Views Bangladesh Logo

চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-২০

চিপ নিয়ে চীন-মার্কিন লড়াই: ক্রেতা যখন প্রতিদ্বন্দ্বী

Mahmud  Hossain

মাহমুদ হোসেন

০১৫ সাল। ইন্টেলের সিইও ব্রায়ান ক্রজানিচ তখন সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসসিয়েশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। স্বাভাবিকভাবেই, তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল ওয়াশিংটনে, যেখানে তিনি ট্যাক্স কমানো কিংবা নিয়ম-কানুন শিথিল করার মতো চিরাচরিত ব্যবসায়িক দাবিগুলোই জানাতেন। কিন্তু ওই বছর তিনি আর ব্যবসায়িক সুবিধা চাইলেন না, সরাসরি বললেন, “চীন যেভাবে আমাদের চিপ ইন্ডাস্ট্রি দখল করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সেটা আমেরিকার জন্য বিপজ্জনক। এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।”

তখন চীন ছিল প্রায় প্রতিটি মার্কিন চিপ কোম্পানির সবচেয়ে বড় বাজার। বিশ্বের ইলেকট্রনিক্স অ্যাসেম্বলিং-এর প্রায় পুরোটাই তখন হতো চীনের কারখানায়। মার্কিন কোম্পানিগুলো চীনে সরাসরি চিপ বিক্রি করে প্রচুর লাভ করছিল। কিন্তু একই সময়ে চীন গোপনে চেষ্টা চালাচ্ছিল মার্কিন কোম্পানিগুলোকে তাদের সাপ্লাই চেইন থেকে সরিয়ে দেওয়ার। বেইজিং প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল এক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করল শুধু নিজেদের চিপ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্য, যাতে আর আমেরিকার ওপর নির্ভর করতে না হয়।

মার্কিন কোম্পানিগুলো পরিস্থিতি বুঝেও প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছিল না। কারণ চীনই তাদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তাদের একটাই ভয় ছিল, একটু শব্দ করলেই না চীন আবার রেগে গিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়!

মার্কিন সরকারের ভেতরে ভেতরে উদ্বেগ বাড়তে শুরু করল। বাণিজ্য দপ্তর দেখল, চীন ভর্তুকি দিয়ে আন্তর্জাতিক নিয়ম ভাঙছে। পেন্টাগন এই ভেবে ভয় পেল, এই চিপগুলো দিয়েই চীন উন্নত অস্ত্র বানাবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রমাণ পেল, চীন তাদের কোম্পানিগুলোকে ব্যবহার করছে আমেরিকান প্রতিযোগীদের বাজার থেকে সরিয়ে দিতে।

এদিকে মার্কিন চিপ ইন্ডাস্ট্রির পুরনো স্লোগান চলছিল বহাল তবিয়তে— “গ্লোবালাইজেশনই সমাধান।”
কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। চিপ তৈরির সবচেয়ে কঠিন অংশ—ফ্যাব্রিকেশন—প্রায় পুরোটা চলে গিয়েছিল তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ায়, বিশেষ করে টিএসএমসির হাতে। আমেরিকার একদা শক্তিশালী অবস্থান—ম্যানুফ্যাকচারিং, লিথোগ্রাফি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি—সবই ঝিমিয়ে পড়ছিল। আর ওয়াশিংটন তখনও বিশ্বাস করত, “বাজারই সব ঠিক করে দেবে।”

২০১৬ সালের শেষের দিকে আমেরিকানরা বুঝতে শুরু করল যে পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই। বাণিজ্যমন্ত্রী পেনি প্রিৎজকার চীনের দিকে সরাসরি আঙুল তুলে অভিযোগ আনলেন অন্যায্য বাণিজ্যনীতি এবং রাষ্ট্র-সমর্থিত টেকওভার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। হোয়াইট হাউস ভবিষ্যতের চিপ ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে একটি বড় রিপোর্টও প্রকাশ করল। কিন্তু আশ্চর্যভাবে রিপোর্টে প্রায় চুপচাপ এড়িয়ে যাওয়া হলো যে, বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন কতটা দুর্বল হয়ে গেছে, আর উৎপাদন কতটা তাইওয়ান-কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। আমেরিকায় সবাই তখনো ‘গ্লোবালাইজেশন’ আর ‘মাল্টিল্যাটারালিজম’-এর মতো শান্তিপূর্ণ শব্দগুলোই ব্যবহার করছিল। মূল সংকটটা কেউ যেন বুঝতে পারছিল না।

