়ে জড়িয়ে নেন বলে অভিযোগ।

গত ২৫ জুন শাজাহানপুরের বি-ব্লক রহিমাবাদ শালুকগাড়ি গ্রামের এক ভাড়াবাসা থেকে সুমাইয়ার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। তার লাশ ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল, গলায় ছিল ওড়না পেঁচানো।

জানা গেছে, সুমাইয়া সেই বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। সেখানে স্বামী পরিচয়ে রাজু তার সঙ্গে থাকতেন।


যেভাবে আত্মগোপনে যান সুমাইয়া

বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর কাছে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়েছিলেন সুমাইয়া; কিন্তু গিয়েছিলেন অন্য কোথাও। তার মা, ভাই কাওসার ও স্বামী বাপ্পি বারবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন। পরে জানা যায় তিনি গিয়েছিলেন রাজু নামে সেই যুবকের কাছে। রাজুর বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। সেই রাজুই তাকে জড়িয়ে নেন অপরাধজালে, মাদক বিক্রির মতো ভয়াবহ কাজে। পরিবারের অনুরোধ-নিষেধ কিছুই মানেননি সুমাইয়া। এমনকি প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাজু, রাকিবুলসহ তাদের সহযোগীদের মারধরের শিকার হন সুমাইয়ার ভাই কাওসার আহম্মেদ। এর পরই সুমাইয়ার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। আত্মগোপনে চলে যান তিনি। ফেরেন লাশ হয়ে।

বাবার বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে কী ঘটেছিল

মরদেহ উদ্ধারের আগে সুমাইয়া স্বামীর বাড়ি না গিয়ে দীর্ঘদিন বাবার বাড়ি থাকা শুরু করেন। ওই সময় তিনি রাজুর সঙ্গে পুরোদমে মেলামেশা শুরু করেন। রাজু তাকে দিয়ে মাদক বিক্রি করানো শুরু করেন। বিষয়টি জেনে যান সুমাইয়ার ভাই কাওসার। তিনি সুমাইয়াকে স্বামীর বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য ও মাদক ব্যবসায় ছেড়ে দিতে চাপ দেয়া শুরু করেন। এরই একপর্যায়ে রাজু ও তার সহযোগীরা কাওসারকে মারধর করেন।

সুমাইয়ার ভাই কাওসার জানান, রাজু ও রাকিবুল নামে দুজনের সঙ্গে সুমাইয়ার সখ্য ছিল। রাজুর বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে মাদক ব্যবসায়ের অভিযোগ রয়েছে। সেই রাজু তার বোন সুমাইয়াকে দিয়ে ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি করাতেন। বিষয়টি জানার পর অনেকবার সুমাইয়াকে মাদক ব্যবসা থেকে সরে আসতে বলা হয়; কিন্তু সুমাইয়া কারও নিষেধ শুনতেন না।

ঘটনার শেষ এখানেই নয়, সুমাইয়াকে শাষণ করায় কাওসারকে মারধরও করেন রাজু-রাকিবুলসহ তাদের সহযোগীরা।

তিনি আরও জানান, সুমাইয়া স্বামীর বাড়ি না গিয়ে রাজুর কাছে গিয়েছিলেন। এরপর থেকেই সবার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন সুমাইয়া। তবে এটা তিনি সুমাইয়ার লাশ উদ্ধারের পর জানতে পেরেছেন।

রাজু ও রাকিবুলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। রাজুকে পাওয়া না গেলেও রাকিবুলকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়। রাকিবুলের কাছে সুমাইয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। পরবর্তীতে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

একটি ভাড়াবাসায় জীবনের শেষ অধ্যায়

শাজাহানপুরের বি-ব্লক রহিমাবাদ শালুকগাড়ি গ্রামে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে রাজু ও সুমাইয়া একটি বাসা ভাড়া নেন। একটানা পাঁচ মাস ছিলেন তারা সেখানে। বাড়িওয়ালা ও স্থানীয়দের কাছে রাজু নিজেকে গাড়িচালক হিসেবে পরিচয় দেন। মাঝে মধ্যে সেই বাড়িতে এক যুবক আসতেন, যাকে রাজু ভাতিজা বলতেন।

গত ২৩ জুন সন্ধ্যায় শেষবার দেখা গেছে সুমাইয়াকে ভাড়াবাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে। এরপর তার ঘর থেকে ভেসে আসে দুর্গন্ধ। অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা না খুললে স্থানীয়রা জানালা ভেঙে দেখতে পান তার ঝুলন্ত দেহ। পরে পুলিশ এসে উদ্ধার করে তার মরদেহ।


সুমাইয়ার বাড়িওয়ালা অহেদ আলীর স্ত্রী রহিমা বেগম জানান, রাজু ও সুমাইয়া তাদের বাড়ি ভাড়া নেন। তারা নিজেদের স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দেন। ভাড়াবাসায় তারা একসঙ্গেই থাকতেন।

সর্বশেষ গত ২৩ জুন রাতে রাজু ও তার ভাতিজা পরিচয় দেয়া সেই যুবক বাসা থেকে চলে যান। ওই সময় সুমাইয়া কিছুক্ষণ বারান্দায় থেকে ঘরে ঢুকে যান। এরপর থেকে সুমাইয়াকে আর দেখা যায়নি। ২৫ জুন সকালে তার মরদেহ পাওয়া যায়। এই সময়ের মধ্যে ওই বাসায় কী ঘটেছে তা তাদের জানা নেই।


আত্মহত্যা নাকি খুন?

