থমকে গেছে বগুড়ার ইয়ুথ কয়্যার, সংস্কৃতির পথে ‘রাজনৈতিক বাধা’
রাত সোয়া ৮টা। ব্যস্ত শহরের এক কোণে একটি পুরোনো গেট পেরিয়েই চোখে পড়ল এক মনভরানো দৃশ্য। শিশু থেকে কিশোর-কিশোরীরা মেতে আছে নাচ-গানে। তাদের হাসি-ছন্দে যেন ধরা দেয় এক টুকরো স্বপ্ন। পাশে বসে থেকে সেসব পর্যবেক্ষণ করছেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। তার চোখে-মুখে গর্ব; কিন্তু কোথাও যেন চাপা উদ্বেগ। তবলায় হাত রেখে সঙ্গীতের তাল মেলাচ্ছেন সভাপতি। সংগঠনের প্রাণটা এখনো ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। ঘটনাটি বগুড়া ইয়ুথ কয়্যারের।
তবে ইয়ুথ কয়্যারের সৌন্দর্যের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর বাস্তবতা। এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিল্পীদের মনেও এখন বাসা বেঁধেছে অজানা আতঙ্ক। সামনে কী অপেক্ষা করছে? তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ডুবে আছেন সংগঠনের নেতারা।
বগুড়া ইয়ুথ কয়্যার শুধু একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের নাম নয়, এটি বগুড়াবাসীর আবেগ। নাটক, গান, কোরিওগ্রাফি এবং সমাজ সচেতন বার্তা দিয়ে কয়েক দশক ধরে আঞ্চলিক সংস্কৃতির আলো ছড়িয়ে আসছে সংগঠনটি। সেই সংগঠনের ওপর এখন নেমে এসেছে এক কালো ছায়া। গত এক বছর ধরে থমকে আছে ইয়ুথ কয়্যারের নিয়মিত কর্মকাণ্ড।
সংগঠনের একাধিক সূত্র জানায়, এই স্থবিরতার মূল কারণ রাজনৈতিক প্রভাব এবং কার্যকর পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে বন্ধ হয়ে আছে সংগঠনের নিয়মিত কার্যক্রম। তবে ঘরোয়াভাবে সীমিত পরিসরে চর্চা চলছে।
বর্তমানে সপ্তাহে দুদিন (শনিবার ও মঙ্গলবার) সংগঠনের দরজা খোলা হয়। তাও শুধু সন্ধ্যা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বাকি দিনগুলোতে মূল ফটকে ঝুলে থাকে তালা।
তবুও তারা বিশ্বাস করেন শিগগিরই প্রাণ ফিরে পাবে বগুড়া ইয়ুথ কয়্যার।
রাজনৈতিক ট্যাগের জটিলতা
ইয়ুথ কয়্যারের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সংগঠনের কিছু কার্যক্রম বা গানে রাজনৈতিক ট্যাগ দেয়া হয়েছে। এটি তাদের কাজের অগ্রগতিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে সংগঠন থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজ করেন না। তারা সমাজ ও সংস্কৃতির সেবক হিসেবেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
২০১১ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) আশির দশকে শুরু হওয়া ইয়ুথ কয়্যারের নিয়মিত অনুষ্ঠান থেকে বাদ পড়ে সংগঠনটি। রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে বিটিভি থেকে তাদের বের করা হয়। এরপর থেকেই তারা রাজনীতিভিত্তিক বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে এই বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। তাদের সব কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমি থেকে দেয়া অনুদানও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২০২৫ সালে তাদের সরকারি কোনো অনুদান দেয়া হয়নি যা তাদের জন্য আর্থিক সংকটের সৃষ্টি করেছে।
গৌরবময় যাত্রা
১৯৭৬ সালে বগুড়ার নবাববাড়ি সড়কে প্রতিষ্ঠিত হয় ইয়ুথ কয়্যার। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা তৌফিকুল আলম টিপু।
এই সংগঠন মূলত আঞ্চলিক গান ও সংস্কৃতিতে যুবসমাজকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের প্রথম গান ছিল গোবরা খ্যায়া যা শেরপুরের দই। পরবর্তীতে তাদের গাওয়া কালো ছুড়িডা হামাক পাগলা করিচে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯৭৯ সালে বিটিভিতে তাদের ৮টি গান সম্প্রচারিত হওয়ার পর সংগঠনটি জাতীয় পরিচিতি অর্জন করে। এরপর তারা দেশের প্রায় সব জেলায়ই অনুষ্ঠান করেছে।