সরকারের গভীরে থাকা জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখলেন অনেক বেশি সতর্ক দৃষ্টিতে। তাদের ধারণা ছিল, ইলেকট্রনিক্স সাপ্লাই চেইনে চীনের শক্ত অবস্থান গুপ্তচরবৃত্তি বা ব্যাকডোর ব্যবহারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। হুয়াওয়ে আর জেডটিই তখন সারা দুনিয়া জুড়ে দ্রুত বাজার দখল করছিল। মার্কিন গোয়েন্দারা বহুদিন ধরে বলছিলেন, চীনা সরকারের সঙ্গে হুয়াওয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। এ ছাড়াও জেডটিই এবং হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা ইরান ও উত্তর কোরিয়ায় নিষিদ্ধ সরঞ্জাম বিক্রি করেছে। ওবামা প্রশাসন জেডটিই-কে মার্কিন প্রযুক্তি বিক্রি সীমিত করে। জেডটিইর জন্য এই পদক্ষেপ তাদের জন্য ছিল মৃত্যুঘণ্টার মতো। ২০১৭ সালের মার্চে তারা জরিমানা দিয়ে বিষয়টা মিটমাট করে নিল।

চিপ কোম্পানিগুলো সরকারের সাহায্য চাইলেও চীনের রোষানল এড়াতে চুপচাপ ছিল। তারা গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের বড় পরিবর্তন চায়নি। পাবলিকলি তারা বলত, চীনের সঙ্গে মিলেমিশে চলাই ভালো। কিন্তু আড়ালে তারা স্বীকার করত, চীনের রাষ্ট্র-সমর্থিত কোম্পানিগুলো একসময় তাদের ডুবিয়ে দিতে পারে। মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মতে, সরকার হস্তক্ষেপ না করলে আমেরিকান চিপ কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে তাদের জ্ঞান, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ সবই চীনে স্থানান্তর করবে। তাই তাঁরা কঠোর এক্সপোর্ট কন্ট্রোলের পক্ষে চাপ দিলেন।

২০১৮ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র জানতে পারল, জেডটিই আবারও মিথ্যা বলেছে এবং পূর্বের শর্ত ভেঙেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী উইলবার রস এবার কঠোর হলেন এবং চুপিসারে জেডটিইর ওপর আবারো নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। সঙ্গে সঙ্গে জেডটিই মার্কিন চিপ পাওয়া বন্ধ করল এবং তাদের কার্যত টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে গেল।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিষয়টিকে প্রযুক্তি নিরাপত্তার সমস্যা হিসেবে দেখলেন না। ট্রাম্পের কাছে জেডটিইর বিষয়টা ছিল কেবল ট্রেড ডিলের দর-কষাকষির হাতিয়ার। শি জিনপিং অনুরোধ করলে ট্রাম্প টুইট করলেন, তিনি জেডটিই-কে বাঁচাতে চান, নইলে চীনে অনেক চাকরি চলে যাবে। জেডটিই আবারো জরিমানা দিল, আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের মার্কিন প্রযুক্তি কেনার অনুমতি ফিরিয়ে দিল।

তবে এই ঘটনায় একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল, যে কোনো গ্লোবাল টেক কোম্পানি মার্কিন চিপ না পেলে ধসে পড়তে পারে। সেমিকন্ডাক্টর শুধু ডিজিটাল যুগের ভিত্তিই নয়, এটি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র।

(ক্রিস মিলারের সাড়াজাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ৪৯তম অধ্যায় “এভরিথিং উই আর কমপিটিং অন” থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)


লেখক পরিচিতি:
মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসি’র কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