সুমাইয়ার ঘরের দরজা, বিছানা, তার শারীরিক অবস্থা সবই ছিল রহস্যে মোড়া। ভেতর থেকে আটকানো দরজার পাশে আরেক ঘর। সেই ঘরের দরজাটি বাইরে থেকে আটকানো, যেটা খুলে সহজেই অন্য ঘর থেকে বের হওয়া সম্ভব। সেই ঘরের পকেট দরজাও ছিল খোলা। যেটা দিয়ে সুমাইয়ার থাকার ঘরে প্রবেশ করা যায়। তাহলে কী কেউ ভেতর থেকে দরজা আটকে রেখে চলে গিয়েছিলেন?

বারান্দার দরজা ভেতর থেকে তালা ঝুলানো ছিল; কিন্তু সেখানে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাহির থেকে ভেতরে তালা লাগানো যায়। সুমাইয়ার দুই হাতে ছিল রক্তাক্ত জখম। পোশাকের বুকের অংশে ছিল রক্তের দাগ। তার পেটিকোট উল্টোভাবে অর্থাৎ পেছনে বাঁধা ছিল। ঘরের ভেতরও ছিল অগোছালো।

তার সুরতহাল প্রতিবেদনে জখম ও রক্তের দাগের কথা উল্লেখ নেই। এমনকি সুরতহালে স্বাক্ষর থাকা সুমাইয়ার ভাই কাওসার জানিয়েছেন, তারা জানতেন না কীসে স্বাক্ষর করছেন।

সুমাইয়ার মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন শাজাহানপুর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রাসেল আহম্মেদ।

তিনি জানান, ঘটনাস্থলে যা যা পাওয়া গিয়েছে সুরতহালে তাই-ই লেখা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে সুমাইয়ার লাশ উদ্ধারের ঘটনাকে আত্মহত্যা বলা হয়েছে। বিষয়টি মৃতের পরিবারকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ওই পরিবার থেকে থানায় কোনো অভিযোগও দেয়া হয়নি। থানা পুলিশের জিডির সূত্র ধরে লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়।

সুমাইয়ার পরিবারের দাবি, সুরতহাল রিপোর্টে অনেক তথ্য গোপন করা হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে পুলিশ হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা বলছে।

সুমাইয়ার স্বজনরা আরও জানান, সুমাইয়ার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় থানায় অনেকবার হত্যা মামলা করার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। এখন এসে পুলিশ বলছে সুমাইয়া আত্মহত্যা করেছেন।

সুমাইয়ার ভাই কাওসার ও চাচা দুলাল হোসেন জানান, সুমাইয়ার ঘটনায় আদালতে হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তারা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চান।


নতুন রহস্য

যেখানে সুমাইয়া মারা গিয়েছিলেন, সেই ঘরে তালা ঝুলানো ছিল; কিন্তু কিছুদিন আগে অজানা কেউ সেই ঘরের তালা ভেঙে ঢুকে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে গিয়েছেন।

কে এসেছিলেন? কেন এসেছিলেন? কি খুঁজছিলেন বা কি নিয়ে গেলেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো অজানা।

বাড়িওয়ালার স্ত্রী রহিমা বেগম জানান, সেই ঘরে কে ঢুকেছিলেন তা তারা দেখেননি। সপ্তাহখানেক আগে তালা ভেঙে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে ঘরে প্রবেশ করে দেখা যায়, সবকিছু এলোমেলো ও অগোছালো। হয়তো কেউ কিছু একটা খুঁজছিলেন বা নিয়ে গেছেন।


জানতে চাইলে শাজাহানপুর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) রাশেদুল ইসলাম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, মরদেহের শরীরে যা যা দেখা যাবে সবই সুরতহাল রিপোর্টে থাকতে হবে। মৃতের স্বজনরা যদি দাবি করেন রক্তের দাগের কথা বলা হয়নি তাহলে তারা আবেদন করতে পারবেন। এখনো সুরতহাল প্রতিবেদন পরিবর্তন করার সুযোগ আছে। এ ঘটনাটি তদন্ত করে আবারও দেখা হবে।

তিনি আরও বলেন, অর্থের বিনিময়ে পুলিশ সদস্যের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তন করানোর কোনো সুযোগ নেই।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