সংগঠনটি শুধু গানই নয়, নারী ও শিশু অধিকার নিয়েও কাজ করে আসছে। আশির দশকে তাদের প্রথম অ্যালবামের নাম গ্যাঞ্জাম।
সুর ও কথার মাধ্যমে সেই অ্যালবামে সমাজের নানা সমস্যা তুলে ধরা হয়।
এছাড়া আশির দশকে সংগঠনটির হামরা বগুড়ার ছোল নামে একটি গান বগুড়াবাসীর হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। এখনো লোকমুখে গানটির প্রচলন রয়েছে। এই গানই ইয়ুথ কয়্যারে নতুন মাত্রা যোগ করে যা তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
২০১৩ সালের গুজব এবং রাজনৈতিক বিতর্ক
ইয়ুথ কয়্যারের গানের তালিকায় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার সূত্রপাত ঘটায় ২০১৩ সাল। দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজবটি বগুড়ার মধ্যে ব্যাপক তাণ্ডব সৃষ্টি করে। এর পরপরই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা টিপু একটি গান লেখেন যার নাম ছিল বামে-ড্যান, বাম-ড্যান। এই গানে একাত্তরের ইতিহাস তুলে ধরে রাজাকারসহ স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব প্রসঙ্গ নিয়েও গানটিতে রাজাকারদের সমালোচনা করা হয়।
কেন থমকে আছে ইয়ুথ কয়্যায়ের কার্যক্রম?
দীর্ঘ সময় ধরে সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়নে কাজ করলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে সংগঠনটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এর পেছনের প্রধান কারণ রাজনৈতিক সংকট, পৃষ্ঠপোষকতা এবং সাংস্কৃতিক কর্মসূচির প্রতি সরকারি নজরের অভাব।
সংগঠনের নেতারা বলছেন, তাদের কিছু গান ও কার্যক্রম ভুল ব্যাখ্যার শিকার হয়েছে। ফলে রাজনৈতিকভাবে তাদের কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়াও একসময় যেসব টিভি চ্যানেল তাদের গান ও নাটক প্রচার করত, এখন তারা বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো বিবেচনা করে। সেইসঙ্গে আর্থিক সংকটও সংগঠনটির জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ৩০ জন কর্মী নিয়ে চলছে তাদের এই সংগঠন।
ইয়ুথ কয়্যারের সভাপতি লায়ন আতিকুর রহমান মিঠু জানান, ২০২৫ সাল থেকে শিল্পকলা একাডেমির পাওয়া অনুদান বন্ধ করা হয়েছে। তার জানা নেই কেন এই সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। আর জেলা প্রশাসন থেকে তারা কোনো সহায়তা আগেও পাননি এখনো নেই।
কীভাবে ফিরতে পারে ইয়ুথ কয়্যার?
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা তৌফিকুল আলম টিপু ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আপাতত আমাদের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বছর খানেক আগে নিয়মিতভাবে সংগঠনের কার্যালয় খোলা থাকত। বর্তমানে সপ্তাহে দুদিন কার্যালয়ে বসা হয়। আমরা রাজনীতি নয়, সমাজ নিয়ে কাজ করি। কিছু গান রাজনৈতিকভাবে নেয়া হচ্ছে। আর এতেই আমাদের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।’
সংগঠন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সংগঠনটি এগিয়ে যাবে।
সেইসঙ্গে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলে বা একটি নির্বাচিত সরকার এলে ইয়ুথ কয়্যার আবার কার্যক্রম শুরু করবে। সংগঠনটি ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজন সামাজিক সহযোগিতা, গণমাধ্যমের মনোযোগ এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে